দেশে প্রতি সাড়ে ১২ মিনিটে যখন এক জন করে কৃষক আত্মহত্যা করে চলেছেন এবং এই ভাবে ঋণের ফাঁসে আত্মহত্যাকেই তাঁদের একমাত্র ভবিষ্যৎ ধরে নিয়ে সরকার যখন পরম নিশ্চিন্তে গোটা কৃষিক্ষেত্রটাকেই আম্বানি-আদানিদের মতো কর্পোরেট পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দিতে কৃষি আইনটাই বদলে ফেলল, তখন কৃষকদের আর পিছনোর জায়গা থাকল না, পিঠ ঠেকল দেওয়ালে। এই অবস্থায় দাঁতে দাঁত চেপে বুক চিতিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন দেশের কৃষকরা। সে দাঁড়ানো যে কী, তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে একচেটিয়া পুঁজির রাজনৈতিক ম্যানেজার, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। ঘণ্টায় ঘণ্টায় বৈঠকে বসছেন মন্ত্রীরা, বিজেপির তাবড় সব নেতারা। কিন্তু হায়, সরকার শর্ত দেবে কি, শর্ত যে দিচ্ছে কৃষকরাই! এবং একমাত্র শর্ত– কোনও জোড়াতালির সংস্কার নয়, জনবিরোধী কৃষি আইন সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করতে হবে।
দেশের আমজনতা যখন করোনা অতিমারিতে বিধ্বস্ত, গ্রামীণ কৃষক-খেতমজুর যখন সপরিবারে অনাহারের যন্ত্রণায় ছটফট করছে, ঠিক সেই সময় কেন্দ্রের বিজেপি সরকার মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা মারল। দেশের গোটা কৃষি ব্যবস্থাটাকেই কৃষিপণ্যের একচেটিয়া কারবারিদের হাতে তুলে দিতে তিনটি কৃষি আইন পার্লামেন্টে পাশ করিয়ে নিল। পাশ করাল গায়ের জোরে, সম্পূর্ণ একতরফা ভাবে। যে আইনের ফল সুদূরপ্রসারী তা তৈরি ও কার্যকর করার আগে পার্লামেন্টে কোনও বিতর্কের সুযোগ দেওয়া হল না। যে কৃষকদের জীবন সুখ সাগরে ভাসানোর জন্য এই আইন বলে প্রধানমন্ত্রী সহ সব বিজেপি নেতারা ঘন ঘন ঘোষণা করছেন, সেই কৃষকদের সাথে, তাঁদের সংগঠনগুলির সাথেও কোনও আলোচনা তাঁরা করলেন না। শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে দেশের কৃষকদের উপর এই আইন চাপিয়ে দিল বিজেপি সরকার। একই ভাবে, নতুন বিদ্যুৎ আইনে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বেসরকারিকরণ, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি এবং বিদ্যুতে কৃষকদের ভর্তুকি বন্ধ করার কথা বলা হয়েছে। কৃষি আইনের সাথে জনবিরোধী বিদ্যুৎ আইনেরও নিঃশর্ত প্রত্যাহার দাবি করেছেন কৃষকরা।
স্বাভাবিক ভাবেই তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়েছে কৃষক সমাজ। পাঞ্জাবের অপেক্ষাকৃত সংগঠিত কৃষকরা শুরু থেকেই নয়া কৃষি আইনের প্রতিবাদে আন্দোলনে নেমে পড়েছেন। দাবি করেছেন, নিঃশর্তে কৃষি আইন প্রত্যাহারের। লাগাতার ধরনায় বসেন তাঁরা। কিন্তু তাঁদের প্রতিবাদে কান দেয়নি সরকার। