Breaking News

ডাক্তারি ছাত্রদের উপর নতুন ফতোয়া ‘নেক্সট’, ছাত্র আন্দোলনের চাপে মন্ত্রীর সুর বদল

সাধারণ মানুষ অসুখে পড়লে আজও এমন ডাক্তার খোঁজেন যিনি ক্লিনিক্যাল সেন্স প্রয়োগ করে রোগ ধরতে পারেন এবং কম খরচে চিকিৎসা করতে পারেন। দুঃখের বিষয় হল, আজ আমাদের দেশের যারা ডাক্তারি শিক্ষার (এমবিবিএস) নিয়ম কানুন তৈরি করেন তারা আজ এই আশাকে দুরাশায় পরিণত করতে উদ্যত।

এই মোদি জমানায় আগেকার মেডিকেল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়াকে তুলে দিয়ে তারা চালু করেছেন কেন্দ্রীয় সরকারের মনোনীত লোকেদের নিয়ে তৈরি সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক একটি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল মেডিকেল কমিশন (এনএমসি)। এনএমসি বলেছে, মেডিকেল গ্র্যাজুয়েটকে আগেকার এমবিবিএসদের মতো অত কিছু না জানলেও চলবে, তাদের হতে হবে ‘বেসিক ডক্টর’। তাই তারা এমবিবিএস সিলেবাস পরিবর্তন করেছে, যেখানে কমপিটেন্সি বেসড মেডিকেল এডুকেশন (সিবিএমই) এর নামে ছাত্রদের ক্লিনিক্যাল স্কিল গড়ে তোলার প্রক্রিয়া সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে দিয়েছে। এই একই সময়ে, মেডিকেল কলেজ চালু করার শর্তকে লঘু করে দিয়ে এনএমসি একদিকে পরিকাঠামোহীন জেলা হাসপাতালগুলিকে মেডিকেল কলেজের তকমা দিয়েছে। অন্যদিকে পরিকাঠামোহীন বেসরকারি মেডিকেল কলেজ খুলে মালিকদের কোটি কোটি টাকা লাভ করার রাস্তা দরাজ হতে খুলে দিয়েছে। এই বিরাট পরিবর্তনগুলি কোনওটাই দেশের নামকরা ডাক্তার বা চিকিৎসক-শিক্ষকদের মতামত নিয়ে করা হয়নি। একতরফা ভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে মাত্র।

এক বছর ধরে এনএমসি-র এই সিদ্ধান্তগুলোর বিরুদ্ধে এআইডিএসও টানা প্রচার চালালেও বেশিরভাগ মেডিকেল ছাত্রছাত্রীরা বিষয়টি তখনও বুঝতে পারেননি। এমবিবিএস শিক্ষায় ছাত্রছাত্রীদের সাড়ে চার বছরে ৯টি ইন্টার্নাল পরীক্ষা, ৪টি ইউনিভার্সিটি পরীক্ষা এবং অসংখ্য ক্লাস টেস্ট দিতে হয়। অন্তিম বর্ষের এমবিবিএস ছাত্রদের মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি এবং পেডিয়াট্রিক মেডিসিন পড়তে হয় এবং সারা বছর ধরে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির থিওরি এবং প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাস হয়। এতদিন সন্ধেবেলা ওয়ার্ডে গিয়ে পেশেন্ট দেখে শেখারও দরকার হয়। সমস্ত পরীক্ষার পরে এক বছর ইন্টার্নশিপ করে তবে ডাক্তার হিসাবে স্বীকৃতি মেলে। এমডি, এমএস ইত্যাদি করতে চাইলে নিট-পিজি পরীক্ষা এবং বিদেশ থেকে পাশ করে এলে এফএমডিই পরীক্ষা দিতে হত এত দিন।

এনএমসি কর্তারা সম্প্রতি (২৭ জুন) দাওয়াই দিলেন, এই ফাইনাল এমবিবিএস পরীক্ষা, নিট-পিজি এবং এফএমজিই পরীক্ষা এই তিনটে পরীক্ষার জায়গায় তারা এখন একটি পরীক্ষা নেবেন। যার গালভরা নাম হল ন্যাশনাল এক্সিট টেস্ট অর্থাৎ নেক্সট। এখন এই একটি পরীক্ষা দিয়ে তারা তিনটে কাজ সারবেন। ফলে, এমবিবিএস কোর্সের অন্তিম বর্ষের ছাত্রদের এবার ফাইনাল এমবিবিএস পরীক্ষার বদলে বসতে হবে ন্যাশনাল এক্সিট টেস্ট (নেক্সট)-১ এ। এই পরীক্ষা পাস করলে ১ বছর ইন্টার্নশিপ শেষ করার পর আবার নেক্সট-২ পরীক্ষায় পাশ করলে তবেই একজন মেডিকেল ছাত্র ডাক্তার হিসাবে স্বীকৃতি পাবেন।

