১৯৫৯ সালের খাদ্য আন্দোলনের উপর পুলিশি অত্যাচার সরকারি মদতেই, বিধানসভায় প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন কমরেড সুবোধ ব্যানার্জী

 

১৯৫৯-এর ৩১ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গের গণআন্দোলনের ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিন। ‘খাদ্য চাই খাদ্য দাও’ এই দাবিতে সেদিন কলকাতা শহরে সমবেত হাজার হাজার মানুষের ওপর যে বর্বর অত্যাচার নামিয়ে এনেছিল তদানীন্তন কংগ্রেস সরকার, তাতে ৮০ জন আন্দোলনকারী শহিদের মৃত্যু বরণ করেন। আহত হন প্রায় তিন হাজার, নিখোঁজ হয়েছিলেন অসংখ্য মানুষ। ঘটনার সাফাই গেয়ে মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের সরকার বলেছিল, জনতাই পুলিশের ওপর আক্রমণ করেছে। প্রতিবাদে বিধানসভায় গর্জে উঠেছিলেন এসইউসিআই(সি) নেতা সুবোধ ব্যানার্জী। ১৯৫৯-এর ২৫ সেপ্টেম্বর বিধানসভায় দেওয়া তাঁর ভাষণটি গণআন্দোলনের এক মূল্যবান দলিল। সেটি প্রকাশ করা হল।

আজ ছয় দশক পর এই কংগ্রেসকেই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শক্তি হিসাবে সার্টিফিকেট দিচ্ছেন সিপিএম নেতারা। দেখা যাচ্ছে, কংগ্রেসের পর যারাই ক্ষমতায় এসেছে, তারাই একই অজুহাতে গণআন্দোলনের উপর পুলিশি অত্যাচার নামিয়ে এনেছে। সেই প্রেক্ষাপটে এই ভাষণটি ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় তুলে ধরেছে।

ডেপুটি স্পিকার মহাশয়, কংগ্রেসের পক্ষ থেকে যে প্রস্তাব এসেছে তার শুধু নলচে বদলানো নয়, সম্পুর্ণ বাদ দেওয়া দরকার। এই প্রস্তাবের পক্ষে কোনও সুবুদ্ধি-প্রণোদিত মানুষ, কোনও সাধু লোক, কোনও মানবতাসম্পন্ন লোক সায় দিতে পারে না। (কংগ্রেস বেঞ্চ থেকে এক ব্যক্তির কণ্ঠস্বরঃ চিন থেকে ভাড়া করা বুদ্ধিতে যারা চলেন তারাই শুধু পারবেন না।)

এ কথা ঠিক যে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে যাঁদের সম্পর্ক আছে তাঁরা এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করবেন। প্রস্তাবে কয়েকটি কারণ দেখানো হয়েছে। প্রথম কথা বলা হয়েছে যে, জনসাধারণের লুঠতরাজ, হিংসাত্মক কাজ বন্ধ করার জন্য পুলিশের তরফ থেকে সর্বশেষ উপায় হিসাবে অস্ত্র গ্রহণ করা হয়েছে। এত বড় মিথ্যা কথা আর নেই। এই কংগ্রেসের তরফ থেকে একজন বক্তা বললেন যে, ২০ তারিখ থেকে আরম্ভ করে ৩০ তারিখ পর্যন্ত আন্দোলন শান্তিপূর্ণ ছিল, কোনও গণ্ডগোল হয়নি। এ কথা যদি মেনে নেওয়া হয়, তা হলে জিজ্ঞাসা করি, ২৫ মে তারিখে কেন নির্মমভাবে হাওড়ায় লাঠি চালানো হয়? ২৭ তারিখে কেন বারাসাতে লাঠিচার্জ হয়? ডায়মন্ডহারবারে কেন ২৭ তারিখে লাঠি চালানো হয়? কেন ২৬ তারিখ রাতে বনগাঁয় লাঠি চালানো হয়? আদত কথা তা নয়, পুলিশ গোড়া থেকেই হিংসাত্মক কার্য আরম্ভ করেছে। জনসাধারণ কোথাও অফেন্সিভ নেয়নি, পুলিশই নিয়েছে।