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়তে থাকে দেশজুড়ে। শুধু পাঞ্জাব নয়, গোটা উত্তর ভারত সহ সারা দেশের কৃষকরাই যোগ দেয় আন্দোলনে। গড়ে ওঠে ২৫০টি কৃষক সংগঠনের সংযুক্ত কমিটি। ২৫ সেপ্টেম্বর গ্রামীণ ভারত বনধের ডাক দেয় তারা এবং তা অভূতপূর্ব ভাবে সফল হয়। এরপরও যখন সরকার চোখ-কান বন্ধ করে থাকল তখন কৃষকদের সংযুক্ত কমিটি ২৬-২৭ নভেম্বর পার্লামেন্ট অভিযানের ডাক দেয়। কিন্তু বিজেপি সরকার দিল্লির পথে রাজ্যে রাজ্যেই তাঁদের আটকে দেওয়ার চেষ্টা করে। জল কামান চালায়, লাঠিচার্জ করে, রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড করে দেয়। কিন্তু সব বাধা তুচ্ছ করে হাজার হাজার কৃষক পৌঁছে যায় রাজধানীর দোরগোড়ায়। সেখানে বিশাল পুলিশ বাহিনী আরও বড় ব্যারিকেড করলে কৃষকরা দিল্লি ঢোকার সমস্ত রাজপথ আটকে বসে যায়। আরও হাজার হাজার কৃষক আন্দোলনে যোগ দিতে থাকেন। প্রায় চল্লিশ হাজার মহিলা কৃষক আন্দোলনে যোগ দেন। কৃষকদের উপর বিজেপি সরকারের দমন নীতির প্রতিবাদে অনেক খ্যাতনামা মানুষ সরকারি খেতাব প্রত্যাখান করেন। রাজ্যে রাজ্যে আন্দোলনের সমর্থনে এগিয়ে আসে বিভিন্ন সংগঠন এবং সাধারণ মানুষ। ছাত্র-যুব-মহিলা-শ্রমিক সংগঠনগুলি আন্দোলনের সমর্থনে এগিয়ে আসে। এক দিকে প্রবল কৃষক বিক্ষোভের চাপ, অন্য দিকে আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করতে সরকার আইনে কতকগুলি মামুলি পরিবর্তনের আশ্বাস দেয়। কৃষকরা তীব্র ঘৃণায় তা প্রত্যাখান করে এবং সম্পূর্ণ আইন প্রত্যাহারের দাবিতে ৮ ডিসেম্বর ভারত বনধের ডাক দেয়।
দেখে নেওয়া যাক, কী সেই নীতি যার বিরুদ্ধে আজ সারা দেশের কৃষক সমাজ পথে নেমেছে। প্রতিবাদ প্রতিরোধের শপথ নিচ্ছে। বিজেপি সরকার কৃষি আইনে তিনটি সংশোধন করেছে– প্রথমটি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য (সংশোধনী) আইন। এই আইনের বলে যে কোনও বহুজাতিক কোম্পানি বা ব্যবসায়ী কৃষিপণ্য কিনে যত খুশি মজুত করে রাখতে পারবে। দ্বিতীয়টি কৃষকদের (ক্ষমতায়ন ও সুরক্ষা) দামের আশ্বাস ও খামার পরিষেবা চুক্তি আইন। এই আইনের বলে বহুজাতিক কোম্পানিগুলি চুক্তিচাষের মাধ্যমে যে কোনও পণ্য কৃষকদের দিয়ে উৎপাদন করিয়ে নিতে পারবে। তৃতীয়টি, কৃষকের উৎপাদিত, কারবার ও বাণিজ্য (উন্নয়ন ও সুবিধা) আইন। এই আইনের বলে রাজ্য সরকার নিয়ন্ত্রিত রেগুলেটেড মার্কেট বা মান্ডির বাইরেও কৃষকরা যে কোনও ব্যবসায়ী বা বাণিজ্য সংস্থার কাছে তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে পারবে। সংক্ষেপে এই হল এই তিনটি আইনের মর্মবস্তু।
আইন কার স্বার্থে
বিজেপির মন্ত্রীরা বলছেন, এতদিন কৃষকরা ফড়েদের হাতে পড়ে পড়ে মার খাচ্ছিল, এখন এই আইন বলে তাঁরা ‘যে দাম চায় সেই দামেই দেশের যে কোনও প্রান্তে তাদের কৃষিপণ্য বিক্রি করতে পারবে।’ কৃষকরা যে দাম চায় সে দাম তাদের কে দেবে? সরকার? স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ ছিল– ফসলের উৎপাদন খরচের দেড়গুণ দাম ন্যূনতম সহায়ক মূল্য হিসাবে নির্ধারণ করা। এতদিন যে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সরকার ঘোষণা করত, তাতে কি সরকার এই সুপারিশ মেনেছিল? নানা অছিলায় সবসময় তা তারা এড়িয়ে গেছে। নতুন আইনে তো সরকার কৃষিক্ষেত্র থেকেই পুরোপুরি হাত তুলে নিয়েছে এবং নূ্যনতম সহায়ক মূল্য কথাটাই আইনে কোথাও রাখেনি। প্রতি বছর কৃষির খরচ লাফিয়ে বাড়ছে। সার, বীজ, কীটনাশক, বিদ্যুৎ, ডিজেলের দাম পুঁজিপতিরা ইচ্ছামতো বাড়িয়ে চলেছে। দেশের কৃষকদের ৮৬ শতাংশই ক্ষুদ্র কিংবা প্রান্তিক চাষি। একটা অংশ ভাগচাষি, যাদের নিজেদের জমি নেই। ফলে বেশির ভাগ চাষিরই ক্ষমতা নেই চাষের এই বিপুল খরচ বহন করার। তাদের এই খরচ মেটানোর জন্য ঋণ করতে হয়। নানা প্রশাসনিক জটিলতা, সরকার এবং ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের জনবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এই ছোট চাষিদের বেশির ভাগই ব্যাঙ্কঋণ পায় না। তাদের ঋণ নিতে হয় মহাজনদের থেকে। সেই ঋণের সুদ অকল্পনীয় রকমের চড়া, কখনও দেড়শো থেকে দুশো শতাংশ পর্যন্ত।
প্রধানমন্ত্রী কিংবা বিজেপির যে-সব নেতা-মন্ত্রী নতুন কৃষি আইনকে কৃষকের স্বার্থরক্ষার আইন বলছেন, তাঁদের প্রথম এই প্রশ্নের জবাব দিতে হবে যে, নতুন আইনে কৃষির অস্বাভাবিক রকমের বেশি খরচ কমানোর কী ব্যবস্থা রয়েছে? বীজ, সার, কীটনাশক, বিদ্যুৎ এবং তেলের কোম্পানিগুলি যে গরিব চাষির ঘাম-রক্ত শুষে নেয়, রয়েছে নাকি নতুন আইনে তা বন্ধ করার ব্যবস্থা? নতুন আইনে কি ক্ষুদ্র চাষি, ভাগচাষি, মধ্যচাষিদের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি থেকে বিনা সুদে কিংবা নামমাত্র সুদে ঋণের ব্যবস্থার কথা রয়েছে? বেসরকারি তথা মহাজনী ঋণের কারবার আর চালানো যাবে না– এ কথা কি বলা রয়েছে? নতুন আইনে কি বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে অর্থাৎ খরা, বন্যা, কীটের উৎপাতে যদি ফসল নষ্ট হয়ে যায় তবে সরকার সেই ক্ষতি পূরণ করে দেবে? বলা হয়েছে কি যে, চাষির খরচ হিসাব করে ন্যায্য তথা লাভজনক দাম সরকার বেঁধে দেবে এবং বহুজাতিক কোম্পানিগুলি সেই দামে তা কিনতে বাধ্য থাকবে? আইনের উদ্দেশ্য যদি কৃষককে লাভজনক দাম পাইয়ে দেওয়া হয়, তবে আইনে এই সব বিষয়ের উল্লেখ মাত্র নেই কেন? তবে কি চাষিদের চাওয়া দাম দেবে রিলায়েন্স, আদানি, পেপসিকোর মতো বহুজাতিক কোম্পানিগুলি? শুনলে বোধহয় ঘোড়াতেও হাসবে। অন্ধ না হলে এবং যুক্তির মূল্য দিলে কোনও বিজেপি নেতাও কি এ কথা বিশ্বাস করবেন? নতুন কৃষি আইনে কোথাও কৃষকের ন্যায্য দাম পাওয়ার কথাটি উল্লেখই করা হয়নি। এই না থাকাটা নিশ্চয় অনিচ্ছাকৃত নয়।
বাস্তব বলছে, নতুন কৃষি আইনে কৃষকের জীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলির কোনওটিরই উল্লেখমাত্র নেই। নেই সমাধানের কোনও দিকনির্দেশ। তা হলে, এই সমস্যাগুলিকে জিইয়ে রেখে কী ভাবে কৃষকদের মঙ্গলের কথা ভেবেছেন বিজেপি নেতারা?
