অতীতের পথে হেঁটে এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনের সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে পেশির জোরে বুথ দখল, ব্যালট ছিনতাই, বোমা-গুলির অবিরাম বর্ষণে রক্তে ভিজে যাওয়া মাটির আঁশটে গন্ধ আর স্বজনহারাদের বুকফাটা আর্তনাদ। মানুষ আকুল হয়ে ভাবছে, গণতন্তে্রর নামে এই বন্য বর্বরতার কি শেষ হবে না!
গভীর এই অন্ধকারেও পশ্চিমবঙ্গের একাধিক জেলার কিছু ঘটনা কিন্তু আশার আলো দেখিয়ে যায়। বলে যায়, মানুষের শুভবুদ্ধির উপর বিশ্বাস হারাতে নেই। যত শক্তিশালীই হোক, অনৈতিকতার উপর ভর করে দাঁড়িয়ে থাকা শাসকদল-আশ্রিত দুষ্কৃতীদের তাণ্ডব আর দলদাস পুলিশ-প্রশাসনের নীতিহীন আনুগত্যই শেষ কথা নয়। সঠিক নেতৃত্বে সাধারণ মানুষ যদি একজোট হয়, তাকে পদানত করার ক্ষমতা কারও নেই।
যেমন, মুর্শিদাবাদে সুতির অরঙ্গাবাদের একটি বুথের কথাই ধরা যাক। গ্রামসভার নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন এস ইউ সি আই (সি)-র আয়েশা বিবি। বহু দিন ধরে দলের কাজকর্ম দেখে এলাকার মানুষ এবার তাঁকেই ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। প্রচারপর্বের শেষের দিকে অন্য দলের কাছেও সে বার্তা বোধহয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। তাতেই দুষ্কৃতীরা তৎপর হয়ে ওঠে। প্রস্তুতি নিতে থাকে তাণ্ডব চালিয়ে ভোট লুটের। আর এ সংবাদ পাওয়ামাত্র শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে যান গোটা গ্রামের মানুষ। যে ভাবেই হোক ভোট-লুট আটকাতে হবে। ভোটের দিন এস ইউ সি আই (সি)-র নেতৃত্বে তৈরি হয়েই ছিলেন তাঁরা। সচেতন ছিল মহিলা-বাহিনী। দুষ্কৃতী হামলা হলে প্রথমে আটকাবেন তাঁরাই। নারী-বাহিনীর পিছনে খাড়া পাহাড়ের মতো প্রতিরোধ গড়ে সতর্ক পাহারায় ছিলেন গ্রামের বলিষ্ঠ তরুণ-যুবকদের দল।
সম্মিলিত প্রতিরোধের দৃঢ় প্রতিজ্ঞার খবর চলে গিয়েছিল ঠিক জায়গায়। ফলে সেদিন নির্বিঘ্নে মিটে যায় ভোটপর্ব। এলাকার মানুষের বিপুল সমর্থনে গ্রামসভাটিতে জয়ী হন এস ইউ সি আই (সি) প্রার্থী আয়েশা বিবি।
মুর্শিদাবাদেই বহরমপুর ব্লকের লোকপুর গ্রাম। সেখানে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী ও তার এজেন্ট ভোট প্রভাবিত করার চেষ্টা করলে সাধারণ মানুষই তা রুখে দেন। এমন সময় খবর আসে পাশের গ্রামগুলিতে ভোট লুটে নেমে পড়েছে দুষ্কৃতীরা। চালাচ্ছে যথেচ্ছ রিগিং, ছাপ্পা। লোকপুরে শাসক দলের নেতারা ফোন করে গুণ্ডাবাহিনীকে গ্রামে ডাকতে থাকে। জানতে পেরে চুপ করে বসে থাকেননি এস ইউ সি আই (সি)-র স্থানীয় সংগঠকরা। ভোটলুট প্রতিরোধে সাধারণ মানুষ সহ বিরোধী দলের কর্মীদের সক্রিয় হতে আহ্বান জানান তাঁরা। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ একজোট হয়ে বুথের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে যান। ঘোষণা করেন, বাইরে থেকে কোনও গুন্ডাবাহিনীকে গ্রামে ঢুকতে দেওয়া হবে না। নাগরিক প্রতিরোধের বলিষ্ঠ চেহারা দেখে পিছিয়ে যায় দুষ্কৃতীরা। নির্বিঘ্নে শেষ হয় ভোট।
