বাইরের কাউকে চা বাগানে দেখলেই হুমকি দেয় মালিক

উন্নয়নের স্রোত! ড্রেনের মধ্য দিয়ে পানীয় জলের পাইপ

পশ্চিমবাংলার মানচিত্র ধরে দক্ষিণ থেকে উত্তরের দিকে, সমতল থেকে পাহাড়ি এলাকার দিকে এগিয়ে গেলে এক রাশ পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। জীবনযাপনের ওপর ভৌগোলিক পরিবেশের প্রভাব চোখে পড়ে। আর এই উত্তরাঞ্চলে, প্রধানত ডুয়ার্স-তরাই, দার্জিলিং, আসাম প্রমুখ এলাকাগুলি প্রসিদ্ধ একটি বিশেষ কারণে– চা বাগান। যতদূর চোখ যায়, শীত, গ্রীষ্ম, বসন্ত, কুয়াশা কিংবা ঝকঝকে রোদে চা বাগানের কচি পাতা দেখা যায়। সেই সৌন্দর্য-দৃশ্য ফুটে ওঠে ভ্রমণমূলক পত্রিকায়, আর টিভি-খবরের কাগজে, চা-কোম্পানির নানা বিজ্ঞাপনে। চোখ কেড়ে নেওয়া এই সৌন্দর্য প্লাবিত করে রাখে পাঠকের দর্শকের মনকে। চা-বাগানগুলো হয়ে ওঠে টুরিজমের আকর্ষণকেন্দ্র।

তারপরেও থেকে যায় অনেক প্রশ্ন। প্রশ্নগুলো নিয়ে কিছু তরুণ শহরের ঘেরাটোপ ছাড়িয়ে উপস্থিত হয় শিলিগুড়ি সংলগ্ন নিশ্চিন্তপুর চা বাগানে। না, ঠিক চা বাগানে নয়, চা শ্রমিকদের গ্রামে। শুরু হয় প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান। স্পষ্ট হয় চিকন পাতার সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকা শ্রমিকদের নিপীড়ন। জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি এখন ট্যুরিস্টদের হটস্পট। সেখানে বিশাল শহর গড়ে উঠছে। বড় বড় উঁচু উঁচু ইমারত গড়ার হিড়িক পড়েছে। আর তা করতে গিয়ে উচ্ছেদ করে দেওয়া হয়েছে একটা আস্ত চা বাগান। নিশ্চিন্তপুর চা বাগানেরও ভবিষ্যৎ দশাও একই হতে চলেছে বলেই মনে করেন শ্রমিকরা।

এই চা বাগানে ঢুকতে গেলে একটা খাল পেরোতে হয়। দৈনন্দিন জলের প্রয়োজনের অনেকটাই মিটিয়ে দেয় এই খালের জল। কিন্তু খানিক দূরে যে প্রাইভেট স্কুল আছে তার নোংরা জল এখন গড়িয়ে পড়ে এই খাল দিয়েই। এই জলের ওপর আর নির্ভর করা যায় না। তবুও অবলীলায় বাচ্চারা খেলা করে সেই জলে। শ্রমিকদের গ্রামে ঢুকলে দেখা যায় টিন-অ্যাসবেস্টসের ঝুপড়ি। তার পাশে দূর পর্যন্ত ফাঁকা মাঠ। কিন্তু মাঠটা সমতল নয়। মাঝে মাঝেই খানিকটা উঁচু হয়ে গেছে। কাছে গেলে চেনা যায়, এটা আসলে সমাধিস্থল। ক্রিশ্চান ধর্মাবলম্বী চা শ্রমিকদের এখানে সমাধি দেওয়া হয়। এই সমাধিস্থলের গা ঘেঁসে কোনও অতিপ্রাকৃত গল্পের মতো পড়ে আছে এক তাসের মাঠ। সারা মাঠ জুড়ে সবুজ ঘাসের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে অসংখ্য তাস। গ্রামের একটি ছেলে জানায়, এখানে জুয়া খেলা হয় আর মদ খাওয়া হয়। বেলা গড়িয়ে অন্ধকার নেমে এলে সমাধিস্থলের পাশে শুরু হয় এই অদ্ভুত মহাযজ্ঞ।