শিক্ষা-স্বাস্থ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার সময় সরকার প্রথমে সরকারি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলিকে ধ্বংস করেছিল। এ ক্ষেত্রেও ঠিক একই উদ্দেশ্য সরকারের। সরকারি পরিচালনায় কৃষিপণ্যের যতটুকু দাম পাওয়ার ব্যবস্থা এখনও আছে তাকেই ধ্বংস করে দিচ্ছে সরকার। বিভিন্ন রাজ্য সরকারের পরিচালনায় এ দেশে বড় বড় নিয়ন্ত্রিত বাজার বা মান্ডির সংখ্যা ২৪৭৭ এবং ছোট মান্ডির সংখ্যা ৪৮৪৩টি। কৃষকরা এই সব বাজারে কৃষিপণ্য নিয়ে যায় এবং সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি করে। লাইসেন্সপ্রাপ্ত এজেন্ট ছাড়া কোনও ব্যবসাদার কিংবা খাদ্যপণ্যের বৃহৎ ব্যবসায়ী এখানে চাষির কাছ থেকে কৃষিপণ্য কিনতে পারে না। এর ফলে কৃষক সরকারি সহায়ক মূল্যে তার পণ্য বিক্রি করতে পারে। যদিও এর মধ্যে প্রচুর দুর্নীতি হয় এবং তার বিরুদ্ধে কৃষকদের লড়াই করতে হয়। তবুও সরকারের তত্ত্বাবধানে বিপুল পরিমাণ কৃষিপণ্য এই সব মান্ডিতে বেচাকেনা হয়। তাই এই মান্ডি বা নিয়ন্ত্রিত বাজার কৃষকদের কিছুটা হলেও দাম পেতে সাহায্য করে।
এখন কী হবে? মান্ডির বাইরে যথেচ্ছ কৃষিপণ্য কেনার অধিকার থাকায় বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বিপুল পুঁজি নিয়ে ময়দানে নামবে, প্রয়োজন হলে প্রথম দিকে মান্ডির থেকে কিছুটা বেশি দাম দেবে এবং শেষ পর্যন্ত এই সব মান্ডিগুলোকে ধ্বংস করে দেবে। আর সরকার তো এই সব বহুজাতিক পুঁজির ক্রীতদাস। তারা এই প্রক্রিয়া সফল করতে পুঁজিপতিদের সাহায্য করবে। সরকার ইতিমধ্যে মান্ডিগুলোকে হীনবল করে ফেলবে, ঠিক মতো অর্থবরাদ্দ করবে না, সেখানে ঠিক মতো কেনাবেচা হবে না, শেষপর্যন্ত রুগ্ন হয়ে মান্ডিগুলো এক এক করে বন্ধ হতে থাকবে। তখন বহুজাতিক পুঁজির সামনে একেবারে খোলা মাঠ। কৃষকরা গিয়ে পড়বে বহুজাতিক পুঁজির খপ্পরে। কৃষকদের জন্য নূ্যনতম সহায়ক মূল্যের প্রতিশ্রুতি আইনে কোথাও নেই। কোম্পানিগুলি যতটুকু দাম দেবে কৃষকরা সেই দামেই বিক্রি করতে বাধ্য হবে।
চুক্তিচাষ
কৃষকরা যে ফসল উৎপাদন করবে বহুজাতিক কোম্পানিগুলি তা-ই কিনবে, বিষয়টা এমনও নয়। তারা কিনবে তাদের পছন্দমতো জিনিস। অর্থাৎ যে জিনিসের বাজার আছে, যে জিনিস বিক্রি করে প্রচুর মুনাফা ঘরে তোলা যাবে। আর এই জন্য দরকার চুক্তি চাষ। দ্বিতীয় আইনে সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। চুক্তি হবে কাদের মধ্যে? বহুজাতিক কোম্পানির সাথে দুই“তিন বিঘা জমির মালিকদের। দাম ঠিক করবে কে? বহুজাতিক কোম্পানি। পণ্যের গুণমান ঠিক করবে কে? বহুজাতিক কোম্পানি। আইনে বলা হয়েছে, কৃষকের কাছ থেকে পণ্য নেওয়ার সময় তিন ভাগের দু’ভাগ দাম দিতে হবে। বাকি টাকা পণ্যের গুণমান ঠিক করার পর দিতে হবে। এখানেই রয়েছে আইনের প্যাঁচ। কোম্পানিগুলো সততার মূর্ত প্রতীক নয়। তারা বলবে তোমার পণ্য উপযুক্ত গুণমানের নয়। ফলে আর কোনও টাকা পাবে না। কী করবে কৃষক? এই সব বহুজাতিক কোম্পানির সাথে সে আইনি লড়াই করে পারবে?
