৫ আগস্ট সর্বহারার মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের স্মরণ দিবস উপলক্ষে তাঁর ‘জ্ঞানতত্ত্ব, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ ও বিপ্লবী জীবন প্রসঙ্গে’ পুস্তিকা থেকে একটি অংশ প্রকাশ করা হল৷ ১৯৬৭ সালের ১৪–১৭ অক্টোবর দলের কলকাতা জেলা কমিটির উদ্যোগে মুসলিম ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত রাজনৈতিক শিক্ষাশিবিরে তিনি এই বক্তব্য রাখেন।
বিপ্লবী নেতার জীবন বিপ্লবের সাথে মিশে যাওয়া চাই
… প্রত্যেক মানুষের জীবনেই যেমন প্রেম, ভালবাসা, যৌনজীবন, বিবাহ এসবের প্রয়োজন আছে, বিপ্লবীদের জীবনও তার ব্যতিক্রম নয়৷ সাধারণত এই সমস্ত বিষয়কে অনেকেই ব্যক্তিগত বিষয় বলে মনে করেন এবং এসব নিয়ে মাথা ঘামান না৷ কিন্তু আমি বলতে চাই, জীবনের সমস্ত দিক ব্যাপ্ত করে যে সংগ্রামের শিক্ষা আমাদের দলে প্রতিনিয়ত চর্চা করা হয় সেটা অনুসরণ করে যে সমস্ত নেতারা পার্টির ডিসপোজালে (সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে) আছেন, অর্থাৎ পার্টির বাইরে যাঁদের অন্য কিছু নেই তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনের সংগ্রামটা এমনই হবে যে, তাঁদের গোটা জীবনটা সকল পার্টিকর্মীর কাছে স্বচ্ছ কাচের মতো অনুভূত হয়৷ বিপ্লবী বলে, পার্টির নিয়ন্ত্রণে আছেন বলে, তাঁদের জীবনে প্রেম–ভালবাসা–বিবাহ প্রভৃতির দরকার নেই তা নয়৷ কিন্তু পার্টির নিচুতলার কর্মীরা এবং ব্যাপক জনসাধারণ পার্টির উপর আস্থা রাখবে কী করে যদি তারা দেখে, এই সমস্ত নেতাদের ব্যক্তিগত জীবন এমন ধরনের যেটা বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে যায়নি৷ নেতারা ভাল থাকুন, খারাপ থাকুন, গাড়িতে চলুন কি হেঁটেই চলুন, সেটা যাই হোক না কেন, নেতাদের স্বামী–স্ত্রীর সম্পর্ক বিপ্লবী আন্দোলনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কি না, জনসাধারণ সেটাই দেখতে চায়৷ যদি না হয় সেটা সুন্দরও হয় না, মানুষকে শক্তিশালীও করে না, বরং দুর্বল করে৷ এরকম ভাবে চললে রাজনীতি হয়ে পড়ে একটা প্রফেশন বা পেশার মতো৷ কেউ হয়তো চাকরি করতেন, তার বদলে রাজনীতি করে মোড়লি করছেন৷ এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে দল ও কর্মীদের প্রতি মানুষের আবেগ হারায়, কর্মীদের সাধনা হারায়, জ্ঞানবুদ্ধি খর্ব হয়ে যায়৷ যারা দেশের মানুষকে জাগাবে, সাধারণ মানুষ তাদের উপর আস্থা স্থাপন করতে চায়৷ এই আস্থা স্থাপন মানুষ তখনই করতে পারে যখন তারা দেখে, নেতারা