এখন যারা দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ফাইনাল ইয়ারে পড়ছেন, তাদের আগামী ছয় থেকে আট মাসের মধ্যে এই নেক্সট পরীক্ষাটিতে বসতে হবে। এনএমসি-র এই নতুন পরীক্ষায় ছাত্রদের পড়তে হবে চারটি বিষয়ের বদলে ১৯টি বিষয় এবং পরীক্ষা হবে মাল্টিপল চয়েজ কোয়েশ্চেন অনুযায়ী।

এই ঘোষণামাত্র একদিকে যেমন ছাত্ররা ক্ষোভে ফেটে পড়ছে, অন্য দিকে প্রাইভেট কোচিং সেন্টারগুলি ঝাঁপিয়ে পড়ছে যেন তারা তৈরি হয়েই ছিল এর অপেক্ষায়। এই মুহূর্তে কোনও মেডিকেল কলেজের শিক্ষক জানেন না নে’ট পরীক্ষার প্রশ্নের ধরন কেমন হবে? ফলে হাওয়া উঠেছে পাস করতে হলে আর কলেজে এসে লাভ নেই। কিন্তু প্রাইভেট কোচিং সেন্টারগুলি বুক ফুলিয়ে বলছে আমাদের কাছে নেক্সট পরীক্ষা পাশের চাবিকাঠি আছে। ফলে হাজার হাজার টাকা দিয়ে দলে দলে মেডিকেল ছাত্রছাত্রী অনলাইন কোচিং এর দ্বারস্থ হতে বাধ্য হচ্ছে। কলেজের ক্লাসরুম এবং ক্লিনিক্যাল ক্লাসগুলি খাঁ খাঁ করছে।

তাহলে কি কোচিং সেন্টারগুলির সঙ্গে যোগসাজসে এই পরীক্ষা চাপিয়ে দেওয়া হল? প্রশ্ন উঠেছে, একই পরীক্ষা কেমন করে পাশ করার এবং Rank করার জন্য হতে পারে? দুটির প্রশ্নের ধরন তো আলাদা হওয়ার কথা। এমনিতেই ডাক্তারি ছাত্রদের মধ্যে মানসিক অবসাদ এবং তার পরিণতিতে আত্মহত্যা ক্রমবর্ধমান। তার মধ্যে এমন চাপ তৈরি করে ছাত্রদের উপর মানসিক চাপ আরও বাড়ানো হল না?

কোচিং-এ এমসিকিউ মুখস্ত করে ডাক্তারি ছাত্ররা হয়তো পরীক্ষা বৈতরণী উৎরে যাবেন, কিন্তু রোগীর থেকে দূরে বসে শুধু থিওরি মুখস্ত করে ডাক্তারি শেখা যায় কি? এই নেক্সট পরীক্ষায় কেউ অকৃতকার্য হলে তাকে ছয় মাস অপেক্ষা করতে হবে পরের পরীক্ষার জন্য, এখন কিন্তু দেড় মাসের মধ্যে সাপ্লিমেন্টারি পরীক্ষা দিয়ে ইন্টার্নশিপ শুরু করবার সুযোগ ছিল। একজন গরিব মধ্যবিত্ত ঘরের ছাত্র বা ছাত্রী যখন ফাইনাল ইয়ার শেষ করতে যায়, তার দিকে তাকিয়ে থাকে তার পরিবার–কবে সে ইন্টার্নশিপ শুরু করে উপার্জন শুরু করবে। এই অবস্থায় ছয় মাস অপেক্ষার কথা বলা অত্যন্ত অমানবিক। এই ব্যবস্থায় ভবিষ্যত ডাক্তারদের হতে কলমে কাজ জানার অভিজ্ঞতা কমবে বলে আশঙ্কা। এর ফল ভুগবে দেশের সাধারণ মানুষ।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ডাক্তারি শিক্ষা নিয়ে এ’পেরিমেন্ট নতুন নয়। কিছুদিন আগেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, তিন বছরের ডিপ্লোমা ডাক্তার এবং পনেরো দিনের নার্স তৈরি করবেন। তীব্র আন্দোলন শুরু হওয়ায় এবং তার প্রতিক্রিয়া পঞ্চায়েত ভোটে পড়তে পারে ভেবে রাজ্য সরকার আর এগোয়নি।