চা বাগানের বেশিরভাগ কর্মীই মহিলা। তা হলে পুরুষরা করেন কী? পুরুষদের একাংশ যারা যুবক তারা প্রায় বেশিরভাগই লিপ্ত থাকে এই মহাযজ্ঞে। চা বাগানে মদ পাওয়া যায় না। তাই সস্তায় ব্যবস্থা আছে হাড়িয়ার। কিন্তু এমন পরিস্থিতি কেন? শিক্ষা দীক্ষা নেই এখানে? গ্রামের একদিকে যে তাসের মাঠ, তার অপরপ্রান্তেই আছে জরাজীর্ণ একটা স্কুল। ছেলেমেয়েদের শৌচালয়ের পর্যন্ত ব্যবস্থা নেই। মিড ডে মিলের জন্য তৈরি করা হয়ে পড়ে রয়েছে অর্ধসমাপ্ত সব অ্যাসবেস্টসের চাল দেওয়া ঘর। তার দেওয়ালে আঁকা অশ্লীল ছবি। ভগ্নস্তূপের মতো ছড়িয়ে আছে ইট আর সিমেন্ট– বেলা গড়ালে ওটা হয়ে ওঠে নেশাখোর আর মদ্যপদের আড্ডাখানা। এটিই ‘স্কুল’। চা বাগানের অন্তর্গত আপার প্রাইমারি পর্যন্ত সরকারি স্কুলগুলো হয় বন্ধ হওয়ার মুখে, আর না হয় সেগুলির শোচনীয় দুরবস্থা।

একই রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলে, বেশ খানিকটা দূরে রয়েছে চামটা চা বাগান। ঝাঁ চকচকে পিচ রাস্তার পাশে রোদে ঝলমল করছে বাগানটা। একটু হেঁটে গেলে ডান হাতে পড়বে মেফেয়ার রিসর্ট যেখানে এ বারের জি-২০ সামিটের ডেলিগেটদের থাকার জায়গা করা হয়েছিল। রিসর্ট পার হলে, পয়সাওয়ালাদের বিলাসিতার কেন্দ্র যেখানে শেষ, ওই পিচ রাস্তার সৌন্দর্যও সেখানেই শেষ। তারপর, ডান হাতে চা কারখানা, আর বাম দিকে শ্রমিকদের বস্তি। প্রতিটি চা বাগানে বংশানুক্রমে চলছে তাদের শোষণ। তারই মাঝে জীবন রক্ষা করতে গিয়ে ন্যূনতম প্রয়োজন যে জলের, সেই জলের পাইপ আসে হাইড্রেনের ভেতর দিয়ে। একটি স্কুল তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালে একশো দিনের কাজ প্রকল্পে। সে কাজ মাঝপথেই বন্ধ, আর তার পাশে এখন পড়ে আছে প্লাস্টিকের গ্লাস, আর মদের বোতল। ২২-২৩ বছরের এক যুবক নিজের হাতখানি দেখিয়ে বলে, ‘দেখো’। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় শ্রমের চিহ্ন কী ভাবে ছাপ ফেলে রেখেছে তাদের শরীরের ওপর। অনর্গল বলে যায়, ন্যূনতম প্রয়োজন মেটে না চা বাগানের রোজগারে। বাড়ির যুবকদের, পুরুষদের সন্ধান করতে হয় বিকল্প জীবিকার। তাই তারা চলে যায় বাইরে, অন্য রাজ্যে, হয়তো অন্য দেশে শ্রমিক হিসেবে। আছে সেই যুবকরাও যারা বেলা গড়ালে ওই তিন মাথার মোড়ে বসে মদ খায়, আর ড্রেনে শৌচ করে। আর সেই জল গড়িয়ে আসে নিচের গ্রামের মধ্য দিয়ে। ‘আমাদের মা কাকিমাদেরকে ওই ড্রেন থেকেই জল ভরতে হয়’। তার তীক্ষ দৃষ্টি আর কথার স্পর্ধায় ফুটে ওঠে ক্ষোভ। সে বোঝে একেই শোষণ বলে, সে জানে একে মানুষের মতো বাঁচা বলে না, সে জানে একে বেঁচে থাকা বলে না।

জঙ্গলে ঘেরা নকশালবাড়ি চা বাগান আয়তনে প্রায় ৮০০ একর। তার বেড়ার মধ্যে আছে প্রায় ৮টা গ্রাম। ওই ৮০০ একরে মানুষ থাকে, চিতা বাঘ থাকে, হাতিও থাকে– সহাবস্থান। তাদের বেশিরভাগ মানুষ জানে না বাইরের জগৎ সম্পর্কে বিশেষ কিছু। পশুপাখি আর মানুষ সব একই খাঁচায় বন্দি। একটি ছেলে ওখানকার গ্রামেই থাকে, বিকেল হলে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বন্ধুদের সাথে, চা বাগানের মধ্যেই। সে ছবি আঁকতে ভালোবাসে, সে ছবি আঁকে। কিন্তু ভালবাসার মধ্যে থেকে জন্ম নেওয়া এই গুণের বিশেষ কদর নেই, কারণ ওখানে এমন দৃষ্টান্ত খুবই বিরল। তাই, এ ক্ষেত্রে ও একা। ওখানকার একটি মেয়ে, ইতিহাস নিয়ে পড়ে, গ্রামের প্রথম শিক্ষিত। সে শুনিয়ে দেয় মদ প্রচলনের ইতিহাস, শুনিয়ে দেয় ১৯২০ থেকে ছোটনাগপুরের চা বাগানের শোষণের ইতিহাস। বুঝিয়ে দেয়, এই চা বাগানের অন্তরালে চলা শোষকদের পরিকল্পিত শোষণ ব্যবস্থার আঙ্গিকগুলো। ও বোঝে। কিন্তু সকলে বোঝে না। তারা যে জানে না, এর পেছনেও কারণ রয়েছে। চা বাগানের মালিকরা যারা এক সময় এই সব জমি সরকারের থেকে লিজে নিয়েছে, তারা নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবেই এক প্রকার শাসন চালায় এখানে। বাইরের কারওর প্রবেশকে ভাল চোখে দেখে না। পুলিশ ডাকার ভয় দেখায়। মালিকের ভয়ে তটস্থ থাকে শ্রমিকরা। শ্রমিকদের চিরকাল বেঁধে রাখার পরিকল্পনা চলে।

