গত ২৯ জুলাই ভারতীয় নবজাগরণের পার্থিব মানবতাবাদী ধারার বলিষ্ঠ প্রতিনিধি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রয়াণ দিবসে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০-র আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দিল। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের ওই বিশেষ দিনটির তাৎপর্য স্মরণে ছিল কিনা জানা নেই, কিন্তু এই মনীষীর দ্বিশত জন্মবর্ষের কোনও উল্লেখ ছিল না! না থাকাটাই বোধহয় স্বাভাবিক, কারণ এই শিক্ষানীতিতে ২৫০০ বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যের কথা উল্লেখ আছে, অথচ উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ব্রিটিশ শাসনে বঙ্গদেশে রাজা রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও মহারাষ্ট্রে জ্যোতিরাও ফুলে প্রমুখের ঐতিহাসিক প্রচেষ্টায় যে ভারতীয় নবজাগরণ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, যার ধারাবাহিকতায় ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন অত্যন্ত দুঃখের হলেও, তার কোনও স্বীকৃতি নেই। গত বছরের ৪৮৪ পৃষ্ঠার প্রস্তাবিত শিক্ষানীতির খসড়াটি প্রায় অপরিবর্তিত রেখে ৬৬ পাতায় সংক্ষেপিত রূপে প্রকাশ করা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতির এই নথিটি বিগত ১৯৮৬ জাতীয় শিক্ষানীতির নথির মতোই অত্যন্ত সুন্দর ও আকর্ষণীয় ভাষায় শিক্ষার বিভিন্ন সমস্যার কথা এবং তথাকথিত ভাল ভাল প্রস্তাবে পূর্ণ, যা সাধারণ মানুষকে এমনকি বহু শিক্ষাবিদ এবং বুদ্ধিজীবীদের বিভ্রান্ত করতে সক্ষম।
একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হতে পারে। এবারের শিক্ষানীতিতে প্রাক-প্রাথমিক পর্বের তিন থেকে ছয় বছরের শিশুদের সাথে প্রাথমিক স্তরের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিকে যুক্ত করে একটি ‘ফাউন্ডেশন গ্রুপ’ তৈরি করা হয়েছে। প্রাক-প্রাথমিক অংশটি পুরোপুরি অঙ্গনওয়াড়ির হাতে থাকবে। শিশুদের পুষ্টি বাড়ানোর জন্য মিড ডে মিল এর সাথে সকালে ভালো প্রাতরাশের ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে। কিন্তু অর্থের জোগান কে দেবে? বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার? ইতিহাস কিন্তু অন্য কথা বলছে। ২০১৩-১৪ সালে বিগত ইউপিএ সরকারের আমলে মিড ডে মিলের জন্য বাজেটে বরাদ্দ ছিল ১৩,২১৫কোটি টাকা, কিন্তু এ বছরের বাজেটে (২০২০-২১) ধার্য হয়েছে মাত্র ১২,০৫৪ কোটি টাকা (সূত্র : কেন্দ্রীয় বাজেট নথি ২০১৩-১৪ এবং ২০২০-২১) পাঁচ শতাংশ প্রতি বছরে মুদ্রাস্ফীতিকে হিসাবে ধরলে ২০১৩-১৪কে ভিত্তিবর্ষ ধরে সাত বছর পর ২০২০ সালে মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ হওয়া উচিত ছিল কমপক্ষে ১৮ হাজার কোটি টাকা। যদিও বরাদ্দ হয়েছে তার অর্ধেক! তাহলে পুষ্টিকর আহার এবং সকালের পুষ্টিকর টিফিনের ব্যবস্থা কীভাবে হবে? বর্তমান শিক্ষানীতিতে এর জবাব নেই। ফলে শুনতে ভাল হলেও প্রস্তাবটি কার্যকর করার চেষ্টাই অনুপস্থিত। এ ধরনের ফাঁকি নয়া জাতীয় শিক্ষানীতির প্রায় প্রতিটি পর্বে খুঁজে পাওয়া যাবে।