শুধু স্লোগান দেন না, জ্ঞান–বিজ্ঞান চর্চাকেও তাঁরা যথার্থ গুরুত্ব দেন, বাহুল্য মনে করেন না৷ এবং একই সাথে তারা অভিজ্ঞতা থেকে বোঝে, নেতারা জীবনের সমস্ত দিক ব্যাপ্ত করেই সংগ্রাম করছেন৷ আমাদের মতো বিপ্লবী দলের এই দিকটির উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখতেই হয়৷ কেন না, অভিজ্ঞতা থেকে আমি দেখেছি, এসব ব্যক্তিগত সম্পর্ক অনেক বড় মানুষকেও কীভাবে দুর্বল করে দেয়৷ তাই ভারতবর্ষের মতো দেশে এ দিকটার প্রতি নজর না রাখলে দলের বিপ্লবী চরিত্র রক্ষা করাই দুরূহ হয়ে পড়তে পারে৷
আমি আগেই বলে গেছি, মানুষের প্রয়োজনকে কোনও একটা জায়গায় আটকে রাখা যায় না৷ মানুষের প্রয়োজন যেমন যেমন বেড়েছে তেমন তেমন উৎপাদন যন্ত্রেরও ক্রমাগত উন্নতি ঘটেছে, তাকে কেন্দ্র করে শিল্পবিপ্লব ঘটেছে এবং প্রযুক্তিবিজ্ঞানের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে৷ কিন্তু আমাদের দেশের কোনও কোনও রাজনৈতিক নেতা, শিল্পী, সাহিত্যিক, দার্শনিক সমাজের সমস্যাগুলোর মূল কারণ ধরতে না পেরে বর্তমান এই যন্ত্রসভ্যতাকেই দায়ী করছেন এবং বলতে শুরু করেছেন, আমাদের পুরনো যুগে ফিরে যেতে হবে৷ এ ধরনের কথা গান্ধীজি বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ বলেছেন এবং আরও অনেকে বলেছেন৷ তাঁদের কথা থেকে যেটা বেরিয়ে আসছে, সেটা হল, আমাদের দেশের অতীত সমাজটা, অর্থাৎ যখন চতুরাশ্রম ছিল, মুনি–ঋষিদের তপোবন ছিল, সেই সমাজটাই নাকি আদর্শ সমাজ ছিল৷ সেই আশ্রমে গেলেই নাকি মানুষের মধ্যে আধ্যাত্মিক ভাব দেখা দিত৷ এঁদের মূল বক্তব্য হল, যন্ত্রসভ্যতা, কলকারখানা এসবই হল আমাদের বিপত্তির মূল কারণ৷ এসবের ফলেই আমাদের মধ্যে লোভ বেড়েছে, দেখা দিয়েছে যত সামাজিক বৈষম্য, যত অনাচার৷ আমরা বলতে চাই, এ সব কিছুরই মূল কারণ হল শোষণমূলক সমাজব্যবস্থা৷ সামাজিক বৈষম্যই বলুন, আর অনাচার বলুন, সব কিছুরই মূল কারণ শোষণের উপর প্রতিষ্ঠিত এই সমাজব্যবস্থা৷ লোভ, হিংসা, দ্বেষ এসব নিয়ে মানুষ জন্মায়নি৷ সামাজিক পরিস্থিতিতে যখন বৈষম্য দেখা দিয়েছে, সেখান থেকেই লোভ, হিংসা, দ্বেষ ইত্যাদি জন্ম নিয়েছে৷ এসব কিছুই হল ইতিহাসের ফসল৷ শোষণের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সমাজেই মানুষের মধ্যে এসব প্রবৃত্তি দেখা দিয়েছে৷ যেদিন সমাজ শ্রেণীবিভক্ত হয়নি বা হতে শুরু করেনি, শোষক–শোষিতের জন্ম হয়নি, সেদিন আদিম মানুষ জানত না মানুষকে কী ভাবে বেশি করে ঠকানো যায়, শোষণ করা যায়৷ তাদের মগজে এ সব ভাবনা দেখা দেয়নি৷ কিন্তু