শ্রমিকরা প্রায় সবাই জানে তারা কোন বর্বরতার সামনে দাঁড়িয়ে। কিন্তু, ‘এখানে আমরা সবাই সবটা জানলেও, ঐক্যের খুব অভাব’– হাসখোয়া চা বাগানের এক কর্মী বলে ওঠেন। গ্রামে নেই জলের ব্যবস্থা, নেই বেসিক স্যানিটেশন। সরকার এক বস্তা সিমেন্ট দিয়ে বানিয়ে দিয়েছে একটা আস্ত টয়লেট। এমনই তার হাল যে জল ঢাললেই বোধহয় ধসে পড়ে যাবে। এক শ্রমিক নিজের টাকা খরচ করে বানাচ্ছেন টয়লেট। এতে ওনার উপার্জনের যে অংশ ব্যয় হবে, তাতে পেটে টান পড়বে। কিন্তু কোমরের সমস্যা, ডাক্তার বলেছে ওনার ইন্ডিয়ান টয়লেট ব্যবহার করা যাবে না। তাই, নিজেকেই ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। জলের ওভারহেড ট্যাঙ্ক বসানো শুরু হয়েছিল কিছু বছর আগে, বরাদ্দ ছিল ১১ লক্ষ টাকা। সে কাজ অসম্পূর্ণ, এক নিরাকার নিরেট স্তম্ভের মতো খাড়া হয়ে রয়েছে। তার নীল সাদা রংটা চকচক করছে মাত্র। বাগানের পাইপলাইনে যে জল আসে, তার আসার সময়ের কোনও ঠিক নেই। এলেও, জল পড়ে সুতোর মতো।

রাজনীতি? আছে। আছে বিজেপি, আছে তৃণমূল, আছে সিপিএম। তারা কী করে? শ্রমিকরা বলেন এদের নেতাদের বেশ ভাল ভাব বাগানের বাবুদের সাথে। আর কিছু না। এক বাক্যেই শেষ হয়ে যায় ওই রাজনীতির অবস্থা-ব্যবস্থা। বছরের পর বছর ধরে চলতেই থাকে শ্রমিকদের ওপর শোষণ-অত্যাচার। মতের পার্থক্য হলে, সংঘাত হলে, মানুষ খুন পর্যন্ত হয়ে যায়। কিন্তু তার খবর হাওয়ায় হারিয়ে যায়। ব্রিটিশ সংবাদপত্র গার্ডিয়ানে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে স্পষ্ট দেখানো হয়েছে কেমন করে প্রলোভন দেখিয়ে চা বাগানের যুবতীদের পাচার করে দেওয়া হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, কখনও কখনও বিদেশেও। দেহ ব্যবসায় বিক্রি করে দেওয়া হয় তাদের। দক্ষিণ ভারতে তামিলনাডুর চা বাগান সংলগ্ন বন জঙ্গল কেটে ফেলা হচ্ছে হয় বাগানকে আরও বড় করার জন্য, না হয় নতুন চা বাগান খোলার জন্য। ফলে জঙ্গলের বাঘ ঢুকে পড়ে গ্রামীণ বসতিতে। গবাদিপশুর ছিন্ন ভিন্ন দেহ পড়ে থাকে, কখনও কখনও আস্ত মানুষকে টেনে নিয়ে চলে যায় অন্ধকারে। রক্তাক্ত ঘায়ের উপর অঝোরে কান্নার স্রোত এসে পড়ে, আর তারপর ভ্রমণ পত্রিকার চকচকে কাগজের ওপর দেখা যায় বিজ্ঞাপন– টিভির পর্দায় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ধারায়, সেতার বাজিয়ে দর্শকের কাছে পরিবেশন করা হবে তাজমহল চায়ের সৌন্দর্য। তকমা দেওয়া হবে ‘ফ্লেভার অফ দার্জিলিং’। আর মানুষ– সে তো কোনও দিন ছিলই না বেঁচে!