Breaking News

সরকারি অবহেলায় বেড়েই চলেছে যক্ষ্মা

‘যার হয় যক্ষ্মা, তার নাই রক্ষা’– প্রবাদ বাক্যটি একসময় মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করত। কারণ তখন টিবি রোগের কোনও ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। টিবি মানেই সেদিন ছিল মৃত্যুর পরোয়ানা। কত অমূল্য প্রাণ কেড়ে নিয়েছে এই ক্ষয় রোগ তার কোনও হিসেব নেই।

আজ একবিংশ শতাব্দীতে যখন চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে পর্যন্ত ভারত পৌঁছে গেছে, তখনও কি আমরা আতঙ্কমুক্ত হতে পেরেছি? আজও টিবি রোগাক্রান্তের সংখ্যায় ভারতই জগতে শ্রেষ্ঠ আসনে অধিষ্ঠিত। ২০২০ সালে টিবি রোগীর সংখ্যা কিছুটা কমলেও, নজরদারির অভাবে ২০২১ সালে টিবি রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে ১৯ শতাংশ। বর্তমানে প্রতি বছর ২৬ লক্ষের উপরে মানুষের টিবি রোগ নির্ণীত হয়। অনির্ণীত রোগীর সংখ্যা এর থেকে ঢের বেশি। রেজিস্ট্যান্ট টিবিতেও ভারতে প্রতি বছরে ৪ লক্ষেরও বেশি সংখ্যক রেজিস্ট্যান্ট টিবি রোগী ধরা পড়ে। টিবিজনিত কারণে মৃত্যুর সংখ্যাতেও ভারতই সবার সেরা। এখনও আমাদের দেশে প্রতি ৩ মিনিটে একজন করে টিবি রোগীর মৃত্যু হয়। এডস আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে টিবি সংক্রমণের দিক থেকেও ভারত প্রথম স্থানে। তা সত্ত্বেও বতর্মানে টিবির ওষুধের সরবরাহ অনিয়মিত।

আগে চিকিৎসার জন্য ওষুধ না থাকলেও, সেদিন ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবি ছিল না। এডস রোগী ছিল না। ডায়াবেটিসের মতো রিস্ক-ফ্যাক্টরগুলি আগে এতটা ছিল না। টিবি রোগীর সংস্পর্শে থাকা শিশুরাও আজ বিপুল সংখ্যায় এই রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। টিবি রোগের ঝুঁকি বাড়ছে গর্ভবতী মহিলাদের মধ্যেও। সেই কারণে বাড়ছে মাতৃ-মৃত্যুও। আর ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবির ক্ষেত্রে বাড়তি সমস্যা হল এদের সংস্পর্শে যারা আসছেন তারাও ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবিতেই আক্রান্ত হচ্ছেন। এই অবস্থায় টিবি রোগীর চিকিৎসার ওষুধ প্রায়শই অনিয়মিত হয়ে পড়ায় এই ধরনের রোগীর সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। তেমনি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবি রোগীদের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধও দীর্ঘদিন ধরে অমিল, ফলে মৃত্যুর হারও বাড়ছে। তাই কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষিত ২০২৫-এর মধ্যে টিবি নির্মূল কর্মসূচি আজ এক অলীক কল্পনায় পরিণত হয়েছে।

কেন এই শোচনীয় পরিণতি? এ কি অনিবার্য ছিল? মেডিসিন বিশেষজ্ঞরা বলেন, টিবি হল দরিদ্রের অসুখ। অপুষ্টি, অত্যধিক পরিশ্রম এবং ঘিঞ্জি অস্বাস্থ্যকর জায়গায় বসবাস এবং অস্বাস্থ্যকর কর্মস্থল– এ সবই টিবির মূল কারণ। ভারত ক্ষুধাসূচকে বিশ্বের ১০৩তম স্থান দখল করেছে। অপুষ্টি দারিদ্র বেকারত্বে যেখানে পৃথিবীর একেবারে হতদরিদ্র কিছু আফ্রিকার দেশের সমতুল স্থানে রয়েছে, সেখানে টিবিমুক্ত ভারতের স্বপ্ন? ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন ‘প্রধানমন্ত্রী টিবিমুক্ত ভারত অভিযান প্রকল্পের, ‘নি-ক্ষয় পোষণ যোজনা, নি-ক্ষয় মিত্র যোজনা’ ইত্যাদি প্রকল্প। জনসাধারণ তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে এগিয়েও এসেছেন। বর্তমানে ৪০ হাজার ৪৯২ জন মানুষ স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসে ১০ লক্ষ ৪৫ হাজার ২৬৫ জন টিবি রোগীর পুষ্টির দায়িত্ব নিয়েছেন। কিন্তু অভাব অপুষ্টিই যেখানে এই রোগের কারণ সেখানে সরকার দায়িত্ব নিচ্ছে কতটুকু? রোগীপিছু পুষ্টি বাবদ মাসে বরাদ্দ মাত্র ৫০০ টাকা। তাও বর্তমানে ভীষণ অনিয়মিত হয়ে পড়েছে।