আজ পুঁজিপতিরা, মানবতাবাদের ধ্বজাধারীরা নির্বিচারে মানুষকে চব্বিশ ঘন্টা ঠকাচ্ছে, শোষণ করছে৷ তাদের কোথাও আটকাচ্ছে না৷ কিন্তু সেই আদিম অর্ধসভ্য মানুষরা যারা জঙ্গলে বাস করত, অভাব সত্ত্বেও সেদিন তাদের সমাজ শ্রেণীতে শ্রেণীতে ভাগ হয়নি৷ মানুষকে শোষণ করার কোনও উপায় সেদিন ছিল না৷ আজ যাঁরা সাধারণ মানুষকে বোঝাচ্ছেন বা উপদেশ দিচ্ছেন– লোভ করো না, যেসব মানুষ পরের পয়সায় জীবনধারণ করেন, এ সব কথা প্রচারের জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন, তাঁরা নিজেরা কিন্তু সুযোগ পেলেই মিঠাইমণ্ডা খাচ্ছেন৷ এইসব মানুষ একবারও ভেবে দেখছেন না, মানুষের প্রয়োজনকে যদি বেঁধে ফেলা যেত, তা হলে আজ মানুষ যেসব বিষয় জানতে পেরেছে, জীবনে যা কিছু ভোগ করছে, সেসব কোনও কিছুরই সৃষ্টি হত না৷ আসলে কোনও বিশেষ ব্যক্তি চেষ্টা করলে হয়তো নিজের প্রয়োজনবোধকে মারতে পারে, কিন্তু গোটা সমাজের প্রয়োজনকে কেউ মারতে পারে না৷ সুতরাং মানুষের প্রয়োজন ক্রমাগত বাড়তেই থাকবে, এটাই হল বস্তুনিষ্ঠ চিন্তা৷ …
শ্রেণি, দল ও বিপ্লবকে না ভালবাসলে কমিউনিস্ট হওয়া যায় না
এই প্রসঙ্গে বিপ্লবী জীবনে জনগণের প্রতি ভালবাসা ও পার্টির প্রতি ভালবাসার প্রশ্নটিও স্বাভাবিকভাবে এসে পড়ে৷ অনেকে মনে করেন, তিনি যেহেতু জনগণকে ভালবাসেন, শ্রমিক শ্রেণিকে ভালবাসেন তার মানেই তিনি একজন বিপ্লবী, একজন কমিউনিস্ট৷ আমি মনে করি, এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল৷ কেন না বুর্জোয়া মানবতাবাদীদের মধ্যেও অনেকেই আছেন যাঁরা জনগণকে প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছেন, মানুষের জন্য আত্মত্যাগ করেছেন, কিন্তু তাঁরা কমিউনিস্ট ছিলেন না, বা হতে পারেননি৷ যে কোনও প্রকৃত কমিউনিস্টেরই জনগণ ও শ্রমিক শ্রেণির প্রতি ভালবাসা না থেকে পারে না৷ কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, এই ভালবাসা নিছক ভাবাবেগ ছাড়া আর কিছু নয়৷ যে পার্টি বিপ্লবে নেতৃত্ব দেবে, জনগণ ও শ্রমিক শ্রেণিকে শোষণের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করবে, সেই পার্টির নেতা ও কর্মীরা যদি জনগণ ও শ্রমিক শ্রেণির প্রতি ভালবাসাকে শ্রমিক শ্রেণির দলের প্রতি ভালবাসায় রূপান্তরিত করতে না পারেন, তাহলে তাঁদের মধ্যে কমিউনিস্ট বিপ্লবী চরিত্র গড়ে উঠবে না৷ কারণ, তাঁদের মনে রাখা দরকার, ভালবাসার সেই রূপ বিশেষীকৃত হচ্ছে, মূর্ত হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণির দলের প্রতি ভালবাসার মধ্য