গত বছর ১ জুন বিজ্ঞানী কস্তুরীরঙ্গনের নেতৃত্বে গঠিত কমিশন জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১৯ পেশ করার পর থেকেই দেশজুড়ে বিতর্ক দানা বেঁধেছে। অভিযোগ উঠেছে সংঘ পরিবারের অনুগত ছাত্র ও শিক্ষক সংগঠন (অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ এবং অখিল ভারতীয় শিক্ষণ মহামণ্ডল), তাদের পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শে এই নয়া শিক্ষানীতি তৈরি হয়েছে। অন্যান্য স্বতন্ত্র, নিরপেক্ষ যুক্তিপূর্ণ ও বিরোধী মতামত এবং পরামর্শকে যথারীতি ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করা হয়েছে। বর্তমান শিক্ষানীতিতে সুললিত বাক্য বিন্যাসের চাতুর্যে ও ভাল ভাল কথা ও প্রস্তাবের আড়ালে সুলভ, সার্বজনীন, বৈজ্ঞানিক ও গণতান্ত্রিক শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে মূল সমস্যাগুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। বর্তমানে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা কর্তৃক নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি অনুমোদিত হওয়ার পর থেকেই বিতর্ক এবং বিরোধ চরমে পৌঁছেছে। দেশের একটা বড় অংশ বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ ও শিক্ষাপ্রেমী মানুষ এর বিরুদ্ধে সারা দেশ জুড়ে প্রতিবাদ আন্দোলনে নেমেছেন। অপরপক্ষে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সরকার কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির কর্তৃপক্ষ ও প্রধানদের এই শিক্ষানীতির পক্ষে প্রচারের জন্য কাজে লাগাচ্ছেন। এরা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এবং প্রচারমাধ্যমে সরকারি শিক্ষানীতির পক্ষে নানা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছেন।
এবারের নয়া শিক্ষানীতি-২০২০ শিক্ষাক্ষেত্রে জিডিপি-র ৬ শতাংশ ব্যয় বরাদ্দের কথা বলেছে। স্বাধীনতার কিছুদিন পরেই দেওয়া কোঠারি কমিশনের এই পরামর্শ আজ পর্যন্ত কোনও সরকারই মুখে অস্বীকার করেনি, কিন্তু কার্যকরও করেনি। নয়া শিক্ষানীতিতে এর পক্ষে যুক্তির অবতারণা করা হলেও বাস্তব কিন্তু উল্টো কথাই বলছে। বর্তমান বিজেপি সরকারের আমলে শিক্ষাখাতে কেন্দ্রীয় সরকারের ভাগিদারি ক্রমশ কমছে! ২০১৪-১৫তে ০.৫৩ শতাংশ থেকে কমতে কমতে ২০২০-২১ শে ০.৪৪ শতাংশ (বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে জিডিপির মোট ব্যয় ২.৭১-৩ শতাংশে) এসে দাঁড়িয়েছে। এবারের শিক্ষানীতিতে বেসরকারি এবং স্বেচ্ছাসেবামূলক সংস্থার অংশগ্র্রহণের গুরুত্বের কথা বলা হয়েছে কিন্তু সরকারি অংশীদারিত্বের প্রশ্নে এই শিক্ষানীতি নীরব! এই প্রসঙ্গে একটি তথ্য থেকে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি উন্মোচিত হয়– ২০১৯-২০ বাজেটে শিক্ষা সেস বাবদ কেন্দ্রীয় সরকারের আয় হয়েছে ৩.৩৮ লক্ষ কোটি টাকা। আর কেন্দ্রীয় সরকার ২০২০-২১ শিক্ষা বাজেটে ধার্য করেছে ৯৯ হাজার ৩০০ কোটি টাকা যা আয়ের এক-তৃতীয়াংশ নয়! (সূত্র বাজেট সংক্রান্ত নথি ৩০ জুন ২০১৯ ও ২০২০) এটা কি দেশের মানুষের সাথে প্রবঞ্চনা ও তঞ্চকতা নয়? ফলে বাড়ছে বেসরকারি ও কর্পোরেট সংস্থার অংশীদারিত্ব যা অবশ্যম্ভাবীরূপে শিক্ষাকে ব্যয়বহুল ও মহার্ঘ করে তুলেছে।
স্বাধীনতার পূর্বে শিক্ষা ক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোগের প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। ব্রিটিশ সরকারের বিরোধিতা সত্তে্বও দেশে জাতীয়তাবাদী শিক্ষা প্রসারে ‘জাতীয় শিক্ষা পর্ষদ’ গঠন ও তার উদ্যোগে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ন্যাশনাল স্কুল ও কলেজ স্থাপন করেছেন স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতারা। এর পাশাপাশি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ স্থাপিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ও পন্ডিত মদনমোহন