‘‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা সম্প্রদায়ের নামে, জাতপাতের নামে, ধর্মের নামে এবং প্রাদেশিকতার নামে একজনকে অপরজনের বিরুদ্ধে উস্কে দিয়ে আমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছে। বলা বাহুল্য, চালাকির মাধ্যমেই তারা এই কাজটিকে সম্পন্ন করেছে। কিন্তু মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিনের নামে শপথ নেওয়া এই নামধারী কমিউনিস্টরা এর বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারেননি। আর তাঁরা এটা করবেনই বা কী করে? তথাকথিত সমাজতন্ত্রীরা যেমন দক্ষিণপন্থী সোস্যাল ডেমোক্র্যাট, তেমনি তাঁরাও তো বামপন্থী সোস্যাল ডেমোক্র্যাট। তাঁরা যদি প্রকৃত কমিউনিস্ট হতেন এবং তাঁদের পার্টি যদি সঠিক কমিউনিস্ট পার্টি হত, তা হলে তাদের দ্বারা এটা করা হয়তো সম্ভব ছিল। কিন্তু আপনাদের কাছে আমার প্রশ্ন, কখনও আপনাদের মনে এই কথা এসেছে কি যে, ওই নেতৃত্ব যাঁরা নাকি সম্পূর্ণ অযোগ্য এবং অবিবেচক, যাঁরা বুদ্ধিহীনদের মতো ব্যবহার করেছে, তাঁরা আপনাদের উচ্ছন্নের পথে নিয়ে গেছে?
দ্বিতীয়ত, কখনও আপনারা ভেবেছেন কি যে, এই উথালপাথাল পরিস্থিতিতে আপনাদের দায়িত্ব কী ছিল, আপনাদের কর্তব্য কী ছিল? একবারও কি আপনাদের মনে এসেছে, তথাকথিত সমাজতন্ত্রীদের এ হেন কার্যকলাপের পিছনে ছিল ব্যক্তিগত স্বার্থ, ছিল নিজেদের ভবিষ্যৎকে গুছিয়ে নেওয়ার ধান্ধা? আপনারা জানেন, তাঁরা আজও বড় বড় নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। কেউ মন্ত্রী হয়েছেন, কেউ পার্লামেন্টে গিয়েছেন, বিধানসভায় গিয়েছেন, কেউ বিভিন্ন জায়গায় বত্তৃতার পর বত্তৃতা দিয়ে হাততালি কুড়োচ্ছেন, কেউ বিলেত যাচ্ছেন, কেউ আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলোতে বাণী দিচ্ছেন, কাগজে তাঁদের ফটো ছাপা হচ্ছে এবং কারোর গলায় মালা চাপিয়ে আপনারা ‘জিন্দাবাদ’ করছেন। বিখ্যাত নেতা হয়ে সমাজের মাথার উপরে বসে তাঁরা তাঁদের রাজনীতির দ্বারা মানুষকে শোষণ করবার একটা রাস্তা পেয়ে গিয়েছেন। আর এটাই তো ছিল তাঁদের উদ্দেশ্য।
শোষণ কি কেবল শিল্প (ইন্ডাস্ট্রি) আর ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমেই হয়, রাজনীতির মাধ্যমে হয় না? শোষণের অনেক পথ আছে। আইএনটিইউসি, এইচএমএস এবং কংগ্রেস-এর নেতারা কী করছেন? তাঁরা কি রাজনীতির মাধ্যমে শ্রমিকদের শোষণ করছেন না?
সব সময়ে মনে রাখবেন, সাধারণভাবে আন্দোলন দু’টি ভিন্ন রাস্তায় আমাদের নিয়ে যেতে পারে। সঠিক পথে পরিচালিত হলে আন্দোলন আমাদের কাঙিক্ষত মুক্তি এনে দিতে পারে, কিন্তু ভুল পথে পরিচালিত হলে এ আমাদের সর্বনাশ ডেকে নিয়ে আসে। বিপ্লবের পথ বড়ই জটিল, এই পথে চলা সহজ নয়। এই পথে ভুল হোক তাতে অসুবিধা নেই। ভুল থেকে সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা নিতে হবে, তাকে শুধরে নিতে হবে। কিন্তু ভুল হয়েছে বলে এবং বিপ্লবী পথের জটিলতা দেখে ঘাবড়ে গিয়ে সংগ্রাম ও আদর্শকে পরিত্যাগ করবেন না। আদর্শকে আরও সমৃদ্ধ করুন, বাস্তবসম্মত করুন যাতে তা কর্মোপযোগী হয়, সঠিক হয়, কাল্পনিক না হয়ে যায়– এটাই সব থেকে বড় কথা। শুধুমাত্র সংগ্রামই সব নয়। কেবলমাত্র লড়াই থেকেই চরিত্র গঠন হয় না। যদি শুধু লড়াই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই চরিত্র তৈরি হত এবং তা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হত, তা হলে আমি জিজ্ঞাসা করি, অতীতের যে সমস্ত সংগ্রামী নেতারা পরবর্তীকালে চরিত্রভ্রষ্ট হয়েছিলেন, তাঁরা কি কম সংগ্রাম করেছিলেন? ভারতবর্ষে বহু সংগ্রাম হয়েছে, তা কি এই সমস্ত নেতাদের চরিত্রকে টিকিয়ে রাখতে পেরেছে?
তথাকথিত কমিউনিস্ট, এইসব বামপন্থী সোস্যাল ডেমোক্র্যাট কি বিপ্লবকে সঠিক দিশা দেখাতে পেরেছে? ভুলে যাবেন না, লড়তে লড়তেই এঁরা শোধনবাদী হয়েছেন, আত্মসর্বস্ব সুবিধাবাদী নেতায় (পলিটিকাল কেরিয়ারিস্ট) পরিণত হয়েছেন। আন্দোলন প্রয়োজন, আন্দোলন ছাড়া বিপ্লবের ভিত্তি তৈরি হয় না– এ কথা ঠিক। কিন্তু মূল কথা হল– আন্দোলন যদি সঠিক রাস্তায় পরিচালিত না হয়, সঠিক চিন্তার ভিত্তিতে না হয়, তা হলে সেই আন্দোলন আপনাদের রক্ষা করতে পারবে না। তাই বলছি, অন্ধের মতো শুধু ‘লড়াই-লড়াই’ বলে চিৎকার করলেই হবে না।”
‘ভারতের শ্রমিক আন্দোলনের সমস্যার কয়েকটি দিক’ শিবদাস ঘোষ রচনাবলি, ৫ম খণ্ড