Breaking News

চাষ অলাভজনক, অর্ধেক কৃষক পরিবারই ঋণগ্রস্ত

ভারতে গণবিক্ষোভের ভরকেন্দ্র এখন কৃষক সমাজের মধ্যে। দিল্লির কৃষক আন্দোলন গত এক বছরে এমন এক উচ্চতায় পৌঁছেছে যে রাষ্ট্র তার দমন পীড়নের বাহিনী দিয়ে আন্দোলনকে সামাল দিতে পারছে না। কারণ এর পেছনে আছে কোটি কোটি মানুষের সমর্থন। কেন এই আন্দোলন সকলেই জানেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আনা তিনটি কালা কৃষি আইন এবং জনবিরোধী বিদ্যুৎ বিল (সংশোধনী)-২০২১ অবশ্যই এই বিক্ষোভের প্রত্যক্ষ কারণ। কিন্তু হঠাৎ এই বিক্ষোভ ফেটে পড়ল বিষয়টা তো এমন নয়। ভারত জুড়ে কৃষক মন অসন্তোষের বারুদে ভরা না থাকলে এমন বিষ্ফোরণ ঘটতে পারে না। তা হলে কী সেই কারণ?

কারণটি সম্প্রতি তুলে ধরেছে এন এস এস ও-র সমীক্ষা। দেখিয়েছে, গোটা দেশের ৯ কোটি ৩০ লক্ষ কৃষক পরিবারের মধ্যে অর্ধেকই ঋণগ্রস্ত। পশ্চিমবঙ্গের চিত্রটিও তাই। রাজ্যে ৬৬ লক্ষ ৯০ হাজার কৃষক পরিবারের ৫০ শতাংশ ঋণগ্রস্ত। কেন এত ঋণগ্রস্ততা? এর কারণ প্রধানত দুটো। এক, চাষের খরচ অত্যধিক বেড়েছে। সার বীজ কীটনাশক, সেচের জন্য ডিজেল বিদ্যুৎ সহ সব কৃষি উপকরণের দাম আকাশছোঁয়া। এগুলির উপর সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। পুরোটাই দেশি-বিদেশি একচেটিয়া পুঁজিপতিদের নিয়ন্ত্রণে। এরই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তথাকথিত পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের শর্ত মেনে পুঁজিবাদী সরকারের ব্যাপক হারে ভর্তুকি ছাঁটাই বা তুলে দেওয়া।

দ্বিতীয় কারণটি হল, ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়া, সরকারি ক্রয় ক্রমাগত কমে যাওয়া এবং তার সুযোগে ফড়ে পাইকার তথা বৃহৎ ব্যবসায়ীদের খপ্পরে চাষির অভাবি বিক্রিতে বাধ্য হওয়া। ব্যাঙ্ক থেকে স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়ার অভিজ্ঞতা যাদের আছে তারা জানেন, ব্যাঙ্ক পুঁজিপতিদের ঋণ দিতে দরাজহস্ত, কিন্তু চাষির বেলায় নাকি তা ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে নানা শর্তের বাহানা চলে। চাষি তখন বাধ্য হয় মহাজনের থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে। সে সুদ কোথাও কোথাও প্রায় মোট ঋণের সমান হয়ে দাঁড়ায়। ঋণের এই জাল থেকে চাষি বেরোতে পারে না।

সমীক্ষা দেখিয়েছে, দেশে কৃষক পরিবারের গড় আয় মাসিক ১০,২১৮ টাকা। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে আয় আরও কম, যেহেতু এখানে মাথাপিছু জমির পরিমাণ কম। পশ্চিমবঙ্গে চাষি পরিবারের গড় আয় মাসে ৬,৭৬২ টাকা। এই আয়ের সামান্য অংশই আসে ফসল বেচে। অর্থাৎ চাষ থেকে আসে মাত্র ২২.৮ শতাংশ, অর্থাৎ ১৫৪২ টাকার মতো। বাকিটা আসে অন্যের জমিতে মজুরি, ১০০ দিনের কাজ, ঠ্যালা বা ভ্যান চালানো এবং ছোটখাটো ব্যবসা থেকে। ফলে চাষিকে বাধ্য হয়ে চাষে গুরুত্ব কমাতেই হচ্ছে, অন্য পেশায় যেতে হচ্ছে।

চাষকে অলাভজনক করে দেওয়া একটা মারাত্মক পুঁজিবাদী ষড়যন্ত্র। স্বাধীনতার পর কংগ্রেস সরকার এবং বর্তমান বিজেপি সরকারের হাত ধরে কৃষির এই দুর্দশা হয়েছে। এখন মোদি সরকার ষড়যন্ত্র করছে কৃষিতে বৃহৎ কর্পোরেটদের ঢুকিয়ে ফসল উৎপাদন থেকে শুরু করে বিপণন সবটাই কুক্ষিগত করে তাদের বিপুল মুনাফার নয়া পথ করে দিতে। এতে শুধু কৃষক সর্বস্ব হারাবে তা নয়, অন্য সমস্ত পেশার সাধারণ মানুষও বিপন্ন হবেন। খাদ্যের বাজার হবে কল্পনাতীতভাবে দুর্মূল্য। কারণ, খাদ্যের বা ফসলের একমাত্র ক্রেতা হবে পুঁজিপতিরা। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন না থাকায় পুঁজিপতিরা ইচ্ছামতো খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটাতে পারবে।

গণদাবী ৭৪ বর্ষ ১৩ সংখ্যা ৫ নভেম্বর ২০২১