মালব্যের বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো মহৎ উদ্যোগ লক্ষ করা গেছে। স্বাধীনতার পরবর্তী কালেও তার রেশ কিছুটা ছিল। ফলে জনসাধারণের উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল বহু স্কুল ও কলেজ, যা পরবর্তীকালে সরকার দ্বারা স্বীকৃত হয়েছিল। কিন্তু আজকের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। আজ সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রে ধর্মীয় আদর্শ প্রচারের তাগিদে বিভিন্ন ধর্মের কিছু সংস্থা স্কুল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। এটাকে বাদ দিলে আর যা বেসরকারি উদ্যোগ তার বেশিরভাগটাই বাণিজ্যিক লক্ষ্যে পরিচালিত।
এবারের জাতীয় শিক্ষানীতিতে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রশ্নে পিপিপি মডেলের জয়গান করা হয়েছে। আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বলছে কলকাতার যাদবপুরে কে এস রায় টিবি হাসপাতালকে বিগত রাজ্য সরকারের আমলে পিপিপি মডেল চালাবার জন্য প্রাইভেট ম্যানেজমেন্টের হাতে তুলেদেওয়া হয়েছিল মেডিকেল কলেজ স্থাপনের জন্য। এর ফল হয়েছে, ওই প্রতিষ্ঠানে ডাক্তারি পড়ার জন্য অত্যন্ত চড়া হারে (সরকারি কোটায় ৮-১০ লক্ষ, ম্যানেজমেন্ট কোটায় ৪০ লক্ষ ও এন আর আই কোটায় ১.৫-২ কোটি টাকা) ফি দিতে হচ্ছে! সারা দেশে প্রাইভেট প্রফেশনাল কলেজগুলোর চিত্রটা কমবেশি একই রকম অথবা এর চেয়েও খারাপ। ২০০১-০২ সালে সুপ্রিম কোর্ট এক রায়ে মন্তব্য করেছিল কোথাও ক্যাপিটেশন ফি নেওয়া চলবে না। ফি নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে বলা হয়েছিল শুধুমাত্র যৌক্তিক উদ্বৃত্ত (রিজিনেবল সারপ্লাস) যা প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নতি সাধনের কাজে লাগবে, সেটাই ফি হিসেবে ধার্য করতে হবে। এবারের শিক্ষানীতিতে সেই কথাই বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ঠিক উল্টোটাই ঘটছে। ম্যানেজমেন্ট কোটায় ভর্তি ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা (কর্ণাটক সরকারের ফিজ রেগুলেটরি অথরিটি রিপোর্ট ২০১৮ দ্রষ্টব্য) কোথাও কোথাও কোটি টাকাও আদায় করা হচ্ছে। সরকারি শিক্ষানীতির সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা ও প্রচার মাধ্যম সম্ভবত এসব খবর রাখেন না।
এবারের শিক্ষানীতির অন্তঃসারশূন্যতার আরও একটি উদাহরণ হল– নয়া শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এবং সম্ভব হলে পরবর্তীকালেও শুধুমাত্র মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান হবে। এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়, এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি প্রথম শ্রেণি থেকে মাতৃভাষার মাধ্যমে পড়াশোনা করেননি? আমরা সাধারণ মানুষেরা তো তাই করেছি। বর্জন করা হবে বিদেশি (!) ভাষা ইংরেজিকে। প্রশ্ন উঠত প্রাইভেট স্কুলের ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য হবে? গত ৭ আগস্ট ‘এডুকেশন কনক্লেভে’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বড় গলায় এটি ঘোষণাও করেছেন। কিন্তু কী আশ্চর্য তার পরদিনই সিবিএসই-র চেয়ারম্যান ঘোষণা করলেন এটা সম্ভব নয়! সিবিএসই অনুমোদিত স্কুলে ইংরেজি মাধ্যমেই পড়াশোনা হবে। না হলে নেতা-মন্ত্রীদের বা অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলেমেয়েরা কোথায় পড়বে? নয়া শিক্ষানীতির এমন মহৎ ‘ঘোষণার’ কী মর্মান্তিক পরিণতি! অন্যান্য ‘মহৎ’ ঘোষণাগুলোর কী পরিণতি হবে তা সহজেই অনুমেয়।
