‘‘সমাজতান্ত্রিক ভাবনা সম্পর্কে ইতিহাসের এই নতুন বোধের (মার্ক্সবাদী দৃষ্টিভঙ্গির–গণদাবী) তাৎপর্য খুবই বেশি। তা দেখিয়ে দিল যে, আগেকার সব ইতিহাস শ্রেণি-বিরোধ ও শ্রেণি-সংগ্রামের মাধ্যমে এগিয়েছে, চিরকালই শাসক ও শাসিত শ্রেণি, শোষক ও শোষিত শ্রেণি থেকেছে, আর বরাবরই মানবসমাজের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই দণ্ডিত থেকেছে হাড়ভাঙা মেহনত ও নগণ্য উপভোগের বাধ্যতায়। এর কারণ কী? কারণ নিতান্তই এই যে, মানবজাতির বিকাশের আগেকার সব স্তরে উৎপাদন এতই অনুন্নত ছিল যে, একমাত্র বিরোধাত্মক দ্বন্দ্বের রূপেই ঐতিহাসিক বিকাশ চলতে পারত, আর সামগ্রিকভাবে ঐতিহাসিক প্রগতির ভার থাকত এক ক্ষুদ্র সুবিধাভোগী সংখ্যালঘুর ক্রিয়াকলাপের ওপর, আর বিপুল জনগণের জন্য নির্দিষ্ট ছিল স্বীয় মেহনতে নিজেদের দীনহীন জীবনোপকরণের সঙ্গে সঙ্গে সুবিধাভোগীদের জন্য ঐশ্বর্য ক্রমবর্ধমান হারে উৎপন্ন করে চলা। অন্যথায় পূর্বতন সব শ্রেণি-শাসনের ব্যাখ্যা কেবল মানুষের অসাধুতা দিয়েই করতে হয়।
নতুন এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়ে তার স্বাভাবিক ও যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা পাওয়া ছাড়াও ইতিহাসের এই অনুসন্ধানের ফলে স্পষ্ট হয়ে উঠল যে, বর্তমান যুগের উৎপাদন-শক্তিসমূহ এত বিপুলভাবে বেড়ে উঠেছে যে, অন্ততপক্ষে সবচেয়ে উন্নত দেশগুলিতে, মানবসমাজকে শাসক ও শাসিত হিসেবে, শোষক ও শোষিত হিসেবে বিভক্ত করে রাখার শেষ অজুহাতটিও আর থাকে না, স্পষ্ট হয়ে উঠল যে, শাসক বৃহৎ বুর্জোয়া শ্রেণি তার ঐতিহাসিক কর্তব্য সম্পন্ন করে ফেলেছে। সমাজের নেতৃত্বের ক্ষমতা তার আর নেই, উৎপাদনের বিকাশের পথে সে বরং বাধাই হয়ে দাঁড়িয়েছে, বাণিজ্য সংকট, বিশেষত গত বিরাট বিপর্যয় (১৮৭৩-এর বিশ্বব্যাপী আর্থিক বিপর্যয়) এবং সব দেশে শিল্পের মন্দা সে কথা প্রমাণ করে দিয়েছে। স্পষ্ট হয়েছে যে, ঐতিহাসিক নেতৃত্ব চলে এসেছে প্রলেতারিয়েতের হাতে, সমাজে এ শ্রেণির সামগ্রিক অবস্থার দরুন এ শ্রেণি নিজেকে মুক্ত করতে পারে কেবল সব শ্রেণি-শাসন, সব দাসত্ব ও সব শোষণ পুরোপরি শেষ করে দিয়ে। সামাজিক উৎপাদন-শক্তিসমূহের উপর বুর্জোয়া শ্রেণির নিয়ন্ত্রণ তার সময় অতিক্রম করে এখন শুধু সংঘবদ্ধ প্রলেতারিয়েতের দখলে যাবার জন্যই অপেক্ষা করে আছে। উদ্দেশ্য, যাতে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা যায় যেখানে সমাজের প্রতিটি সদস্য শুধু, সামাজিক সম্পদ উৎপাদনের কাজেই নয়, সে সম্পদ বণ্টন ও পরিচালনার কাজেও অংশ নিতে পারবে। ফলে পুরো উৎপাদন- ব্যবস্থার পরিকল্পিত পরিচালনার ফলে সামাজিক উৎপাদন-শক্তিগুলি ও তার উৎপাদন এত বেড়ে যাবে যে, প্রত্যেকের জন্যই সমস্ত যুক্তিসঙ্গত প্রয়োজন ক্রমবর্ধমান মাত্রায় মেটানোর বিষয়টি নিশ্চিত করা যাবে।” –‘কার্ল মার্ক্স প্রসঙ্গে’