দিয়ে৷ তাই সেই দলকে যাঁরা ভালবাসতে পারেন না, ছোটখাট ভুল, ত্রুটি–বিচ্যুতি, তুচ্ছাতিতুচ্ছ ব্যক্তিগত কারণ, অথবা তুচ্ছ মতপার্থক্য দেখা দিলেই যাঁরা পার্টির প্রতি মমত্ববোধ হারিয়ে ফেলেন, অতি সহজেই দলকে ধূলায় মিশিয়ে দেন, তাঁরা বিপ্লব বুঝতে পারেননি৷ যেমন শ্রেণিকে না ভালবাসলে শ্রেণিতত্ত্ব আয়ত্ত করা যায় না, সেইরকম শ্রমিক শ্রেণির দলকে ভাল না বাসলে শ্রেণিতত্ত্বের উপলব্ধি ঘটে না৷ শুধু তর্ক করে, আলাপ–আলোচনা করে এর সন্ধান পাওয়া যায় না৷ আমি বলব, যাঁরা বিপ্লবের দায়িত্ব বহন করতে চান তাঁদের যেমন মার্কসবাদের নানা বিষয় নিয়ে ক্রমাগত চর্চা করতে হবে, পড়াশুনা–আলাপ–আলোচনা করতে হবে, একই সাথে দলের দায়িত্বও তাঁদের অতি অবশ্য বহন করতে হবে৷ একটা ক্লাস বা স্কুলে অংশগ্রহণ করার মধ্য দিয়ে মার্কসীয় দর্শন ও বিপ্লবী দল গঠন সংক্রান্ত আমাদের যে নূ্যনতম শিক্ষা তার সবকিছুই আপনারা আয়ত্ত করে ফেলবেন, বিষয়টা এত সহজ নয়৷ তাই অন্য সমস্ত দলের সাথে বিপ্লবী দলের মূল পার্থক্য কোথায়, আজকের চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীল নিকৃষ্ট ব্যক্তিবাদের যুগে একটা শ্রমিক শ্রেণির দল গঠনের যথার্থ মার্কসবাদ-লেনিনবাদ পদ্ধতি কী, এরকম বহু বিষয় আপনাদের ভাল করে বুঝতে হবে৷ বুঝতে হবে, আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন সম্পর্কে আমাদের দলের সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণ কী এবং ভারতবর্ষের বিশেষ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কাঠামোতে এ দেশের বিপ্লবের যথার্থ রণনীতি–রণকৌশল কী হবে৷ এ সমস্ত কিছুই আপনাদের ভাল করে বুঝতে হবে৷
মার্কসবাদ শুধু অর্থনীতি ও রাজনীতির বিশ্লেষণ নয়, মার্কসবাদ হল সামগ্রিক জীবনদর্শন
পার্টিকে ভালবাসার অর্থ হল, যাঁরা পার্টিকে ভালবাসেন তাঁরা এর মধ্যে ব্যথা এবং আনন্দ দুটোকেই সমানভাবে উপভোগ করেন৷ বিপ্লবটা যে ভাববিলাসিতা নয় এবং বিপ্লবের জন্য পার্টিকে যে শক্তিশালী করতে হবে, এটা তাঁরা জানেন৷ যে কর্মীটি পার্টিকে ভালবাসে সে যে বিপ্লবের জন্য প্রাণ দেয়, তার সেই প্রাণ দেওয়াটা ঘটে পার্টির জন্যই৷ এই হল তার সত্যিকারের বিপ্লবী হওয়ার অভিব্যক্তি৷ অর্থাৎ আমি বলতে চাই, কংক্রিটাইজড এক্সপ্রেশন অব ক্লাস ফিলিং ইজ পার্টি ফিলিং অ্যান্ড কংক্রিটাইজড এক্সপ্রেশন অব লাভ ফর দ্য ক্লাস অ্যান্ড রেভোলিউশন, ইজ লাভ ফর দ্য পার্টি (শ্রেণির প্রতি আবেগের বিশেষীকৃত প্রকাশ হচ্ছে দলের প্রতি আবেগ এবং শ্রেণি ও বিপ্লবের প্রতি