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মশাই বহুল প্রচারিত একটি সংবাদপত্রে লিখেছেন, ‘শিক্ষা কখনোই টাকা কামানোর উপায় হতে পারে না– এই আদর্শের উপর ভিত্তি করেই রাষ্ট্রীয় শিক্ষানীতি তৈরি হয়েছে’। ভাল কথা। তাহলে এবারের শিক্ষানীতিতে যে ১০০টি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়কে এদেশে ক্যাম্পাস খোলার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে তারা কি এদেশে দানছত্র খুলতে আসবে? বাজার অর্থনীতির যুগে শিক্ষা তো আজ বিশ্ববাজারের লোভনীয় পণ্য। প্রায় কুড়ি বছর আগে কেন্দ্রের বাজপেয়ী সরকার নিযুক্ত‘বিড়লা-আম্বানি কমিশন’ বলেছিল, ‘এডুকেশন সেক্টর ইজ মাচ মোর প্রফিটেবল দ্যান ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড এগ্রিকালচার’। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী মোদিজির সাথে গুগলের প্রধান সুন্দর পিচাই-এর একটি বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে গুগল সংস্থা আগামী কয়েক বছরে ডিজিটাল শিক্ষা ও তার পরিকাঠামো তৈরির জন্য ৭৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের কথা বলেছে। তারাও নিশ্চয়ই দানছত্র খুলতে আসছে না। এভাবেই হয়ত আমাদের দেশ শিক্ষাক্ষেত্রে জিডিপির ৬ শতাংশের ‘লক্ষ্যমাত্রায়’ পৌঁছাবে। নয়া জাতীয় শিক্ষানীতিতে ‘প্রাইভেট পার্টিসিপেশন’ এর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। বিশ্ব আর্থিক মহামন্দার যুগে শিক্ষাক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিয়োগ কি মুনাফার সন্ধান করবে না? নাকি মোদিজির আহ্বানে সাড়া দিয়ে বনের বাঘ হঠাৎ করে মাংস ছেড়ে দিয়ে ঘাস খেতে শুরু করবে?
ওই নিবন্ধে উপাচার্য মশাই লিখছেন, ‘সবচেয়ে মজার কথা যারা বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে বেশি সরব তারা অনেকেই আমেরিকার আইভি লিগ-এর সঙ্গে যুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলার সময় এই পন্থার জোরালো সমর্থক হয়ে ওঠেন’। এই তথ্য কোথায় পেয়েছেন তিনি ভাল বলতে পারবেন। তবে একথা বলতে পারি বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের বাঘা বাঘা ক্যাবিনেট মন্ত্রীদের সন্তানরা উপরোক্ত বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা করেছেন। করুন তাতে আপত্তি নেই, কিন্তু তা কি সংস্কৃত ভাষার মাধ্যমে, নাকি ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে? অথচ এই নেতারাই দেশের মানুষের কাছে ‘আংরেজি হটাও’ স্লোগান তোলেন। সংস্কৃতের পূজারী হয়ে পড়েন। বর্তমান শিক্ষানীতিতে যেখানে ইংরেজি ভাষার পরিবর্তে সংস্কৃত ভাষা শিক্ষার উপর জোর দেওয়া হচ্ছে বৈজ্ঞানিক ও বৈপ্লবিক শিক্ষানীতির নাম করে সেখানে দেশভক্ত রাষ্ট্রনেতারা যদি দয়া করে ‘আপনি আচরি ধর্ম শেখাও অপরে’ করতেন তাহলে ভালো হত। আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে ১৮২৩ সালের ১১ ডিসেম্বর ভারতীয় নবজাগরণের পথিকৃৎ রাজা রামমোহন লর্ড আমহার্স্টকে সংস্কৃত শিক্ষার প্রশ্নে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘দি স্যাংস্কৃট সিস্টেম অব এডুকেশন উড বি বেস্ট ক্যালকুলেটেড টু কিপ দিস কান্ট্রি ইন ডার্কনেস’। ১৮৫৩ সালে শিক্ষা সংস্কারের প্রশ্নে অধ্যাপক ব্যালেন্টাইনের চিঠির জবাবে বিদ্যাসাগর প্রায় অনুরূপ কথা লিখেছিলেন। প্রশ্ন জাগে, কারা বেশি দেশপ্রেমিক ও শিক্ষাব্রতী–রাজা রামমোহন, বিদ্যাসাগর না বিজেপি নেতারা?
