ভগবানগোলা স্টেশনে প্রতিদিন হা-পিত্যেশ করে বসে থাকে ৮ বছরের আরিফ সেখ, তাকে আর মা-কে ছেড়ে অন্যত্র সংসার পাতা আব্বাকে একবার দেখবে বলে। আরিফের মতোই এ দেশে লক্ষ লক্ষ শিশু বঞ্চিত হচ্ছে বাবা কিংবা মায়ের ভালবাসা থেকে। বিবাহ-বিচ্ছেদ, তালাক বা একাধিক বিয়ের কারণে। শিশুদের ক্ষেত্রে এটা কি কম নির্যাতন?
বাবা-মায়ের পরেই দ্বিতীয় অভিভাবক স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা। কিন্তু তাঁদের সময় কম। হরেক রকম ‘শ্রী’-এর ফর্ম ভরা, মিড ডে মিল, নানা সমীক্ষা, ভোটের ডিউটি, আরও বহু কিছু করতেই তাঁদের সময় চলে যায়। গ্রাম ও শহরগুলির দরিদ্র এলাকায় শিক্ষার প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে স্কুলছুট ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সর্বত্র একই চিত্র। বিভিন্ন সরকারি স্কুলে ছাত্র কমতে শুরু করেছে। খাতায়-কলমে কিছু নাম থাকলেও সংবাদপত্রে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে, কলকাতা পুরসভার ১১৩টি স্কুলে কোনও ছাত্র নেই বা তাদের সংখ্যা এত কম যে স্কুল চালানো সম্ভব নয়। ভারত সরকারের বিদ্যালয় শিক্ষা দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ২০১৯-২০ সালে ৫১,১০৮টি সরকারি স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে ছাত্রের অভাবে। আবার পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ৭০১৮টি রাজ্য প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ হয়েছে। প্রাথমিক থেকে উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যন্ত ৮২০৭টি বিদ্যালয় বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। স্কুলছুট শিশু-কিশোররা বহু সময় নেশা ও অপরাধজগতেও জড়িয়ে যায়।
এ কথা সর্বজনগ্রাহ্য যে সরকারি স্কুলে পড়ার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। তাই অভাবী পরিবারগুলিতে বন্ধ হচ্ছে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা। বেসরকারি স্কুলে সন্তানদের নিয়ে যাওয়ার সাধ থাকলেও সাধ্য কোথায় তাদের? এই ব্যবস্থায় শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিশু-কিশোররা। এও কি কম নির্যাতন?
দেশের সত্তরভাগ মানুষ তো দারিদ্রসীমার নীচে। দু-মুঠো ভাত জোগাড় করতে মা-বাবাদের বাইরে যেতে হয় কাজে। অতি ছোট শিশুদের অভুক্ত থাকতে হয় দেখভালের অভাবে। জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার পরিসংখ্যান অনুযায়ী দু’বছর হয়নি এমন ৫৯ লক্ষ শিশু অভুক্ত থাকে ভারতে। আজও তিনজন শিশুর মধ্যে একজন অপুষ্ট। সরকারি প্রকল্প সঠিকভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে খাদ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত এই দুধের শিশুরা।
খাদ্য ও শিক্ষা না পাওয়া গরিব শিশুরা সমাজে এখন নিরাপদে নেই। প্রতিদিন সংবাদমাধ্যমে নিখোঁজ বাচ্চাদের খবর দেখা যায়। শিশু-পাচারের বিশাল চক্রের ডালপালা ছড়িয়ে আছে গ্রামগঞ্জে উপজাতি, জনজাতি অঞ্চলে। এদের কাজে লাগানো হয় অপরাধমূলক কার্যকলাপ, বেগার খাটা, মাদক পাচার চক্র, যৌন ব্যবসা ইত্যাদিতে। ভারতে বছরে ১৩ লাখ শিশু পাচার হয়। ২০১৫ সালে রাজধানী দিল্লিতেই নিখোঁজ হয়েছে ২১ হাজার শিশু। ৯০ শতাংশেরই হদিশ পাওয়া যায়নি। প্রতি বছর এত শিশু নিখোঁজ হচ্ছে অথচ পুলিশ প্রশাসন কিছু করতে পারছে না। পাচার চক্রের সঙ্গে পুলিশ প্রশাসনের গোপন আঁতাত ছাড়া এটা কি সম্ভব? এমনকি যে জায়গায় বাচ্চাদের নিরাপদে থাকার় কথা, তা-ও হয়ে উঠেছে ভয়ের আস্তানা। মার্চ মাসে বহরমপুর নজরুল হোম থেকে ১১টি কিশোর উধাও হয়ে গেল!
শিশু ও নাবালিকাদের উপর যৌন নিগ্রহের ঘটনাও বেড়েই চলেছে। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সমীক্ষায় দেখা গেছে প্রতি দু’জন শিশুর মধ্যে একজন যৌন নিগ্রহের শিকার। প্রতি চারটির মধ্যে একটি পরিবার মুখ খুলতে চায় না মূলত লোকলজ্জায়। সমীক্ষায় বলা হয়, ৯৮ শতাংশ যৌন নিগ্রহ হয় পরিচিত লোকজনদের দ্বারা।
নাবালিকা বিবাহ কিশোরীদের উপর নির্যাতন ছাড়া কিছু নয়। বহু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও সরকারি তৎপরতা সত্তে্বও ব্যাপক হারে গ্রাম ও শহরে বাল্যবিবাহ চলছে। কেন্দ্রীয় সরকারের নারী ও শিশু কল্যাণ দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী সংসদে জানিয়েছেন, বাল্যবিবাহ, নারী ও শিশু পাচারে সারা দেশের মধ্যে প্রথম পশ্চিমবঙ্গ। নাবালিকার গর্ভধারণ ও অকাল মাতৃত্বেও পশ্চিমবঙ্গ শীর্ষে।
শিশু-কিশোর, বালক-বালিকাদের স্নেহ, ভালবাসা, খাদ্য, শিক্ষা, সচেতনতা, মর্যাদা ও নিরাপত্তার দায় নিতে হবে বাবা-মা, শিক্ষক, সরকার ও সুশীল সমাজকে। না হলে আগামী প্রজন্ম বড় হবে শিক্ষাহীন, সচেতনতাহীন, নীতিহীন মানসিকতা নিয়ে। তৎপরতার সাথে এ সমস্যা মোকাবিলা না করলে দেশের সমূহ ক্ষতি এড়ানো যাবে কি?
খাদিজা বানু
বহরমপুর