ভালবাসার বিশেষীকৃত প্রকাশ হচ্ছে পার্টির প্রতি ভালবাসা)৷ এই হচ্ছে মার্কসবাদের একটা মূল কথা৷ এই সংগ্রামে দায়িত্ব পালন আছে, ঝঞ্ঝাট আছে, কিন্তু সেগুলো সকলেই ব্যক্তিগতভাবে এবং যৌথভাবে আলাপ–আলোচনা করে সমাধান করছে৷ কেউ একা লড়ছে এমন নয়, সকলের সাথে মিলেমিশে লড়ছে৷ আলাপ–আলোচনা, মেলামেশা সবকিছুর সাহায্যেই সমাধান করছে৷ যদি দেখা যায়, কেউ একজন শুধু পড়ছে, কিন্তু লড়ছে না, দায়িত্ব বহন করছে না, লড়াই চালাচ্ছে না, তা হলে বুঝতে হবে সে জানা আসলে ভুল জানা৷ এভাবে জানার বিপদ হচ্ছে, এতে যথার্থ দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে না, বরং ইগো বাড়ে এবং বিভ্রান্তি বাড়ে৷ এ আমাদের পদ্ধতি নয়৷ মার্কসবাদী পদ্ধতিতে শেখা কথাটার মানে কী? এই কথার অর্থ, একজন যা শিখল বা সত্য বলে জানল সে জীবনে সর্বক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করছে, অপরকে শেখাচ্ছে৷ যেমন করে শেখালে অপরে শিখবে তেমন করে শেখাবার চেষ্টা করছে, তেমন করে শেখাবার কায়দা আয়ত্ত করার জন্য লড়ছে৷ ঘরে–বাইরে, বন্ধুদের সাথে, অফিসে, কাছারিতে, যেখানে যার সাথেই সে মিশুক না কেন, সকলেই বুঝতে পারবে, শুধু পার্টি মিটিং বা আলাপ–আলোচনাতেই নয়, এটাই হল তার জীবনবেদ৷ এই জন্যই মার্কসবাদকে বলা হয় জীবনদর্শন৷ এটা একটা অর্থনৈতিক তত্ত্ব শুধু নয়৷ মার্কসবাদ জীবনকে পরিবর্তিত করে এবং গোটা সমাজের উন্নতির জন্য লড়াই করতে শেখায়৷ দ্বন্দ্বের মধ্যে আনন্দ নিতে শেখায়৷ দুঃখের মধ্যেও যে কী আনন্দ তা উপভোগ করতে শেখায়৷ এ জিনিস যে উপলব্ধি করতে পারে না, সে শুধু দুঃখ দেখে ভয়ে পিছিয়ে যায়৷
জানা ও উপলব্ধি করার মধ্যে পার্থক্য বিরাট
এ প্রসঙ্গে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও বোঝা দরকার৷ স্মরণশক্তি থাকারফলে মানুষ অনেক কথা স্মৃতিতে ধরে রাখতে পারে এবং সেই কথাগুলো আবার শোনাতে পারে৷ কিন্তু এটা পারে বলেই একথা প্রমাণ হয়ে যায় না, তাদের সকলের মধ্যে সেই বিষয়গুলো সম্পর্কে উপলব্ধি খুব গভীর আছে৷ প্রায়শই দেখা যায়, যাঁরা তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তির জোরে অনেক কিছু মনে রাখতে পারেন তাঁদের তত্ত্বের প্রশ্ণেই হোক বা অন্য যে কোনও ক্ষেত্রেই হোক, আমরা বেশ জ্ঞানীগুণী বলে ধরে নিই৷ এধরনের বিভ্রান্তি প্রায়ই দেখা যায়৷ তাই স্মরণশক্তি ও যথার্থ উপলব্ধির মধ্যে পার্থক্যটা কোথায় বা কতটুকু সেটা সঠিকভাবে বুঝতে হলে দেখতে হবে, যে কথা এই সব ব্যক্তিরা মুখে বলছেন সেই অনুযায়ী তাঁদের