এই রোগ নির্মূলের কথা বললেই তো কেবল হবে না, তার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো, লোকবল কোথায়? বিগত দুই দশকে মনমোহন থেকে মোদি শাসনে এই প্রকল্পে লোকবল বাড়ানো হয়নি। নিযুক্ত করা হয়েছে দেশি বিদেশি এনজিওদের। বতর্মানে শাসকদল ঘনিষ্ঠ এনজিওরা তথাকথিত অলাভজনক সংস্থার আড়ালে এই প্রকল্প থেকে কোটি কোটি টাকার মুনাফা লুটছে। নয়ছয় হচ্ছে জনগণের সরকারি তহবিলের টাকা। ফল কী দাঁড়াচ্ছে? প্রোগ্রামের গতি বৃদ্ধির পরিবর্তে নানা জটিলতায় স্থবির হয়ে পড়ছে।

কেন্দ্রীয় সরকারের সেন্ট্রাল টিবি ডিভিশনের বরাদ্দ অর্থের জোগান মাঝে মধ্যে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রোগ্রামগুলো মার খাচ্ছে ভীষণ ভাবে। ওষুধ সরবরাহ প্রায়ই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কেন্দ্র ওষুধ কেনার ব্যাপারে রাজ্যকে নির্দেশ দিয়েই খালাস। রাজ্য বলছে এ তো কেন্দ্রের প্রোগ্রাম, তারা টাকা না দিলে রাজ্য পাবে কোথায়? সমস্যার এখানেই শেষ নয়। যতটুকুও টাকা রয়েছে, ওষুধ পাওয়া যাবে কোথা থেকে? কেন্দ্রীয় সরকার ওষুধ নীতি পরিবর্তন করার ফলে ওষুধ উৎপাদনের উপর আজ আর সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে বহু ক্ষেত্রে টাকা থাকলেও ওষুধ মিলছে না। অধিক মুনাফার লোভে ওষুধ কোম্পানিগুলি এই সব ওষুধ তৈরি করছে না। বিদেশনীতিতে গলদ থাকায় এবং আমাদের দেশে এইসব ওষুধের কাঁচামাল না থাকায় বহু ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানিতে অন্তরায় সৃষ্টি হওয়ার ফলেও ওষুধ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে প্রয়োজনীয় ওষুধ সময়ে পাওয়া যাচ্ছে না। তা হলে এর উপায় কী? সরকার নিজে কি এর জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা গড়ে তুলতে পারত না? রাষ্ট্রের অধীন ওষুধ সংস্থা থেকে এইসব ওষুধ তৈরি করা যেত না, যার উপরে সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকত? না, সরকার টিবি সহ নানা রোগ নির্মূলের কথা বললেও সে পথে হাঁটছে না। বরং স্বাধীনতার পরে যতটুকু সরকারি ওষুধ শিল্প গড়ে তোলা হয়েছিল, আজ তার বেশিরভাগকেই কর্পোরেট মালিকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে বা রুগ্ন করে রাখা হয়েছে। ফলে এই সংকটজনক মুহূর্তে দেশে আজ টিবির ওষুধ অমিল হয়ে পড়েছে। এর ফল কী? অনিয়মিত ওষুধ খাওয়ার জন্য রেজিস্ট্যান্ট টিবির সংখ্যা আরও বহুগুণে বেড়ে চলেছে।

রেজিস্ট্যান্ট টিবি থেকে রোগ ছড়ানোর মাত্রা কমানোর জন্য সবচেয়ে যেটা দরকার ছিল স্যানেটোরিয়ামে রেখে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। যেখানে উপযুক্ত পুষ্টির জোগান, স্বাস্থ্যকর পরিবেশে রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা ইত্যাদি করা যেত। কিন্তু বাস্তবে দেশে আগে যত স্যানেটোরিয়াম এবং জটিল টিবি রোগীর চিকিৎসার জন্য টিবি হাসপাতাল ছিল, কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার তার বেশিরভাগই ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিয়েছে।

ফলে আজ সরকার চাইলেও এইসব রোগীদের আলাদা করে উপযুক্ত পরিবেশে উন্নত চিকিৎসা দিতে পারবে না। ১৯৭৮ সালে সরকার ঘোষণা করেছিল ২০০০-এর মধ্যে ভারত হবে টিবিমুক্ত। সরকারের উদাসীনতায় পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে তাতে ২০২৫-এর মধ্যে টিবি-মুক্তি প্রতিশ্রুতিতেই থেকে যাবে। সরকারের এই উদাসীনতা চিকিৎসার বেসরকারিকরণেরই অঙ্গ।