আকাশ দলবেরা, দেবাশীষ ঘাঁটী, লক্ষীকান্ত ঘাঁটী– আরও কত নাম। এদের আপনারা চেনেন না। চেনার কথাও নয়। এরা সব স্কুলছুট পড়ুয়া। এরা সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের প্রতিনিধি। আক্ষরিক অর্থেই পিছিয়ে পড়া, সামাজিকভাবে এবং অর্থনৈতিকভাবে। আর্থিক অনটন এদের নিত্যসঙ্গী। তবে শুধু আর্থিক অনটনের কারণেই এরা স্কুল ছাড়তে বাধ্য হয়েছে এমনটা নয়। স্কুলের পরীক্ষায় পাশ-ফেল না থাকাটা এদের জীবনে অনেকটা অভিশাপের মতো। অনেকদিন আগে পূর্বতন সিপিএম সরকার প্রাথমিকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল তুলে দিয়েছিল। সেই একই পথ অনুসরণ করে বর্তমান রাজ্য সরকার আর এক ধাপ এগিয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল তুলে দিয়েছে। এক্ষেত্রে তারা কংগ্রেস সরকার প্রবর্তিত শিক্ষার অধিকার আইন-২০০৯কে শিখণ্ডী হিসাবে খাড়া করেছে। যদিও শিক্ষা রাজ্য ও কেন্দ্রের যৌথ তালিকাভুক্ত।
একটা সময় কেন্দ্র-রাজ্য উভয় সরকার এবং তাদের তল্পিবাহক গণমাধ্যম ঢালাও প্রচার চালিয়েছে পাশ-ফেল তুলে দেওয়ার পক্ষে। অনেক যুক্তির মাঝে এই যুক্তিও তুলে ধরা হয় যে পাশ-ফেল না থাকলে স্কুলছুটের সংখ্যা কমবে। খাতায় কলমে আজও এই পরিসংখ্যান তুলে ধরার চেষ্টা চলছে। যদিও বাস্তব অভিজ্ঞতা অন্য কথা বলছে। আকাশ, দেবাশীষ, লক্ষ্মীকান্তরা স্কুল ছাড়তে একরকম বাধ্য হয়েছে পাশ-ফেল না থাকার বদান্যতায়। এরা সকলেই হুগলি জেলার খানাকুল ২ নং ব্লকের ঘোড়াদহ গ্রামের বাসিন্দা। এক বছর আগেও এরা এই গ্রামের সুধান্যচরণ হাইস্কুলের ছাত্র ছিল। শেষ কয়েক মাস যাবত এরা স্কুলে যাওয়া বন্ধ করেছে। এদের সাথে কথা বলে জানা যায় এদের স্কুলে যেতে অনীহার প্রধান কারণ এরা কেউ অষ্টম শ্রেণি, কেউ নবম শ্রেণিতে উন্নীত হলেও ঠিক মতো রিডিং পড়তে পারে না, অক্ষর পরিচয়েও ঘাটতি আছে, প্রাথমিক স্তরের যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ এরা করতে পারে না। এতে স্কুলের অন্য ছাত্রছাত্রীদের কাছে, এমনকি কখনও সখনও শিক্ষক শিক্ষিকাদের কাছে এরা হাসির পাত্র হয়। এরা একরকম হীনমন্যতায় ভোগে। পাশ-ফেল না থাকার কারণে প্রাথমিক স্তর থেকেই এরা কতটুকু শিখেছে তার সঠিক মূল্যায়ন হয়নি। এমনকি কেউ যদি অকৃতকার্য হয়ে থাকে তাহলেও তাকে পরের ক্লাসে উন্নীত করা হয়েছে সরকারি নিয়মানুসারে। তাই স্বাভাবিক নিয়মে যে ছেলেটি বা মেয়েটি প্রাথমিক স্তরের পড়া বুঝতে পারছে না, তার কাছে অষ্টম কিংবা নবম শ্রেণির পড়া বুঝে ওঠা এভারেস্ট জয় অপেক্ষাও দুরূহ বিষয় বলে মনে হচ্ছে। তাই ওরা আর কোনও অবস্থাতেই স্কুলমুখী হতে চায় না। ওদের অভিভাবকদের সহযোগিতা সত্ত্বেও, আমি এবং আমার বন্ধুরা ওদের বাড়িতে গিয়ে অনেক বুঝিয়েও ওদের স্কুলমুখী করতে পারিনি। স্কুলে যাবে না বলে একরকম ধনুকভাঙা পণ করেছে ওরা।
সরকার জামা-জুতো-মোজা, বই-খাতা, মিড ডে মিলের ব্যবস্থা করেছে, শুধু পঠন-পাঠন যাতে সঠিক ভাবে হয় সেই ব্যবস্থা করে উঠতে পারেনি। ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত কোথাও ৮০ : ১, আবার কোথাও ১০০ : ১। বেশিরভাগ স্কুলেই ছাত্রছাত্রী প্রচুর, কিন্তু আনুপাতিক হারে শিক্ষক নেই। যদিও মূলধারার গণমাধ্যমে ব্যতিক্রমী ভাবে যে দু-একটি স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা তুলনায় বেশি কিন্তু পড়ুয়া কম সেই খবরই বেশি বেশি প্রচারিত হয়। আন্দোলনের চাপে সরকার হয়তো একদিন পুনরায় পাশ-ফেল প্রথা ফিরিয়ে আনবে, ততদিনে একটা বৃহত্তর অংশের প্রান্তিক ছাত্রছাত্রী প্রকৃত শিক্ষার আলো না পেয়ে অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। তবে এর মধ্যেও একটা খুশির খবর, অনেকের সহযোগিতায় আকাশ দলবেরা নামের ছাত্রটিকে পুনরায় স্কুলে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। আকাশ কি তারা হয়ে জ্বলবে না অচিরেই অন্য তারা খসার ভিড়ে হারিয়ে যাবে?
জিশু সামন্ত
খানাকুল, হুগলি