ওঁরা বলেছেন, আত্মরক্ষার্থে এই অস্ত্রগ্রহণ পুলিশকে করতে হয়েছে। ডেপুটি স্পিকার মহাশয়, আপনাকে আমি জিজ্ঞাসা করি, ওই যে তিন-চার জন নারীর উপর বলাৎকার করা হয়েছে– এও কি আত্মরক্ষার জন্য? একজন আহত লোককে টালিগঞ্জ থানায় নিয়ে গিয়ে তার বুকের উপর গুলি করে তাকে মেরে ফেলে দেওয়া হল। আপনাকে জিজ্ঞাসা করি, এটাও কি আত্মরক্ষার জন্য? আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করি, ডেকার্স লেনে দুদিক থেকে পুলিশ দিয়ে আটকে মাঝখানে জনতাকে ইঁদুর মারার মতো জাঁতাকলের মধ্যে ফেলে যে মেরে ফেলা হল, এটাও কি আত্মরক্ষার জন্য? শান্তিপূর্ণ চাষিরা যখন ডায়মন্ডহারবারে মিটিং করছিল তখন তাদের উপর লাঠি চালিয়ে ৩১ জন চাষিকে গুরুতর আহত করা হল, এটাও কি ওই আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজন হয়েছিল? আদত কথা তা নয়। সরকারের এটাই নীতি ছিল এবং পুলিশ সেই নীতি অনুসরণ করেছে। সেই নীতি ছিল এই, যেখানেই জনতাকে দেখবে তাদের মেরে ঠাণ্ডা করে দেবে, যাতে ভবিষ্যতে আর আন্দোলন করতে না পারে। এই জন্যই পুলিশ এ রকম কাজ করেছে। আপনাকে আমি জিজ্ঞাসা করি, বাড়ি থেকে ধরে টেনে নিয়ে গেছে থানায়, সেখানে দুই হাত বেঁধে ইংরেজ আমলে যেমন ঝুলিয়ে মারত তেমনি করে মারা হয়েছে কোন কারণে? এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ চাইলে আমি দিতে পারব। একটা নয়, এ রকম অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। আপনাকে জিজ্ঞাসা করি এও কি আত্মরক্ষার জন্য করতে হয়েছে? গণ্ডগোল যদি কোনও জায়গায় হয় সেখানে না হয় লাঠি চালাতে পারে কিন্তু থানায় নিয়ে গিয়ে একজন মানুষকে নির্মম ভাবে মারা, এটা কি আত্মরক্ষার জন্য?

শ্রীযুক্ত আনন্দগোপাল মুখার্জীঃ শ্রীযুক্তা সুধা দত্তের উপর পায়ের জুতা ছুঁড়ে মারা হয়েছিল কী ভাবে?