ওই উপাচার্য মশাইয়ের ধারণা,‘উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক সার্বভৌমত্ব কোনভাবেই খর্ব হবে না এই রাষ্ট্রীয় শিক্ষানীতিতে’। তিনি কীভাবে বললেন এ কথা জানি না, তবে এই শিক্ষানীতিতে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে কোনও নির্বাচিত সংস্থা থাকবে না বলে জানানো হয়েছে। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পরিচালনা করার জন্য যে নির্বাচিত সেনেট সিন্ডিকেট অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল ও কোর্ট এবং অন্যান্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে নির্বাচিত পরিচালন সমিতি থাকত তা ভবিষ্যতে আর থাকবে না। সরকার মনোনীত পরিচালন সমিতিগুলি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে পরিচালনা করবে যা সার্বভৌম, স্বাধীন, গণতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থার পরিপন্থী। নির্বিবাদে সরকারি হুকুম তামিল করা ছাড়া তাদের আর কোনও ভূমিকা থাকবে না। সর্বস্তরে ব্যাপক প্রতিবাদের কারণে খসড়া শিক্ষানীতিতে প্রস্তাবিত প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে পরিচালিত ‘আরএসএ-এর পরিবর্তে তারা কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রীর নেতৃত্বে সিএবিই (যা এতদিন পর্যন্ত একটি পরামর্শদানকারী সংস্থা ছিল) তাকে চূড়ান্ত ক্ষমতাশালী করার কথা বলা হয়েছে। যার মধ্যে দিয়ে দেশে শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনায় চূড়ান্ত কেন্দ্রীকরণের বিপদ দেখা দিয়েছে। মনে রাখা দরকার শিক্ষা কেন্দ্র রাজ্যের যুক্ত তালিকাভুক্ত। শিক্ষার এই চূড়ান্ত কেন্দ্রীকরণের প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর এক চূড়ান্ত আঘাত ।
সর্বশেষে বলি এবারের শিক্ষানীতিতে ‘ফিলানথ্রপিক অর্গানাইজেশন’-এর অংশীদারিত্বের কথা বারবার বলা হয়েছে। আরএসএস-এর সহ-সচিব বলেছেন, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাদের ৬০ শতাংশের বেশি পরামর্শ এই শিক্ষানীতিতে গ্র্রহণ করা হয়েছে। শাসক দলের ছাত্র সংগঠন এবিভিপিও একই কথা বলেছে। এই শিক্ষানীতিতে প্রাক-প্রাথমিকে অঙ্গনওয়াড়ির সাথে সাথে ‘বাল বাটিকা’, ‘বনবাসী আশ্রম’ (যা কিনা আরএসএসের সাথে সংশ্লিষ্ট সংস্থা) এর কথা বলা হয়েছে। এর মাধ্যমে একদম শিশু বয়স থেকেই কেন্দ্রের শাসকদলের দর্শন ও চিন্তাভাবনা (হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্তান) ছাত্র-ছাত্রীদের মগজে ঢুকিয়ে দেওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন বহু শিক্ষাবিদ ও শিক্ষাব্রতীরা। শিক্ষাক্ষেত্রে এই চূড়ান্ত সর্বনাশা আক্রমণের বিরুদ্ধে কি কোনও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ চুপ করে থাকতে পারেন? তাই এই বিতর্কিত শিক্ষা ও ছাত্র স্বার্থবিরোধী শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে সারা দেশ জুড়ে প্রতিবাদে সামিল হচ্ছেন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী শিক্ষাবিদ সহ শিক্ষাপ্রেমী জনসাধারণ।