সমগ্র ব্রিটেন, আমেরিকা ও ফ্রান্স শ্রমিক ধর্মঘটে উত্তাল। ব্রিটেন-আমেরিকা সহ সমগ্র বিশ্বে পুঁজিবাদী অর্থনীতি আজ প্রবল আর্থিক সংকটে হাবুডুবু। যে শ্রমিকরা জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় যৌবনকে মালিকদের স্বার্থে নিঃশেষে বিলিয়ে দিয়েছে– পুঁজিবাদী সঙ্কটের সমস্ত বোঝা আজ তাদেরই বহন করতে হচ্ছে। লেঅফস ডট ফাই-এর তথ্য অনুযায়ী মেটা, অ্যামাজন, গুগল, মাইক্রোসফট সহ অসংখ্য আইটি ও বৃহৎ কর্পোরেশন ২০২২-‘২৩ সালে ২ লক্ষেরও বেশি শ্রমিককে ছাঁটাই করেছে। মালিক শ্রেণির এই অন্যায় ছাঁটাই, লে-অফের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণি আজ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে সর্বত্র। মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে, মজুরি বাড়ানোর দাবিতে, ছাঁটাই লে-অফ প্রতিরোধে, কাজের বোঝা বাড়ানোর বিরুদ্ধে– আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্সের শহরগুলোতে আছড়ে পড়ছে শ্রমিক আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গ। ভারতে অবরোধ, ধর্মঘট, বনধ-এর বিরুদ্ধে অপপ্রচার করতে গিয়ে যে সংবাদমাধ্যমগুলো ইউরোপ আমেরিকার শিল্প ক্ষেত্রে অবরোধ, প্রতিরোধ, আন্দোলন নেই বলে গল্প লিখত, তারাই আজ সেই দেশগুলোর শ্রমিক ধর্মঘটের কথা লিখতে বাধ্য হচ্ছে। ফ্রান্সের একটি সাপ্তাহিক শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন নিয়ে লিখেছে– ‘প্যারিসের সুবিশাল চত্বরে সমবেত হয়েছেন হাজার হাজার আন্দোলনকারী, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে। গলা তুলেছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে । … ফ্রান্স মানে যে আজও প্রথমত ও প্রধানত বারুদ, অন্যায়ের সামনে প্রতিরোধ, পিঠ নুইয়ে নয়, ঘাড় বেঁকিয়ে দাঁড়ানোর হিম্মত– তা আবার প্রমাণ করেছে ত্রুদ্ধ ও অবরুদ্ধ আজকের এই ফ্রান্স। বিদ্রোহের দিনপঞ্জিকা লিখে চলেছে সে।’
আমেরিকা, ফ্রান্সের শ্রমিক আন্দোলন সম্পর্কে সেখানকার দৈনিক পত্রিকাগুলো প্রায় সকলেই মাসের পর মাস প্রায় প্রতিদিনের ধর্মঘটের তালিকা প্রকাশ করছে, যা প্রকৃতই শ্রমিক সংগ্রামের দিনপঞ্জিকা। চারিদিকের এই বিদ্রোহে ধর্মঘট লিখছে নয়া ইতিহাস। শুধু শ্রমিক ধর্মঘটই নয়, স্টারবাগ, অ্যামাজন, অ্যাপেল সহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা নতুন করে শ্রমিক ইউনিয়ন তৈরি করতে বিপুল সংখ্যায় আবেদনপত্র জমা দিয়েছে। আমেরিকার লেবার বুরো যে প্রধান ২০টি শ্রমিক ধর্মঘটের কথা উল্লেখ করেছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল– নিউইয়র্ক টাইমসের ধর্মঘট, ক্যালিফোর্নিয়ার হেলথ কেয়ার কোম্পানি কাইজার পারমানেন্টটির শ্রমিক ধর্মঘট, ফ্রন্টিয়ার কমিউনিকেশনের শ্রমিক ধর্মঘট ও ক্যালিফর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার, হাজার শ্রমিকের ধর্মঘট।