শ্রীযুক্ত সুবোধ ব্যানার্জীঃ হ্যাঁ আমিও ঠিক তাই বলছি। শ্রীযুক্তা সুধা দত্তকে যদি আলাদা করে নিয়ে কেউ জুতো মারত, তা হলে প্রশ্ন আসত ইন্টেনশনালি মারা হয়েছে। কিন্তু ভিড়ের মধ্যে শ্রীযুক্তা দত্তকে মারা, সেটাকে ইন্টেনশনালি মারা বলা যায় না। আমার প্রশ্ন, তাই ভিড়ের মধ্যে যদি কাউকে মারা হয়, তা হলে ইন্টেনশনালি মারা হয়নি। কিন্তু বাড়ি থেকে টেনে নিয়ে গিয়ে থানার মধ্যে আটকে মারা এটা নির্মমভাবে ইন্টেনশনালি মারা। তাকে বলব উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মারা। আইন আছে নাকি কোথাও যে, থানায় ধরে নিয়ে গিয়ে বেপরোয়া মারা চলবে? বলা হয়েছে, জনসাধারণ অফেন্সিভ নিয়েছে, লজ্জা করা উচিত। কিন্তু লজ্জা ওঁদের নেই, ওঁদের লজ্জা দিতে গেলে আমাদেরই লজ্জায় মাথা হেঁট হবে। যার দুই কান কাটা সে গ্রামের মধ্যে দিয়েই যাবে, এদের লজ্জা দিতে যাওয়া ভুল। কিন্তু শুধু একটা জিনিস জিজ্ঞাসা করব যে, জনসাধারণের হাতে কিছুই নেই, আর আপনার হাতে গভর্নমেন্টের পুলিশ, সশস্ত্র সৈন্য, আইনকানুন অর্থাৎ রিপ্রেশনের সমস্ত অস্ত্র। একদিকে রাষ্ট্রশক্তি যা দমনে লাগে, আর একদিকে নিরস্ত্র জনসাধারণ। জনসাধারণের কী আছে? ধরে নিলাম জনতার হাতে অস্ত্র আছে। তা কী? বড়জোর একখানা ইট। আর পুলিশের হাতে সৈন্য, বন্দুক, যা কিছু মিনস অফ রিপ্রেশন তাদের হাতে, তবুও এ কথা বলছেন। এ কথা তাঁরাই বলবেন, যাঁরা পুঁজিবাদীদের় পা-চাটা দালাল, তাদের মুখেই এ কথা শোভা পায়, তা ছাড়া আর কেউ এ কথা বলতে পারে না। কথায় কথায় বলা হচ্ছে, জনসাধারণ অ্যাম্বুলেন্স পুড়িয়েছে, জনসাধারণ থানা আক্রমণ করেছে। একটা পিঁপড়েকে অত্যাচার করলে সেও কামড়িয়ে দেয়, আর এ তো মানুষ। তাঁদের উপর অত্যাচার করেছেন, তাঁদের চোখের উপর পাশবিক অত্যাচার করেছেন, চোখের উপর ছেলেকে গুলি করে মারছেন, চোখের উপর থেকে আত্মীয়স্বজনকে ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, আর তাঁরা নীরবে দাঁড়িয়ে দেখবেন? প্রতিবাদ করবেন না? আমি বলব এই রকম মানুষ যেন না জন্মায়। সে মানুষ মানুষ নয়, সে পশু। মানুষের সঙ্গে পশুর পার্থক্য, পশু খাদ্য খায় দায়, ঘুমায়, অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় না, মানুষ অত্যাচারের প্রতিবাদ করে। সে আত্মবিসর্জনও দিয়ে থাকে। এ আপনারা বড় করে দেখছেন যে, একটা অ্যাম্বুলেন্স পুড়িয়েছে। আপনারা ইকুয়েট করেছেন একদিকে ৮০ জন লোক মরেছে, তিন হাজার আহত হয়েছে, বহু লোক নিখোঁজ হয়েছে। আর একদিকে একজন কনস্টেবল মারা গিয়েছেন বলে চিৎকার করছেন। এইভাবে ইকুয়েট করতে আপনাদের লজ্জা করে না? আমি এই কথা বলব যে, প্রত্যেকটি বড় আন্দোলনে এই জিনিস একটু আধটু ঘটে থাকে। যাঁরা স্বদেশি আন্দোলন করেছেন তাঁরা জানেন, আপনারা না জানতে পারেন। কারণ আপনারা সবাই তো পোস্ট ১৯৪৭ পিরিয়ডের, আপনাদের জানবার কথা নয়। ইংরেজের পা চেটে চেটে যারা এসেছে তারাই আজ সাদা টুপি, গান্ধী টুপি মাথায় দিয়ে এখানে বসে আছেন। কিন্তু যাঁরা কংগ্রেসের আন্দোলন করেছেন তাঁদের জিজ্ঞাসা করি, বড় আন্দোলনে কি এই জিনিস একটু আধটু ঘটেনি। সেদিনকার যিনি নেতা ছিলেন, আজকে মন্ত্রিসভার মধ্যে একজন শক্তিশালী লোক বলে শুনেছি, তাঁকে জিজ্ঞাসা করি যে, এই জিনিস কি সেখানে কিছু হয়নি? কিন্তু তবুও লোকে এই স্বাধীনতা আন্দোলনকে নিন্দা করবে? জিজ্ঞাসা করি আগস্ট আন্দোলনে কি টেলিগ্রাফের তার ছেঁড়া হয়নি, আগস্ট আন্দোলনে থানা জ্বালানো হয়নি? তাই বলে কি লোকে আগস্ট আন্দোলনের নিন্দা করতে যাবে? আগস্ট আন্দোলনে পোস্ট অফিস পোড়ানো হয়েছে, অ্যাম্বুলেন্স পুড়েছে, কিন্তু তাই বলে কি লোকে আগস্ট আন্দোলনের নিন্দা করতে যাবে? নিন্দা তাঁরাই করবেন যাঁরা একদিন সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন, সাম্রাজ্যবাদীদের পা চেটেছেন। ঠিক আজ তেমনি তারাই এইসব কথা বলে জনসাধারণের নিন্দা করেছেন।