চুক্তির আইন কার পক্ষে
চুক্তি চাষ সংক্রান্ত আইনে দেশের আদালত তথা মূল বিচার ব্যবস্থার কোনও ভূমিকা নেই। অ্যাপিলেট আদালতের প্রথম ধাপে থাকবেন মহকুমা শাসক, পরের ধাপে জেলাশাসক। কেন্দ্রের সঙ্গে সরাসরি প্রশাসনিক যোগাযোগ থাকবে জেলাশাসক ও মহকুমা শাসকদের। চুক্তির উপর রাজ্যের নিজস্ব আইন বা আদেশের কোনও প্রভাব থাকবে না। ফলে রাজ্য প্রশাসন থাকবে নীরব দর্শক। নিরক্ষর, প্রায় নিরক্ষর, স্বল্পশিক্ষিত চাষির পক্ষে তো বটেই, উচ্চশিক্ষিত আইনজ্ঞ নন, এমন মানুষের পক্ষেও চুক্তি মুসাবিদা করা, চুক্তিতে উল্লিখিত শর্ত ও ধারাগুলি বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। সংস্থার পক্ষে যেমন, তেমনই চাষির পক্ষেও আইনজ্ঞের সাহায্য প্রয়োজন হবে। চুক্তি-অভিযোগ-বিচারেও আইনজ্ঞের সাহায্য লাগবে। গরিব কৃষক কি পারবে কোম্পানিগুলির সাথে আইনি লড়াই লড়তে? অর্থবলে বলীয়ান বাণিজ্যিক সংস্থা কি বিচারব্যবস্থাকে প্রভাবিত করবে না? বিচারে যদি কৃষক চুক্তিভঙ্গকারী সাব্যস্ত হয় ক্ষতিপূরণ দেবে কোথা থেকে? ভারতে কৃষি এখনও অনেকাংশে প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। বন্যা, খরা, কীটের উৎপাত কিংবা পতঙ্গের হামলায় ফসল যদি মাঠেই নষ্ট হয়, কৃষক কী করবে? আইনের কোনও না কোনও ফাঁকে ঋণগ্রস্ত অসহায় কৃষকের জমি এই কর্পোরেট সংস্থাগুলি দখল করবে। ফলে নয়া আইন কার্যকর হলে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে সর্বস্ব হারিয়ে কৃষকের পথে বসা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না। যে সব দেশে চুক্তিচাষ জোর কদমে চালু হয়েছে, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, আফ্রিকার ঘানা, মালি, জাইরে, সুদান, ইথিওপিয়া, জাম্বিয়া, ল্যাটিন আমেরিকার পানামা, নিকারাগুয়া, হন্ডুরাস এমনকি ব্রাজিল ইত্যাদির অভিজ্ঞতা এ কথাই বলে।
শুধু চাষি নয়, ক্রেতারাও শিকার হবে
এই ভাবে সমস্ত কৃষিজ দ্রব্যের উপর বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর ওরা কী করবে? ওরা কৃষকের কাছ থেকে জলের দরে কৃষিপণ্য কিনবে এবং বিশালাকার সব হিমঘর এবং গুদাম তৈরি করে সেখানে মজুত করবে। তারপর ইচ্ছামতো বাজারে মালের জোগান কমিয়ে দিয়ে কৃত্রিম অভাব তৈরি করে চড়া দামে তা সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করবে। এই ভাবে চাষি থেকে ক্রেতা সকলেই শোষিত হবে, আর মুনাফার পাহাড় গড়ে তুলবে কোম্পানিগুলো। নতুন আইনে এই ব্যবস্থাই পাকা করা হয়েছে।