মানুষের শুভবুদ্ধির জয়ের এমনই একটি ছবি দেখা গেছে পশ্চিম মেদিনীপুরের নারায়ণগড়েও। সেখানকার কুশবসান পঞ্চায়েতের ডাঙ্গরপাড়া গ্রামসভায় দীর্ঘ দিন ধরে জিতে আসছে এস ইউ সি আই (সি)। সিপিএম-ফ্রন্ট আমলে যেমন, তেমনই তৃণমূল কংগ্রেসের আমলেও জয়ী হয়েছেন এস ইউ সি আই (সি) প্রার্থী। এবারের ভোটে যে কোনও মূল্যে এস ইউ সি আই (সি)-কে আটকাতে প্রার্থী জ্যোৎস্না মণ্ডলের বিরুদ্ধে জোট বেঁধেছিল তৃণমূল-বিজেপির সঙ্গে সিপিএম-ও। মুখে একে অপরের বিরুদ্ধে আগুন-ঝরা স্লোগান দিলেও ‘জনগণের জোট’ নাম দিয়ে এই তিনটি দল একযোগে এক নির্দল প্রার্থীকে দাঁড় করিয়ে দেয়। কিন্তু এলাকার জনগণ যে নিজেদের প্রতিনিধি হিসাবে এস ইউ সি আই (সি)-র প্রার্থীর উপরেই আস্থা রেখেছিলেন, ভোটের ফলে তা স্পষ্ট হয়ে যায়। তৃণমূল, বিজেপি ও সিপিএমের পারস্পরিক বিষ-উদগীরণ যে নিতান্তই লোক-দেখানো, ডাঙ্গরপাড়া গ্রামসভার নির্বাচনে স্পষ্ট হয়ে যায় তা-ও। গ্রামের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরে এই গ্রামসভায় এস ইউ সি আই (সি) সদস্যদের দক্ষ ও স্বচ্ছ কার্যকলাপ এবং নীতিনিষ্ঠ আচরণ দেখে আসছেন এলাকার মানুষ। তাই তাঁরা সমর্থন করেছেন এই দলটিকেই। এর বিরুদ্ধে ওই তিন ভোটবাজ দলের অশুভ জোটকে প্রত্যাখ্যান করেছেন তাঁরা।
দক্ষিণ ২৪ পরগণায় কুলতলীর মেরিগঞ্জ-১ অঞ্চলে তৃণমূল দুষ্কৃতীরা ভোটের দিন গুলি চালিয়ে ভোটারদের সন্ত্রস্ত করতে চেয়েছিল। প্রতিরোধ করতে গিয়ে ১১ জন এস ইউ সি আই (সি) কর্মী গুলিবিদ্ধ হন। এর পরেও রুখে দাঁড়িয়ে এলাকার মানুষকে পাশে নিয়ে লড়েছেন দলের কর্মীরা। ভোট লুট যতটা আটকানো গেছে তাতেই ছ’টি গ্রামসভা এবং একটি পঞ্চায়েত সমিতির আসনে জয়ী হন এস ইউ সি আই (সি) প্রার্থীরা।
পূর্ব মেদিনীপুরের বল্লুক-১ অঞ্চলেও বিজেপি-সিপিএম-তৃণমূলের ঘোষিত-অঘোষিত জোট সত্ত্বেও এস ইউ সি আই (সি) প্রার্থীরা পাঁচটি আসনে জয়ী হন। বেশ কয়েকটি আসনে জয়ী প্রার্থীর সঙ্গে এস ইউ সি আই (সি) প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান মাত্র তিন বা চার। এবারের পঞ্চায়েত ভোটে জেলায় জেলায় প্রতিরোধের এমন বহু ঘটনার সাক্ষী রাজ্যের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ।
এমন ভাবেই এ বারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজ্যজোড়া সন্ত্রাস ও গণতন্ত্রহীনতার অন্ধকারে এখানে ওখানে মাথা তুলেছে আলোর নিশানা। অন্যায় দাপটের সামনে মাথা না ঝোঁকানোর দৃঢ়পণে যেখানেই সঠিক নেতৃত্বে জোট বেঁধেছেন মানুষ, সেখানেই ব্যর্থ হয়েছে ভোট লুটের ষড়যন্ত্র।