পশ্চিমবঙ্গে মেডিকেল শিক্ষায় ন্যক্কারজনক ভাবে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নেতাকর্মীদের পাশ করানোর জন্য পরীক্ষার সময় বই বা মোবাইল দেখে লেখানো, টুকলি সাপ্লাই করা, পরীক্ষকদের হুমকি দেওয়া ইত্যাদি চলছে। এই দেখে অনেকে বিভ্রান্ত হচ্ছেন যে, নেক্সট-এর মতো সর্বভারতীয় পরীক্ষা হলে বুঝি দুর্নীতি দূর হবে। আগে রাজ্যে রাজ্যে জয়েন্ট এন্ট্রান্সগুলি তুলে দিয়ে যখন নিট পরীক্ষা চালু হয় তখনও এই কথা আমরা শুনেছি। এরপর বহুবার নিট ইউজি এবং পিজি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস এবং কর্পোরেট কোচিং ইন্ডাস্ট্রির সাথে এদের যোগসাজসের বহু অভিযোগ দুর্নীতিমুক্ত কেন্দ্রীয় পরীক্ষার ফানুস ফাটিয়ে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় দুর্নীতির দূর হবার বদলে তার কেন্দ্রিকরণ হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি। যার ফল নেবে তৃণমূলের বদলে বিজেপির নেতাকর্মীরা আর নেবে কোচিং সেন্টারগুলো।

এই অগণতান্ত্রিক এবং চরম জনস্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে, ছাত্র সংগঠন এআইডিএসও-র ডাকে দেশের মেডিকেল ছাত্র সমাজ আন্দোলনে ফেটে পড়েছে। এই নে’ট পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে সংগঠন ১-৭ জুলাই প্রতিবাদ সপ্তাহ পালনের ডাক দেয়। ১ জুলাই (ডক্টর্স ডে-র দিন) কলেজে কলেজে এনং রাজ্যস্তরে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়। এর পর স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানে সাড়া দিয়ে যেখানে দেশের ৩০টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল থেকে মেডিকেল ছাত্রছাত্রীরা এআইডিএসও-র নেতৃত্বে আন্দোলনের পক্ষে সই দিয়ে প্রতিবাদ ধ্বনিত করেছে। ৭ জুলাই এনএমসি অফিসে সংগঠনের সর্বভারতীয় কমিটির পক্ষ থেকে প্রতিবাদ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সেই স্বাক্ষর জমা দেওয়া হয়। মেডিকেল ছাত্রদের মধ্যে এই বিশাল সমর্থন খুবই আশাব্যঞ্জক।

আন্দোলনে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের এই বিপুল অংশগ্রহণে ভীত হয়ে ইতিমধ্যেই এনএমসি ঘোষণা করেছে নে’ট পরীক্ষায় তিনটি অ্যাটেম্পট এর অ্যাভারেজ স্কোর রাখা হবে না। এটা আন্দোলনের একটা বড় জয়। এরপর কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মনসুখ মাণ্ডিয়া গত ৬ জুলাই ঘোষণা করেন, ২০১৯ ব্যাচের ছাত্রদের নে’ট পরীক্ষা দিতে হবে না। এছাড়াও তিনি ঘোষণা করতে বাধ্য হন যে, ফাইনাল এমবিবিএস পরীক্ষা আগের মতোই থাকবে, নে’ট দিতে হবে ইন্টার্নশিপের পর রেজিস্টে্রশন পাওয়ার জন্য। কিন্তু আজও পর্যন্ত (৯ জুলাই) এনএমসি থেকে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণার স্বপক্ষে কোনও নোটিশ বেরোয়নি, যা দেশজোড়া ছাত্রদের মনে ব্যাপক অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।

এআইডিএসও-র সর্বভারতীয় কমিটির পক্ষ থেকে দেশের সাধারণ মেডিকেল ছাত্রছাত্রীদের এই বিজয়ের জন্য অভিনন্দন জানিয়ে নেক্সট পরীক্ষা সম্পূর্ণরূপে বাতিলের দাবিতে এবং মেডিকেল শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ রুখে দিতে আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে আহ্বান জানানো হয়।