উত্তরপ্রদেশের এলাহাবাদে পুলিশের ঘেরাটোপের মধ্যে দাঁড়িয়ে ‘এনকাউন্টারের’ নতুন রূপ দেখাল তিন আততায়ী। এতদিন বিজেপি শাসিত এই রাজ্যে পুলিশই এনকাউন্টার করে হত্যা করত, তা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথজি প্রবল গর্ব প্রকাশ করতেন। এবার যা ঘটল তাতে পুলিশের মদতে ক্রিমিনালরাই এনকাউন্টার করার ছাড়পত্র পেয়ে গেল কি না, সে প্রশ্ন মানুষকে ভাবাচ্ছে।
১৫ এপ্রিল এলাহাবাদে পুলিশের বিশাল বাহিনীর সামনে সাংবাদিকদের ক্যামেরাকে সাক্ষী রেখে যেভাবে প্রাক্তন বিধায়ক তথা বাহুবলী নেতা আতিক আহমেদ ও তাঁর ভাইকে খুন করেছে বন্দুকধারী তিন দুষ্কৃতী তাতে এই প্রশ্ন না উঠে পারে না। এর মাত্র দু’দিন আগে পুলিশের এনকাউন্টারে খুন হয়েছেন আতিকের ১৯ বছর বয়সী পুত্র। আতিক আহমেদের নামে নানা মারাত্মক অপরাধের অভিযোগ ছিল, বিচার হলে তাঁর হয়ত কঠিন শাস্তিও হত। কিন্তু তার জন্য বিনা বিচারে তাঁকে হত্যা করার পক্ষে যুক্তি সাজিয়ে বিজেপির নানা নেতা যেভাবে আস্ফালন করছেন, তা অনেক বেশি উদ্বেগজনক। প্রসঙ্গত, তাঁকে যে ভুয়ো এনকাউন্টারে হত্যা করা হতে পারে সেই আশঙ্কা ব্যক্ত করে আতিক আহমেদ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে শীর্ষ আদালতেরও দ্বারস্থ হয়েছিলেন। কিন্তু কেউই তাতে কর্ণপাত করেনি।
লক্ষণীয়, তিন আততায়ী তাদের কাজ শেষ করা পর্যন্ত উপস্থিত বিশাল পুলিশ বাহিনী এতটুকু নড়বার চেষ্টাও করেনি। আততায়ীদের মুখে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিই বিজেপি সরকারের পুলিশ বাহিনীকে মোহগ্রস্ত করে দিল কিনা তা গবেষণার বিষয় হতে পারে। কিন্তু যে পুলিশ যখন তখন এনকাউন্টারে এতটা দড়, তারা তিন আততায়ীর দিকে বন্দুকগুলো তুলেও ধরল না, এটা কি খুব স্বাভাবিক? হেফাজতে থাকা একজন অভিযুক্তের জীবন রক্ষার একেবারে প্রাথমিক দায়টি অবশ্য উত্তরপ্রদেশের পুলিশ বহু আগেই ভুলে মেরে দিয়েছে। এমনিতেই সারা দেশে বিজেপি শাসনে পুলিশ এবং জেল হেফাজতে মৃত্যু অতি সাধারণ ঘটনায় পর্যবসিত। গত ফেব্রুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী এক প্রশ্নের উত্তরে রাজ্যসভায় জানিয়েছিলেন, গত পাঁচ বছরে দেশে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুতে শীর্ষে গুজরাট, দ্বিতীয় বিজেপি জোট শাসিত মহারাষ্ট্র এবং তৃতীয় উত্তরপ্রদেশ (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ১৪.০২.২০২৩)। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর নামে তাঁর সমর্থকরা জয়ধ্বনি দেন ‘বুলডোজার বাবা’ বলে। যিনি সরকার বিরোধিতার অভিযোগ উঠলেই কোনও বিচারের অপেক্ষা না করে অভিযুক্তদের বাড়ি ভাঙতে পুলিশ এবং বুলডোজার পাঠিয়ে দেন। সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখানোর ‘অপরাধে’ও বাড়িতে বুলডোজার পৌঁছে যায়। সে রাজ্যের পুলিশের একমাত্র ‘দক্ষতা’ এসেছে কাউকে অপরাধী মনে করলেই ‘এনকাউন্টার’ করে তাকে নিকেশ করায়। গত পাঁচ বছরে উত্তরপ্রদেশে ১০,৯০০ ক্ষেত্রে পুলিশ এনকাউন্টার করতে গুলি চালিয়েছে। তাতে ১৮৩ জন অভিযুক্ত নিহত হয়েছে। মেরে দিলেই যখন দায়িত্ব শেষ, আদালতে অপরাধ প্রমাণের দায়ও শেষ। থানাগুলোই এখন আদালতের ভার নিয়ে নিচ্ছে! এরপর হয়ত সরকার বলবে এমন পুলিশ-স্বর্গে আর কোর্ট, বিচারক, আইন এসব বালাই রাখার দরকার কী? কালক্রমে বিজেপি শাসিত আসাম, মধ্যপ্রদেশ ইত্যাদি রাজ্যের সরকার ও প্রশাসনও এই এনকাউন্টার ও বুলডোজার ব্যবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরা সামনে রেখে সংসদ ভবনকে প্রণাম করেন, সংবিধানে মাথা ঠোকেন, কিন্তু নিজের দলের পরিচালিত সরকারগুলো দু’পায়ে আইন-সংবিধান মাড়িয়ে গেলে টুঁ শব্দটি করেন না। সারা বিশ্বের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ আফগানিস্তানের তালিবান জমানাকে ধিক্কার দেয়, কারণ তারা শাসকদের মর্জিমতো নিজেদের অভিযুক্তদের বিনা বিচারে হত্যা করে। বিজেপি কি তবে তার মৌলবাদী কাউন্টারপার্ট হিসাবে তালিবানকেই অনুসরণ করতে চাইছে?
আতিক এবং আসরাফের হত্যাকাণ্ডের পর ‘দ্য ওয়্যার’ পত্রিকার সাংবাদিক করণ থাপারের কাছে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি মদন বি লোকুর যে প্রশ্নগুলি তুলেছেন তার উত্তর কেন্দ্রের কিংবা উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকার দেয়নি। তাঁর প্রশ্ন– পুলিশ হাতে বন্দুক নিয়েও নিশ্চল হয়ে হত্যাকাণ্ড দেখল কেন? কেন হত্যাকারীদের নিজেদের হেফাজতে নিতে আদালতে আবেদন করেনি পুলিশ? তারা কি এ বিষয়ে এতটাই অবহিত যে, নতুন কোনও জিজ্ঞাসাবাদ বা তদন্তের প্রয়োজনই নেই? কেন আতিক এবং আসরাফের জীবনের ঝুঁকি আছে জেনেও তাদের রাত সাড়ে দশটার সময় হাসপাতালে সাধারণ স্বাস্থ্যপরীক্ষার জন্য পুলিশ নিয়ে গেল? কেন আততায়ীরা সাংবাদিকের ছদ্মবেশে এসেছিল, তারা কী করে জানল যে ওই রাতে হাসপাতালের সামনে প্রচুর সাংবাদিক থাকবেন? পুলিশ কি সংবাদমাধ্যমকে জানিয়ে অভিযুক্তদের হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল?
উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ প্রায় লব্জ করে ফেলেছেন একটা কথা– ‘মাফিয়া কো মিট্টিমে মিটা দেঙ্গে’ (মাফিয়াদের মাটিতে মিশিয়ে দেব)। তাঁর এবং তাঁর দলের সৌভাগ্য যে এই সব ফিল্মি-কায়দার হুঙ্কারে এখন হাততালি দেওয়ার লোকেরও অভাব হয় না। স্বাধীনতার পর থেকে এ দেশের শাসক দলগুলো এই মাফিয়া, গুণ্ডা, সমাজবিরোধীদের কাজে লাগিয়েছে। তাতে সাধারণ মানুষের জীবন বিপদগ্রস্ত হয়েছে। বিজেপি যেখানেই ক্ষমতায় বসেছে একই কাজ করেছে। এখনকার সাথে কিছুদিন আগেকার সময়ের পার্থক্য একটাই– আগে সরকারি দলের নেতারা এদের কন্ট্রোল করতেন, এখন এই মাফিয়ারাই অনেকে নেতা, মন্ত্রী। অর্থাৎ, বিজেপি নেতারা মাফিয়াদের বিরুদ্ধে যতই হুঙ্কার দিন, সংসদ-বিধানসভার অলিন্দে আলোকিত মাফিয়াকুল। কেন্দ্র থেকে রাজ্যে রাজ্যে বিজেপির নেতা-মন্ত্রীদের পরিচয় জানলেই বিষয়টা আরও স্পষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু তারা প্রচারপটু বলে অন্য দলের আশ্রয়পুষ্ট মাফিয়াদের বিরুদ্ধে সংবাদমাধ্যমকে দেখিয়ে হুঙ্কার ছাড়ে। মানুষ ভাবে এই তো ‘গুণ্ডারাজ’ খতম হচ্ছে! যে সমাজবিরোধী মাফিয়ারা বিজেপির আশ্রয়ে ঢুকে পড়ে তাদের সাতখুন মাফ হয়, বুলডোজার চলে বিরোধী সাধারণ মানুষের ওপর। একটি সরকারের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার এতটুকু ক্ষমতা থাকলে এই সব শূন্যগর্ভ হুঙ্কার না ছেড়ে আইনের পথেই তারা সমাজবিরোধীদের মোকাবিলা করতে পারে। তা নেই বলেই পুলিশকেই গুণ্ডায় পর্যবসিত করে অপরাধ জগৎকে নিজেদের দলে টানার বার্তা দিচ্ছে বিজেপি। তাদের এই কৌশলটাও আতিক হত্যার কালে পুরোপুরি ধরা পড়ে গেছে।
প্রায় সব গণতান্ত্রিক বোধ হারিয়ে ফেলা বুর্জোয়া গণতন্ত্রেরও যতটুকু নিয়ম আজও টিকে আছে তা বলে–কোনও অভিযুক্ত যতক্ষণ না আদালতে দোষী প্রমাণিত হচ্ছে তাকে নির্দোষ হিসাবেই ধরতে হবে। পুলিশের হাতেই সত্য-মিথ্যা নির্ধারণের ক্ষমতা যে রাষ্ট্র দেয়, পলিটিকাল সায়েন্সের পরিভাষায় তাকে বলা যায় পুলিশ রাষ্ট্র, তা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কোনও মতেই হতে পারে না। একের পর এক ঘটনা দেখাচ্ছে বিজেপি দেশটাকে সেদিকেই নিয়ে যাচ্ছে। বিশেষত আতিক হত্যার ঘটনা আইনের শাসনের সম্পূর্ণ অবলুপ্তির দিকেই ইঙ্গিত করছে। বিজেপি শাসিত সব রাজ্যেই বিশেষত উত্তরপ্রদেশে সরকার, প্রশাসন এবং পুলিশ যে ভাবে সাম্প্রদায়িক এবং জাতপাত ভিত্তিক সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলছে তাতে এই হত্যাকাণ্ডের সঠিক তদন্ত হওয়াও কার্যত অসম্ভব। তা একমাত্র সম্ভব হতে পারে গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন নাগরিকদের তীব্র গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়েই।
উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের দাবি এসইউসিআই(সি)-র
এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ ১৬ এপ্রিল এক বিবৃতিতে বলেন,
উত্তরপ্রদেশে পুলিশ হেফাজতে হাতকড়ি লাগানো অবস্থায় দুই বন্দিকে যেভাবে খুন করা হয়েছে তা পুলিশ প্রশাসনের সহায়তা ছাড়া সম্ভব নয়। এই ঘটনা দেখিয়ে দিল সেখানে আইনের শাসন বলে কোনও কিছুরই আর অস্তিত্ব নেই। আইনের শাসন বলে, যে কোনও অভিযুক্তেরই আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার আছে। একজন অভিযুক্ত ব্যক্তিও এই অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে বোঝা যায় আইনের বদলে নৈরাজ্যের শাসন চলছে। আমরা এই ঘটনার উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত দাবি করছি।