সাম্প্রতিক নির্বাচন প্রমাণ করল বিজেপি-ঝড় বলে কিছু নেই

দিল্লি এবং হিমাচল প্রদেশে বিজেপির পরাজয় প্রমাণ করল নরেন্দ্র মোদি অমিত শাহদের সাংগঠনিক কৌশল, ক্ষমতা প্রভৃতি নিয়ে সংবাদমাধ্যমে যত প্রচারই থাকুক বাস্তবে তা সত্য নয়– বিজেপি অপরাজেয় নয়, ‘মোদি ম্যাজিক’ বলে প্রচারিত কোনও অলৌকিক ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেই। সত্যিই যদি এ-সব থাকত তবে দিল্লি এবং হিমাচলে বিজেপি এ ভাবে মুখ থুবড়ে পড়ত না, সাতটি উপনির্বাচনের পাঁচটিতেই হারত না।

গুজরাট পুনর্দখলের জন্য বিজেপি নেতারা যেমন জান কবুল করেছিলেন, ঠিক একই রকম ভাবে জান কবুল করেছিলেন দিল্লি এবং হিমাচল পুনর্দখলের জন্য। দিল্লিকে নিজেদের কব্জায় রাখার জন্য বিজেপি অনেক আগে থেকেই ঘুঁটি সাজিয়েছিল। দিল্লির তিনটি মিউনিসিপ্যাল কাউন্সিলকে বিজেপি এবার জুড়ে একটিই কর্পোরেশনের এক্তিয়ারভুক্ত করে যাতে গুজরাট এবং হিমাচলের সাথে একই মোদি ম্যাজিকে গোটা দিল্লিরও দখল তাদের হাতে থেকে যায়। এই লক্ষ্য থেকে তাঁরা দিল্লি কর্পোরেশন নির্বাচনেও গুজরাটের মতোই প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে সভা করিয়েছে। দিল্লিতে সংগঠিত দাঙ্গা, সংখ্যালঘুদের উপর বর্বর আক্রমণের পর তাদের বিরুদ্ধেই দাঙ্গা লাগানোর অভিযোগ এনে তাদের গ্রেফতার করে জেলে ভরা প্রভৃতি নানা ভাবে মেরুকরণের চেষ্টা, বিরোধীদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এনে ইডি-সিবিআইকে দিয়ে হেনস্থা করা প্রভৃতি কোনও কিছুই দিল্লি পুরসভায় বিজেপির বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভকে ঢাকতে পারেনি।

হিমাচলেও ঠিক একই রকম ভাবে মোদি নিজে গিয়ে একের পর এক সভা করেছেন, গুজরাটের কায়দাতেই বলেছেন, কোনও বিশেষ প্রার্থীকে নয়, তিনিই সব আসনে প্রার্থী হয়েছেন ধরে নিয়ে জনগণ যেন বিজেপিকে ভোট দেয়। কিন্তু সবই বিফলে গেছে। অগ্নিবীর প্রকল্পের নামে সেনাবাহিনীর চাকরিতে চার বছরের চুক্তিতে নিয়োগের বিরুদ্ধে যুবসমাজের বিক্ষোভ, দাম না পাওয়া আপেল চাষিদের বিক্ষোভ কোনও কিছুকেই নেতাদের শুকনো প্রতিশ্রুতিতে মুছে দেওয়া যায়নি। বিজেপির এই পরাজয় প্রমাণ করল, বিজেপি তথা প্রধানমন্ত্রীর ডবল ইঞ্জিনের তত্ত্বও যে আসলে ভুয়ো, তা বুঝতে দেশের মানুষের অসুবিধা হয়নি। মহারাষ্ট্র, গোয়া, কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশ এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতা কিনেছে শত সহস্র কোটি টাকা ছড়িয়ে এমএলএ কেনার মাধ্যমে।

তা হলে বিজেপি গুজরাটে জয়ী হল কী করে? বাস্তবে এ বার গুজরাট নির্বাচনটা ছিল একদিকে বিজেপি, গুজরাট সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সম্মিলিত শক্তি এবং অন্য দিকে নেতৃত্বহীন, ছন্নছাড়া কংগ্রেস এবং সংগঠনহীন আপের মধ্যে। গুজরাটে ১৯৯৫ থেকে টানা ২৭ বছর রাজত্ব করছে বিজেপি। নেতৃত্ব এবং প্রশাসনের অপদার্থতা, ব্যাপক দুর্নীতি, মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি প্রভৃতি মিলিয়ে জনগণের ক্রমাগত বাড়তে থাকা ক্ষোভের কথা বিজেপি নেতৃত্বের ভালই জানা ছিল। তাঁদের এ-ও ভাল করেই জানা ছিল যে, গুজরাটে বিজেপির পরাজয় মানেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্পর্কে যে সুপারম্যান ভাবমূর্তি বিজেপি নেতারা শত-সহস্র কোটি টাকা ব্যয় করে সংবাদমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে কৃত্রিমভাবে গড়ে তুলেছেন তা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়া। ফলে গুজরাট নির্বাচন প্রেস্টিজ ইসু ছিল বিজেপির কাছে। বিজেপি নেতৃত্বের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপিকে দেশ জুড়ে পরাজয়ের হাত থেকে বাঁচতে গুজরাটে তাঁদের যে কোনও ভাবে জিততে হবে। অর্থাৎ গুজরাট নির্বাচনে জয়ী হওয়াটা লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির গ্রহণযোগ্যতার সঙ্গে যুক্ত। নরেন্দ্র মোদি অমিত শাহরা এটাও পরিষ্কার বোঝেন যে, গুজরাট নির্বাচনে পরাজিত হলে, দেশ জুড়ে জনমনে যে ক্ষোভ বিজেপি শাসনের বিরুদ্ধে জমা হয়েছে, তার আরও বিস্ফোরণ ঘটবে। তাই গুজরাটে জিততে তাঁরা জান কবুল করেছিলেন। জয় ছিনিয়ে আনার জন্য যা করা প্রয়োজন তা করতে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন–কার্যত কোনও রাস্তাই বাকি রাখেননি।