শ্রমিকদের নিয়ে গবেষণা করেন এমন একজন লিখেছেন– ‘আজকের শ্রমিক আন্দোলন, শ্রমিক ইউনিয়ন তৈরির জোয়ার এনেছে আমেরিকায়। আমেরিকার বুরো অফ লেবার স্ট্যাটিসটি’ যে শ্রমিক ধর্মঘটের খতিয়ান দিচ্ছে সেই পরিসংখ্যানকে অনেকে মনে করছেন তা হিমশৈলের চূড়ামাত্র।’ আবার ব্রিটেনের নার্স, জুনিয়ার ডাক্তার, লন্ডনের বাসচালক, ইউরোস্টার-এর নিরাপত্তা কর্মী, সীমান্তরক্ষী এজেন্ট, হিথরো বিমানবন্দরের কর্মী, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসক, স্কটল্যান্ডের শিক্ষক, ওয়েলসের ফিজিওথেরাপিস্ট, নর্দান ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের ড্রাইভিং পরীক্ষক, ব্রিটেনের ন্যাশনাল হাইওয়ে কর্মী সহ সকল ক্ষেত্রে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কর্মচারী মাসের পর মাস লাগাতার ধর্মঘটে সামিল। ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকার এশিয়া সংস্করণ আরও লিখেছে, ট্রেন ড্রাইভার থেকে রেলকর্মী ও নার্স, জরুরি পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত কর্মী ও সিভিল সার্ভেন্ট সব আন্দোলনেই জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন আছে। শ্রমিক আন্দোলনের এই উত্তাল তরঙ্গের মধ্যে পুঁজিবাদী শোষণ নিপীড়নের অবসানের বার্তাও ধ্বনিত হচ্ছে। ফ্রান্সের এক কলেজ-ছাত্র বলছেন, ‘আমাদের সমস্যার একদম মূলে যেতে হবে। বুঝতে হবে, এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আমাদের জীবনকে কী ভাবে বিধ্বস্ত করছে, জীবনকে পিষে মারছে, আমাদের গ্রহটাকে ধ্বংস করছে। এই ব্যবস্থাটাই সমাজের যাবতীয় রোগের আঁতুড়ঘর। এই ব্যবস্থাটার উপর আগে আঘাত হানতে হবে।’
ভারতেও আন্দোলন আছড়ে পড়ছে। দিল্লির রাজপথে প্রায় এক বছর ধরে তাঁবু খাটিয়ে কৃষক আন্দোলন হয়েছে যা চরম উদ্ধত সরকারের মাথা নত করেছে। এই আন্দোলন বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে। পশ্চিমবঙ্গে ডিএ-র দাবিতে সরকারি কর্মীরা রাজপথে অবস্থান চালিয়ে যাচ্ছেন মাসের পর মাস ধরে। মানুষ আন্দোলনমুখী হচ্ছে সরকারের নীতির বিরুদ্ধে। বেকার যুবকদের দীর্ঘনিঃশ্বাস ও ছাঁটাই শ্রমিক পরিবারের অনাহারের যন্ত্রণা সরকার চাপা দিতে পারছে না। ধর্মীয় জয়ধ্বনিতে চাপা পড়ছে না দিনভর অভুক্ত থাকা দু’বছরেরও কম বয়সী ৫৯ লক্ষ ভারতীয় শিশুর বুকফাটা কান্না। এটাও চাপা দেওয়া যাবে না গুজরাটে গত পাঁচ বছরে প্রতিদিন ৯ জন দিনমজুরের আত্মহত্যার খবর। যেমন আড়াল করা যাবে না প্রতি ঘণ্টায় ১০০ জন ভারতীয় কৃষকের ভূমিহীনে পরিণত হওয়া ও ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়া হাজার হাজার কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনা।
ইউরোপ-আমেরিকার শ্রমজীবী মানুষ যেমন জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ছাঁটাই, মূল্যবৃদ্ধির তীব্র আক্রমণে দিশেহারা না হয়ে লাগাতার ধর্মঘটের মাধ্যমে মাথা উঁচু করে বাঁচার রাস্তা করে নিচ্ছেন, তেমনই ভারতীয় শ্রমিক শ্রেণিকেও জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ময়দানে মালিক শ্রেণির সেবাদাস সরকারের জুলুম, শোষণ, বিভেদ সৃষ্টির বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে বাঁচবার পথ করে নিতে হবে।