এরা পুঁজিপতি সমাজব্যবস্থার ওয়াচ ডগ, ওয়াচ ডগ অফ দি ক্যাপিটালিস্ট। এরা চায় শান্তিশৃঙ্খলার নামে শোষণ ব্যবস্থাকে অব্যাহত গতিতে চালাতে। শান্তি ও শৃঙ্খলার নামে পুলিশ জনতার উপর নির্মম অত্যাচার করবে, এই জিনিস চলতে পারে না। তাই আমরা বলছি যে, সরকার এবং পুলিশই এর জন্য সম্পূর্ণ দায়ী। তাদের আমি তীব্র নিন্দা করছি। এবং আমরা চাই যে যাঁরা আজও জেলের মধ্যে আছেন, যে কোনও অভিযোগেই হোক, তাঁদের মুক্তি দিন। আপনারা কি জানেন না যে, পুলিশ মিথ্যা অভিযোগ দেয়? এ কথা সকলেই জানে যে,পুলিশ মিথ্যা অভিযোগ দেয় সাধারণ মানুষের নামে। যারা হাজতে আছে তারা ওই থানা-পুলিশ করতে করতে ক্লান্তির একশেষ হয়ে যায়। অমরবাবুর নামে স্যার, অ্যাটেম্পট টু মার্ডার চার্জ, থেপ্ট অফ গভর্নমেন্ট প্রপার্টি। আমাদের দলের নেতা– তাকেও অ্যাটেম্পট টু মার্ডার চার্জ দিয়েছে। এই অভিযোগ দিয়েছে কারা? কালীবাবুর পোষ্যপুত্র সরকারের রক্ষীদল, ইংরেজ আমলে জনতার রক্তে যাদের হাত কলঙ্কিত, সেই সব আইপিএসের দল। এরা যা বলবে, তাই সত্য হয়ে উঠবে, তাই বিশ্বাস করে নিতে হবে জনতাকে? এই পুলিশি ব্যবস্থায় যে অভিযোগই হোক না কেন, এদের ছেড়ে দিতে হবে, তবেই কথাবার্তা চলবে। তাই সংশোধনী প্রস্তাবে আমি বলেছি জুডিশিয়াল কমিশন বসুক। জনসাধারণের দাবি মেনে পাবলিক এনকোয়ারি মারফত দেখানো হোক মন্ত্রীমণ্ডলীর, ক্যাবিনেটের কত দোষ, বিশেষ করে মুখ্যমন্ত্রী, পুলিশমন্ত্রী, চিফ সেক্রেটারি কতখানি দায়ী এবং যে দায়ী তার শাস্তি বিধান হোক। আর যাঁরা নিহত হয়েছেন তাঁদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হোক। এবং কত লোক মরেছে, কত নিহত হয়েছে, কত লোক নিখোঁজ হয়েছে, তার সংখ্যা নিরূপণ করার সর্বাঙ্গীণ ব্যবস্থা করা হোক। এই দাবি করে কংগ্রেসের তরফ থেকে যে প্রস্তাব আনা হয়েছে তাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে আমাদের দাবি আপনার সামনে আমি উপস্থিত করছি।