তাই মুখ্যমন্ত্রী পদে মুখবদল করতে গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে বিজয় রূপাণিকে সরিয়ে ভুপেন্দ্র পটেলকে নিয়ে আসা হয়। জনমনে ইমেজ ভাল না থাকায় গতবার জেতা ৪২ জন বিধায়ককে এ বার নির্বাচনে প্রার্থী করা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত ছ’মাস ধরে গুজরাটে কার্যত ডেলি প্যাসেঞ্জারি করেছেন। রাজ্য এবং কেন্দ্র উভয় সরকারকে দিয়ে অজস্র প্রকল্প ঘোষণা করেছেন, অজস্র শিলান্যাস করেছেন। কেন্দ্র ও রাজ্যের গোটা প্রশাসনকে বিজেপি নেতাদের নির্বাচনী প্রচারে কাজে লাগানো হয়েছে। হিমাচল এবং গুজরাট উভয় নির্বাচনেই যাতে প্রধানমন্ত্রী যথেষ্ট সময় দিতে পারেন, তাই অন্যায় ভাবে নির্বাচন কমিশনকে বাধ্য করা হয়েছে গুজরাট নির্বাচনকে পিছিয়ে দিতে। অমিত শাহ নিজে দায়িত্ব নিয়েছেন গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়ার পরিচালনার। তারপরও বিজেপি নেতারা নিশ্চিন্ত হতে পারেননি। উস্কে তুলেছেন সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাকে, কাজে লাগিয়েছেন মেরুকরণকে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রকাশ্য জনসভায় গুজরাট গণহত্যার উল্লেখ করে সংখ্যালঘুদের উচিত শিক্ষা দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন।

এই সব কিছুর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বিজেপির নীতিহীন নির্বাচনী কৌশল। সারা দেশের মতোই গুজরাট জুড়েও জাতপাত-ধর্মবর্ণের বিভেদকে পুরোমাত্রায় কাজে লাগিয়েছে বিজেপি। পাতিদারদের ক্ষোভকে স্তিমিত করতে যেমন ভূপিন্দর পটেলকে মুখ্যমন্ত্রী করেছে, তেমনই যে হার্দিক পটেল এবং অল্পেশ ঠাকুর পিছিয়ে পড়া মানুষদের দাবি তুলে ধরে তাদের নেতা হিসাবে উঠে এসেছিলেন, নানা কৌশলে তাঁদের দলে নিয়ে এসে সেই পিছিয়ে পড়া মানুষদের ভোট কবজা করেছে।

সংবাদমাধ্যম গুজরাট নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রিভিউ লেখার সময় বারবার দেখিয়েছে সাধারণ মানুষ কতটা অসহায়। হিন্দু-মুসলমান, উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণ নির্বেশেষে ছোট ব্যবসায়ী, খেটে খাওয়া মানুষ একবাক্যে বলেছেন বিজেপি শাসন তাঁদের দুর্দশা বাড়িয়েছে। একই সঙ্গে তাঁরা বলেছেন, এর বিরুদ্ধে দাঁড়াবে এমন শক্তি কোথায়? কংগ্রেস এবং আপ যারা বিজেপির বিরোধী বলে পরিচিত, তারা জনগণের দাবি নিয়ে কোথাও আন্দোলন গড়ে তোলেনি। দু’দলই বিজেপির পাল্টা রাজনীতি বলতে নরম বা গরম হিন্দুত্বেরই আশ্রয় নিয়েছে। দুই পক্ষের নেতারাই মন্দিরে মন্দিরে ঘুরেছেন। এমনকি অমিত শাহ সরাসরি গুজরাট গণহত্যার জন্য আস্ফালন করলেও হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক হারানোর ভয়ে কংগ্রেস কিংবা আপ কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খোলেনি। আপ যাদের প্রার্থী করেছিল তাদের অনেকেই আবার বিজেপির দরজায় লাইন দিয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। ফলে অসহায় মানুষ বিকল্প রাজনীতি খুঁজলেও তা পাননি।