বেসরকারিকরণ করে বহুজাতিক পুঁজির হাতে শিক্ষা-স্বাস্থ্য সহ অন্যান্য ক্ষেত্র তুলে দেওয়ার বিষময় ফল কী, তা আমরা সবাই জানি। এই সব এখন সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। পুঁজিপতিদের কাছে এ ছাড়া অন্য কিছু আশা করা যায় না। মুনাফা ছাড়া এই দুর্বৃত্ত পুঁজিবাদ আর কিছু বোঝে না। এদের হাতে যদি চাল গম ডাল তৈলবীজ আলু সব্জি ফল দুধ হাঁস মুরগি ছাগল শুয়োর মাছ পাট তুলো পশুখাদ্য ইত্যাদির একচেটিয়া অধিকার চলে যায় তা হলে জনজীবনে যে ভয়ঙ্কর বিপর্যয় নেমে আসবে, তা ব্যাখ্যা করে বোঝাবার প্রয়োজন নিশ্চয়ই নেই।
আন্দোলনই মুক্তির একমাত্র রাস্তা
কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার জনজীবনে এই সর্বনাশ নামিয়ে আনছে, নামিয়ে আনছে পূর্বতন কংগ্রেস সরকারের পথ অনুসরণ করে, তাকে আরও বীভৎস রূপে কার্যকর করে। এই অবস্থায় সংগঠিত কৃষক আন্দোলন এবং সেই আন্দোলনে সমাজের সব অংশের মানুষের সহায়তাই পারে এই আইন প্রত্যাহারে সরকারকে বাধ্য করতে। এ কথা বুঝেছেন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া ভারতের কৃষক সমাজ। তাই তাঁরা আজ দলে দলে সামিল হয়েছেন দিল্লি অভিযানে। পুলিশের লাঠি, জলকামান, টিয়ার গ্যাসের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছেন লক্ষ লক্ষ কৃষক। দাবি তুলেছেন, কোনও কথা শুনতে চাই না, সর্বনাশা কৃষি আইন এই মুহূর্তে বাতিল করো। এই দাবিতে গলা মেলাতে হবে সারা দেশের মানুষকে এটাই সময়ের আহ্বান।
কৃষি আইনের সর্বনাশা কয়েকটি দিক ১) আইনটি প্রণয়ন ও প্রয়োগ করার আগে দেশের সমস্ত কৃষক সংগঠন ও জনপ্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা করা হয়নি। অত্যন্ত অগণতান্ত্রিক ভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। ২) কৃষকদের জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের উল্লেখ নেই। ৩) মজুতদারিকে আইনসম্মত করা হয়েছে। এর ফলে বাজারে কৃত্রিম অভাব তৈরি করে মজুতদার-কালোবাজারিরা দাম বাড়াবে। ৪) কোনও পণ্যের দাম আকাশছোঁয়া হলেও সরকার হস্তক্ষেপ করবে না। ৫) চুক্তির উপর রাজ্যের নিজস্ব আইন বা আদেশের কোনও প্রভাব থাকবে না। কৃষির বাজার ও বাণিজ্যিকীকরণের ক্ষেত্র সমস্তটাই কেন্দ্রীয় সরকারের ইচ্ছেমতো চলবে। ৬) দেশের আদালত তথা মূল বিচার ব্যবস্থার কোনও ভূমিকা নেই। অ্যাপিলেট অথরিটির নিচের স্তরে থাকবেন মহকুমা শাসক, তার উপর থাকবেন জেলাশাসক। ৭) কেন্দ্রের সঙ্গে সরাসরি প্রশাসনিক যোগাযোগ থাকবে জেলাশাসক ও মহকুমা শাসকদের, রাজ্য প্রশাসন থাকবে নীরব দর্শক। ৮) নিরক্ষর, প্রায় নিরক্ষর, স্বল্প শিক্ষিত চাষির পক্ষে তো বটেই, উচ্চশিক্ষিত আইনজ্ঞ নন, এমন মানুষের পক্ষেও চুক্তি মুসাবিদা করা, চুক্তিতে উল্লিখিত শর্ত ও ধারাগুলি বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। সংস্থার পক্ষে আইনজ্ঞ নিয়োগ সম্ভব। কিন্তু চাষির সেই সাহায্য প্রয়োজন হলেও সামর্থ্যে কুলোবে না। ফলে চুক্তিচাষজনিত বিবাদের মীমাংসায় চাষিরা ন্যায় বিচার পাবে না। ৯) ভারতে