সালটা ১৯৮৯। জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় চান্স পেয়ে ভর্তি হতে গেছি কলকাতা মেডিকেল কলেজে। ক্যাশ কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে একটা একশো টাকার নোট ঠোঁটে চেপে ধরে সবে টাকা জমা করার স্লিপটা পূরণ করছি। হঠাৎ পেছন থেকে লম্বা চেহারার একজন এসে আমাকে মৃদু ভৎর্সনা করে বললেন, ‘এই দেখো কাণ্ড, টাকা কেউ মুখে দেয়’! হকচকিয়ে গেলাম। আবার কেমন যেন একটা অনুভূতি জাগলো, মনে হল উনি যেন কতদিনের চেনা, কত আপনার জন, কাছের মানুষ। পরে যখন জানতে পারলাম উনি মেডিকেল কলেজেরই ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র, মনটা কেমন হালকা হয়ে গেল। আগে শুনেছি, মেডিকেল কলেজে, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে নবাগতদের স্মার্ট করা, নতুন পরিবেশের উপযুক্ত করে তোলার নামে ব়্যাগিং করা হয়, যা কিছু ক্ষেত্রে শারীরিক নির্যাতনের পর্যায়েও গিয়ে পৌঁছয়। ওই দাদার ব্যবহারে তো তার উল্টো রীতিই ফুটে উঠল! পরে আস্তে আস্তে উনি ওই রকমই আরও অনেক দাদার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তাঁরা কেউ আমার হোস্টেলের ঘর ঠিক করে দিলেন। কেউ বইপত্র সব জোগাড় করে দিলেন। যে সাহায্যগুলো না পেলে আমার মতো হতদরিদ্র পরিবারের এক ছাত্রের পক্ষে মেডিকেল কলেজের পড়া চালিয়ে যাওয়া কোনও ভাবেই সে সময় সম্ভব হত না।
সেদিন তাঁরা বড় মানুষদের জীবন সংগ্রামের কথা শোনাতেন। ‘হত্যা ও ব্যাভিচারে ভরা এই পৃথিবীতে, প্রতিবাদহীন কণ্ঠে আমি বাঁচতে চাই না’– আন্তর্জাতিকতাবাদী চিকিৎসক ডাঃ নর্মান বেথুনের এই কথা তাঁদের কাছেই আমি প্রথম শুনি। তাঁরা বলতেন, বিজ্ঞানী, পথিকৃৎ চিকিৎসকদের সত্যানুসন্ধানের কাহিনী। এসব কথা শুনতে শুনতে কখন যে রাত ভোর হয়ে যেত, বুঝতেই পারতাম না। ওই সব দাদাদের তত্ত্বাবধানে কলেজে, হোস্টেলে বিদ্যাসাগর থেকে শরৎচন্দ্র, ক্ষুদিরাম থেকে নেতাজি সবার জন্মদিন, মৃত্যুদিন আমরা পালন করেছি।
সেদিন অনেকে বলেছেন, ডাক্তারি পড়তে এসে আবার এ সব কী! কিন্তু পড়াশুনার ঘাটতি তো কিছু ছিল না। পিছিয়ে পড়লে দাদারা, কলেজের শিক্ষকরা সন্ধে্যবেলায়, এমনকি রাত জেগেও আমাদের অ্যানাটমি থেকে সার্জারি সবই হাতে ধরে শিখিয়েও দিয়েছেন। তার জন্যেই হয়ত আজ আমাদের সমসাময়িক অনেকেই দেশে এবং বিদেশে প্রথিতযশা চিকিৎসক হয়েও চিকিৎসা পেশাকে বিকিয়ে দেননি। চিকিৎসা বিজ্ঞানকে মুনাফা অর্জনের স্বার্থে ব্যবহার না করে মানবকল্যাণে প্রয়োগ করে চলেছেন। মেডিকেল এথিক্সের পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে রেখেছেন।
পরে বুঝেছি, ওই দাদারা এআইডিএসও সংগঠনের সাথে যুক্ত। সুনির্দিষ্ট ও উন্নত মতাদর্শ ছিল বলেই টাকা রোজগারের হাজারো পথ খোলা থাকা সত্ত্বেও, তাঁরা কখনও মেডিকেল এথিক্সের পতাকাকে ভুলুন্ঠিত হতে দেননি। আমরাও অনেকেই তাঁদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েছি সেদিন। তারপর কত ব্যাচ এল গেল। আমরাও চেষ্টা করেছি দাদাদের দেখানো পথে জুনিয়রদের সাথে স্নেহভরা ব্যবহার করতে। বড় মানুষদের জীবনসংগ্রামকে তাদের সামনে তুলে ধরতে।
পাশ করার প্রায় দু’দশক বাদে মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে গিয়ে খানিকটা হতবাকই হয়েছিলাম। সেই চেনা পরিবেশ, সেই চেনা সংস্কৃতির ছাপ আজ যেন কোথায় ম্লান হয়ে গেছে! আজ নির্বাচন না থাকলেও কলেজ জুড়ে হোস্টেল দখলের রাজনীতি রয়েছে। দাদাগিরিও আছে। তাকে কেন্দ্র করে দুই গোষ্ঠীর মারদাঙ্গার ঘটনাও প্রায়ই শোনা যায়। প্রায়ই শোনা যায় আত্মহত্যার কথা। আর শোনা যায় কলকাতা মেডিকেল কলেজ সহ বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে একদল ছাত্র যখন ক্ষুদিরামের শহিদ দিবস কিংবা বিদ্যাসাগরের জন্মদিন পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তাদের উপর প্রশাসনের ফতোয়া নেমে আসছে এবং শাসকদলের মদতপুষ্ট আরেক দল মেডিকেল ছাত্র তাদের উপর চড়াও হচ্ছে। যদিও আজও ছাত্ররা, জুনিয়র ডাক্তাররা মেডিকেল সার্ভিস সেন্টারের মতো সংগঠনের ডাকে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপন্ন মানুষদের সাহায্যের জন্য মেডিকেল টিম তৈরির প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু তাদের এই কাজকে আটকানোর জন্য শাসক দলের নির্দেশে এখন প্রশাসন ফতোয়া জারি করে। আমাদের সময় সিনিয়ররা এবং শিক্ষকরা এ কাজে ওষুধ দিয়ে, টাকা দিয়ে টিমকে সাজিয়ে দিতেন। আজ হাতে গোনা কিছুজন মাত্র সে কাজে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। যুক্তির জায়গা দখল করেছে গায়ের জোরের রাজনীতি। কলেজে কলেজে মদ, গাঁজা, জুয়া, ব্লু-ফিল্মের অধঃপতিত সংস্কৃতি মাথা তুলছে। তার বলি হচ্ছে ছাত্রছাত্রীরা। মানবিকতার স্বার্থে একে হঠাতে হবে। আবারও ফেরাতে হবে বিদ্যাসাগর, ক্ষুদিরাম, শরৎচন্দ্র, নেতাজিদের চর্চা, যুক্তিবাদের সংস্কৃতি।
ডাঃ সজল বিশ্বাস, উত্তর ২৪ পরগণা