রেল দেশের লাইফলাইন। কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার চাইছে তাকে বৃহৎ পুঁজিগোষ্ঠীর হাতে তুলে দিতে। এই পরিকল্পনাতেই বিজেপি সরকারের সাহায্যে আদানি গোষ্ঠী রেলে ইতিমধ্যেই সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে। তা আরও বিস্তৃত করতে নেমে পড়েছে তারা। ২০২৫ সালের মধ্যে দু’হাজার কিলোমিটার রেলপথের মালিকানার লক্ষ্যে আদানি ভারতীয় রেলের সঙ্গে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ করে এগোতে চাইছে। এই উদ্দেশ্যে বিডিআরসিএল, ধামড়া, সারগুজা, মুন্দ্রা, কৃষ্ণাপতনম রেল কোম্পানি এবং কচ্ছ রেল (মোট ৬৯০ কিলোমিটার রেলপথ হিসাবে) এই ৬টি সংস্থাকে আদানি ট্র্যাক ম্যানেজমেন্ট সার্ভিসেস নামে একটি সংস্থার অন্তর্ভুক্ত করেছে (আদানি বন্দর এবং স্পেশাল ইকনমিক জোনের একশো শতাংশ রয়েছে এর কবজায়)।
আদানির এতটা আগ্রহের কারণ কী? রেলপথে বিনিয়োগ বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে সুরাহা দেওয়া, নাকি অতি মুনাফা? দ্রুতগামিতার জন্য, বিশেষ করে অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত কারণে সড়ক পরিবহণ থেকে রেল পরিবহণ প্রাধান্য পেয়েছে সরকারের কাছে। কিন্তু এই প্রাধান্য দেওয়ার ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে দু’রকম দৃষ্টিভঙ্গি। কর্পোরেট সংস্থার ব্যবসায় সুবিধার জন্য অত্যাধুনিক ফ্রেট করিডর সহ নানা পরিকল্পনা এবং তার রূপায়ণ চলছে দ্রুতগতিতে, প্রতি বছর সেখানে লক্ষ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ করছে সরকার। অথচ নিত্যযাত্রী সাধারণ মানুষের সুযোগসুবিধার জন্য রেলের পরিকাঠামো উন্নত করা এবং রেলযাত্রা সুলভে করা দূরে থাক, সেই খাতের বাজেটে বরাদ্দ ক্রমশ কমছে, বাড়ছে টিকিটের দাম। ২০২২-এর কেন্দ্রীয় বাজেটে কোনও কোনও লাইনে মাত্র এক হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এই নামমাত্র টাকায় কী উন্নয়ন করা সম্ভব তা সরকারই বলতে পারবে! স্বাভাবিকভাবেই সরকারের এই কর্পোরেট-প্রীতির পূর্ণ সুযোগ নিচ্ছে বেসরকারি পুঁজিমালিকরা। একদিকে সরকারি অর্থে গড়ে ওঠা রেলপথকে ব্যবহার করে, অন্য দিকে লাভের হিসাব কষে তারা রেলের মতো রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রকে কবজা করতে বিশাল পুঁজি নিয়ে নেমে পড়েছে। সুতরাং মুখে সরকারি নেতা-মন্ত্রীরা যতই ভাল ভাল কথা বলুন না কেন, একচেটিয়া পুঁজিমালিক এবং তার প্রসাদধন্য সরকার বাস্তবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানের মতোই রেল পরিষেবার সম্পূর্ণ ক্ষেত্রটিকেই যথেচ্ছ ব্যবসার খোলা মাঠ হিসেবে ছেড়ে দিচ্ছে।
আদানি গোষ্ঠী রেলে প্রথমে মালিকানার অংশীদার হয় পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের ভিত্তিতে এবং শেষ পর্যন্ত তার একচেটিয়া দখল নেয়। রেলপরিবহণ ব্যবসাকে কেন্দ্রীভূত করার মাধ্যমে ধনকুবের আদানি বিশাল পুঁজি বিনিয়োগ করে রেলের সাথে যুক্ত নানা ব্যবসায় ঢোকার সুযোগ পাবে। এর মাধ্যমে তারা সরাসরি ওয়াগন ও রেকের ব্যবসায় ঢুকতে পারবে। চার বছর আগে ভারতীয় রেল নিজে যে সমস্ত পণ্য পরিবহণ করত, সেই কয়লা, লৌহ আকরিক, খনিজ দ্রব্যের মতো পণ্য পরিবহণও এবার চলে আসবে আদানিদের আওতায়। ইতিমধ্যেই দেশের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রেলস্টেশন, বন্দর ও সমুদ্র-বন্দর আদানি গোষ্ঠীর হাতে এসে গিয়েছে।
কর্পোরেট পুঁজি যেমন সবদিক থেকে বিজেপিকে সাহায্য করছে, তেমনি বিজেপিও দেশের শাসক হিসেবে কর্পোরেট পুঁজির সর্বোচ্চ মুনাফার স্বার্থে সমস্ত আইন, বিধি ও নীতিকে নতুন করে তৈরি করছে। দেশের যাবতীয় সম্পদ লুট থেকে শুরু করে অর্থনীতিতে কর্পোরেট পুঁজির পূর্ণ কর্তৃত্ব কায়েমে সব দিক থেকে মদত দিয়ে চলেছে বিজেপি সরকার। ২০২২-এর কেন্দ্রীয় বাজেটে কর-সারচার্জ ১২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৭ শতাংশ করে দেওয়ার মতো বেশ কিছু ছাড় একচেটিয়া পুঁজিপতিদেরদিয়েছে। এর ফলে জনগণের ঘাড়ে মূল্যবৃদ্ধির আরও বোঝা চাপবে।
ফলে রেল সহ নানা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা, সেগুলির নানা অনুসারী শিল্প এবং দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ পরিবহণের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি চলে যাবে দিনে ১০০২ কোটি টাকা আয়ের মালিক আদানি গোষ্ঠীর হাতে। ৬.৭২ লক্ষ কোটি টাকার মালিক আদানি মুনাফা আরও বাড়ানোর উদ্দেশ্যে রেলপথকে ব্যবহার করে যে সাধারণ মানুষকে আরও লুঠ করবে, তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার।
(তথ্যসূত্রঃ টাইমস অফ ইন্ডিয়া ৩১ জানুয়ারি, ২০২২)