গুজরাটে এক এসইউসিআই (সি) ছাড়া অন্য বামপন্থী দলগুলি বাম-গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলার দায়িত্ব কার্যত ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে। অসহায় মানুষ ক্ষোভ জানিয়েছেন, কিন্তু সুরাহার পথ পাননি। ফয়দা তুলেছে বিজেপি।

নির্বাচনী প্রচারে কিছুক্ষণের জন্য হলেও মানুষকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল তার জীবনের আসল দাবিগুলি। এই বুর্জোয়া নির্বাচন সম্পর্কেই বহু দিন আগে এ যুগের অন্যতম মা’র্বাদী চিন্তানায়ক শিবদাস ঘোষ দেখিয়ে গিয়েছেন, নির্বাচন আসলে একটি বুর্জোয়া রাজনীতি। সরকারি দলগুলি যখন তাদের বিরাট টাকার থলি, পেশিশক্তি নিয়ে নির্বাচনে নামে, পুঁজিপতিদের নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যমগুলি যখন সমস্বরে তাদের প্রচার দিতে থাকে, তখন জনসাধারণ সেই প্রচারে উলুখাগড়ার মতো ভেসে যায়। গুজরাট নির্বাচনে ঠিক সে জিনিসটিই ঘটেছে। বিজেপি সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে জনগণের প্রবল ক্ষোভ সত্তে্বও বিপুল প্রচারে বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি, দারিদ্রের মতো জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি কার্যত ভেসে গিয়েছে।

আবার হিমাচলে বা দিল্লিতে যে বিজেপি পরাজিত হয়েছে তার দ্বারা জনগণের দাবিগুলিই জয়ী হয়েছে–এমনটাও একেবারেই নয়। বুর্জোয়াদেরই পাল্টাপাল্টির রাজনীতিতে জনগণ বোড়ে হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে এই ফল প্রমাণ করেছে যে বিজেপি কোনও অপ্রতিরোধ্য শক্তি নয়। মানুষ শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়ালে তাকে অনায়াসেই পরাজিত করা যায়। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বিজেপি কোনও অপরাজেয় শক্তি নয়।

তবু যতক্ষণ না জনগণ তাদের জীবনের দাবিগুলি নিয়ে লড়াই তথা গণআন্দোলনের হাতিয়ার হিসাবে সংগ্রামের কমিটি গড়ে তুলে নিজস্ব শক্তির জন্ম দিতে পারছে তত দিন পুঁজিপতিদেরই একটি দলের বদলে আর একটি দল জনগণের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় গিয়ে বসবে। জনগণও একটি দলের পরিবর্তে আর একটি দলকে নির্বাচিত করতে বাধ্য হয়ে বুর্জোয়া রাজনীতির ফাঁদে পড়ে প্রতারিত হতে থাকবে।

 

গুজরাটে বিধায়কদের ৮৩ শতাংশ কোটিপতি, ২২ শতাংশ অপরাধে অভিযুক্ত

গুজরাট বিধানসভার জয়ী নতুন বিধায়কের সংখ্যা ১৮২ জন। এর প্রতি ১০ জন বিধায়কের ৮ জনই (৮৩ শতাংশ) বহুকোটি টাকার মালিক। প্রতি ১০ জন বিধায়কের মধ্যে ২ জন (২২ শতাংশ) বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্ত। অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস (এডিআর) এই তথ্য প্রকাশ করেছে।  (টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ১২.১২.২২)

বিজেপির সর্বভারতীয় চরিত্রের স্বরূপ

২৯টি রাজ্যের মধ্যে মাত্র ৬টিতে বিজেপির স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে

অন্য দিকে বিজেপির সিকিমে আসন সংখ্যা ৩১-এর মধ্যে ১২, মিজোরামে ১টি, তামিলনাড়ূতে ৪টি, অন্ধে্র ১৭৫টির মধ্যে ০, কেরালায় ১৪০টির মধ্যে ০, পাঞ্জাবে ১১৭টির মধ্যে ২, বাংলায় ২৯৪টির মধ্যে ৭৪, তেলেঙ্গানায় ১১৯-এর মধ্যে ৩, দিল্লিতে ৭০টির মধ্যে ৮, ওড়িশায় ১৪৭ এর মধ্যে ২২, নাগাল্যান্ডে ৬০টির মধ্যে ১২, বিহারে ২৪৩টির মধ্যে ৭৪।

যে রাজ্যগুলিতে বিজেপি জোট সরকার আছে সেখানে বিজেপির আসনের অবস্থান

মেঘালয়ে ৬০টির মধ্যে ২, জম্মু ও কাশ্মীরে ৮৭টির মধ্যে ২৫, গোয়ায় ৪০টি আসনের মধ্যে ১৩টি।সারা দেশে মোট ৪১৩৯টি বিজেপির বিধানসভা আসনের মধ্যে ১৫১৬টি আসন রয়েছে যার মধ্যে ৯৫০টি আসন গুজরাট, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, ইউপি, এমপি, রাজস্থানের মতো ৬টি রাজ্যের। এটা পরিষ্কার, বিজেপির কোনও ঢেউ বা ঝড় নেই। (সোসাল মিডিয়ায় প্রাপ্ত)