কৃষি এখনও অনেকাংশে প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। বন্যা, খরা, কীটের উৎপাত কিংবা পতঙ্গের হামলায় ফসল যদি মাঠেই নষ্ট হয়, তখন কৃষককে চুক্তিভঙ্গকারী বলার সম্ভাবনা থাকছে। ১০) বিচারে চুক্তিভঙ্গকারী সাব্যস্ত হলে ফসল হারানো কৃষক ক্ষতিপূরণ দেবে কোথা থেকে? ১১) চাষি ও ক্রেতা সংস্থা উভয়ের তরফেই বিমা প্রয়োজন হবে। এইসব বাবদ ব্যয় হবে যেমন বাণিজ্যিক ক্রেতার, তেমনই চাষির। এই ব্যয় নিশ্চয়ই ফসলের দামে যুক্ত হবে এবং বাজারে ফসলের দাম বাড়াবে। ১২) চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠলে বিচারে আইনজ্ঞের সাহায্য লাগবে। অর্থবলে বলীয়ান বাণিজ্যিক সংস্থা বিচারব্যবস্থাকে প্রভাবিত করবে। ফলে চাষি ন্যায় বিচার পাবে না। ১৩) ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি ৮৬ শতাংশ। তাদের হাতে জমি ৪৭ শতাংশ। ১৪ শতাংশ চাষির হাতে আছে বাকি ৫৩ শতাংশ জমি। এই ৮৬ শতাংশ চাষি, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক এবং এঁরাই দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ। এঁদের কী পরিণতি হবে? ১৪) যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, অস্বাভাবিক দামবৃদ্ধি এবং মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতেই সরকার মজুতদারি এবং দাম নিয়ন্ত্রণে হস্তক্ষেপ করবে বলেছে। আজ মূল্যবৃদ্ধি অস্বাভাবিক হলেও হস্তক্ষেপ করছে কোথায়? ১৫) স্বয়ং কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী করোনার তাণ্ডবকে আখ্যা দিয়েছেন ‘দৈব দুর্বিপাক’। এটা কি অনন্যসাধারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়? ১৬) আইনের কোনও না কোনও ফাঁকে ঋণগ্রস্ত অসহায় কৃষকের জমি এই কর্পোরেট সংস্থাগুলিও কুক্ষিগত করবে। ১৭) এই আইনের ফলে ভূমিহীনের সংখ্যা বাড়বে। মুষ্টিমেয়ের জোতের পরিমাণ বাড়বে। অসংখ্য ছোট চাষির সঙ্গে চুক্তি করার চেয়ে অল্প সংখ্যক বড় চাষির সঙ্গে চুক্তি করলে পরিশ্রম কমে, খরচ কমে, মুনাফা বাড়ে। আইন কর্পোরেটদের সেই সুবিধা করে দেবে। ১৮) ভারতে কৃষি উৎপাদন উদ্বৃত্ত। তা সত্তে্বও দেশে এখনও সাতাশ কোটি ক্ষুধার্ত। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের নিরিখে ক্ষুধা সমস্যার সমাধানে ১১৭ দেশের মধ্যে ভারত ১০৩ নম্বর দেশ। উদ্বৃত্ত শস্য ক্ষুধা-সমস্যা সমাধানে ব্যবহারের কোনও দিশা নেই। ১৯) দেশে মাথাপিছু খাদ্যশস্যপ্রাপ্তির নিরিখে ১৯৪৮ সালের তুলনায় বর্তমানে কোনও অগ্রগতি ঘটেনি, বরং ১৯৯১ সালের তুলনায় মাথাপিছু খাদ্যশস্যপ্রাপ্তি কমেছে। ২০) সাধারণ মানুষের পুষ্টির তিন-চতুর্থাংশ আসে চাল-গম-বাজরা ইত্যাদি খাদ্যশস্য ও বিভিন্ন ডাল থেকে। সেগুলি কেন্দ্রীয় সরকারের এই আইনে আর অত্যাবশ্যক নয়। |