রুচিসংস্কৃতির জায়গাটা উন্নত হচ্ছে কি না৷ কেন না, এই রুচিসংস্কৃতির ধাঁচাটা উন্নত না হলে যা আমরা বলছি তা জীবনে যথার্থ প্রয়োগ করছি কি না সেটা বোঝা যাবে না৷ বাড়িঘর ছেড়ে দিয়ে সর্বক্ষণ পার্টির কাজে যুক্ত থাকলেই তার দ্বারা বোঝা যায় না, জীবনে বিপ্লবী আদর্শের যথার্থ প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোন নেতার অবস্থান কোথায়৷ আমার এই কথাটা আপনারা মনে রাখবেন৷ না হলে দেখুন, স্কুল–কলেজের ছাত্ররা, মাস্টারমশাইরাও তো অনেক কিছু মুখস্থ রাখতে পারেন, অপরকে শেখাতেও পারেন, কিন্তু তাঁদের অনেকের জীবনেই তার কোনও প্রভাব নেই৷ এ হল অনেকটা ভুক্ত বস্তু উগরে দেওয়ার মতো৷ এ জন্যই মার্কসবাদ বলেছে, জানা এবং উপলব্ধির মধ্যে একটা বিরাট পার্থক্য বর্তমান৷ এই পার্থক্যটা সঠিকভাবে ধরতে পারলেই আপনারা বুঝতে পারবেন, কী সেই কারণ যার জন্য আমরা একজনের ক্ষেত্রে দেখতে পাই, তাঁর মার্কসবাদ নিয়ে প্রচুর পড়াশুনা, ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি এবং ইনটেলেকচুয়াল ফ্যাকালটি (মেধাশক্তি) থাকা সত্ত্বেও তিনি যখন এসব নিয়ে আলোচনা করেন সে আলোচনায় কোথায় যেন একটা অভাব থেকে যায়৷ বিষয়টা ঠিক মনের মধ্যে গেঁথে যায় না৷ অথচ আর একজনের ওই রকম ডিগ্রি না থাকলেও সে যখন কথা বলে সেটা যেন মনের ভিতরে দাগ কেটে যায়৷ প্রথম স্তরের লোকেরা অনেক সময় অপরের দেওয়া কোনও রেফারেন্সে–এর (তথ্যের) ভুল ধরে সেই ভুলটাকেই বড় করে দেখান৷ কিন্তু তিনি একবারও খেয়াল করেন না, তিনি যে তথ্যটা দিচ্ছেন সেটা সঠিক হওয়া সত্ত্বেও তিনি তেমন ফল পাচ্ছেন না, যেটা হয়তো একটা ভুল তথ্য দেওয়া সত্ত্বেও আর একজন হাতেনাতে ভাল ফল পেল৷ শুরুতে প্রথম স্তরের কমরেডদের এ নিয়ে তেমন সমস্যা হয় না৷ কিন্তু প্রথম স্তরের কমরেডরা যদি তাঁদের ভুল সংশোধন করতে না পারেন, এমন একটা সময় আসে যখন তাঁদের মধ্যে অহংবোধ মারাত্মকভাবে দেখা দেয় এবং তাঁরা অহংসর্বস্ব হয়ে যান, নিজেদের অ্যাসেস (মূল্যায়ন) করার ক্ষমতাও তখন তাঁদের কমে যায়৷ নিজেদের অজ্ঞাতেই তাঁদের মনে প্রচুর কাদামাটি জমে যায়৷
তাই আমি কমরেডদের বলব, প্রতি মুহূর্তে নিজেকে প্রশ্ন করতে যে, তাঁরা যা বলছেন সেটা সত্যিই বুঝেছেন কি? যদি বুঝে থাকেন, তা হলে জীবনে তার প্রয়োগ হবে, তার ফল দেখতে পাওয়া যাবে৷ তাই বলছি, পড়া, আলোচনা করা, তর্ক করা এগুলো যখন জীবনকে কেন্দ্র করে যে সর্বব্যাপক সংগ্রাম সেই সংগ্রামেরই একটা অংশ হিসাবে আসে তখনই সেটা কাজে লাগে৷ কেউ যদি নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে সংগ্রাম না করেন, দায়িত্ব পালন না করেন, তা হলে সেই সব আলোচনা, তর্ক বা পড়াশুনার কোনও মানে নেই৷ শুধু পড়ছি, আলোচনা করছি, সন্ধ্যেবেলায় পার্টি অফিস যাচ্ছি, আর পার্টির কাজকর্ম একটু ঢিলেঢালাভাবে যখন যা করার করছি, এই মনোভাব নিয়ে পড়া এবং তর্কবিতর্ক যাই করি তাতে আমরা অনেক কথা শিখি বটে, কিন্তু সত্যিকারের জ্ঞান অর্জন কিছুই করি না৷ আবার বলি, কেউ জ্ঞান অর্র্জন করেছে মানেই ক্রিয়ার মধ্যে সে অবস্থান করছে৷ বিষয়টা এমন নয় যে, আমি জ্ঞান অর্জন করছি, তারপর দিনক্ষণ দেখে কবে লড়াই শুরু করব সেটা ভাবছি৷ বিষয়টা এমন হতে পারে না৷ আমি যতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছি ততটুকু লড়াই করছি৷ ভুল হলেও লড়ছি৷ লড়াইয়ের মধ্যেই আমার আনন্দ৷ সেই লড়াইতে যে দুঃখ সেই দুঃখের মধ্যেও আনন্দ৷ দুঃখও আনন্দের একটা রূপ হতে পারে৷ যে লড়তে জানে, যে জ্ঞানী, সে জানে দুঃখ ও আনন্দ মাসতুতো–পিসতুতো ভাই৷ আনন্দের মধ্যেই দুঃখ, দুঃখের মধ্যেই আনন্দ৷ আমাদের দেশের একজন মস্ত বড় সাহিত্যিক শরৎচন্দ্রও একথাটা বলে গেছেন৷ তিনি বলেছেন, ভয়শূন্য যে দুঃখ তাকে আনন্দের মতোই উপভোগ করা যায়৷এখানেও দেখুন, সেই সংগ্রামের, সেই লড়াইয়ের সুর৷ ভয়শূন্য যে দুঃখ– এই কথাটার মানে হচ্ছে নির্ভীকভাবে কোনও একটা কাজ যদি কেউ একটা স্থির সংকল্প নিয়ে করে, একটা মূল্যবোধের জন্য লড়ে, তা হলে তার বেদনাটা শুধু নিছক বেদনা নয়, আনন্দময় একটা রূপ তার আছে৷ যারা ভীত, সন্ত্রস্ত্র, দ্বিধাগ্রস্ত তাদের কাছে দুঃখটা হচ্ছে সর্বব্যাপক এবং সর্বাত্মক৷ দুঃখ তাদের ছেয়ে ফেলে, আনন্দ তারা দেখতে পায় না৷
বিপ্লবী জীবনে দুঃখও আনন্দের আর একটা রূপ
এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যাদের প্রচুর পয়সা আছে, এমন অঢেল পয়সা আছে যে পয়সা কীভাবে খরচ করবে সেটা তারা জানে না, তাদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষ ভাবেন, এই মানুষগুলোর কত আনন্দ, কেমন সুখে তারা আছে তাঁরা মনে করেন, এদের আবার অভাব কীসের? কিন্তু সাধারণ মানুষ যাই ভাবুন, এমন যারা উচ্চবিত্ত, যাদের টাকাপয়সার কোনও অভাব নেই, বাস্তব জীবনে প্রায়ই দেখা যায় তাদের অনেকের মধ্যেই আনন্দ নেই, সুখ নেই৷ তারা অনেকেই স্কিজোফ্রেনিয়ায় ভুগছে৷ প্রচণ্ড মানসিক অশান্তি ভোগ করছে৷ তারা ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু মনে আনন্দ নেই৷ তারপর গিয়ে কোনও সাধুবাবার পায়ে ধরছে যদি আনন্দ কিছু পাওয়া যায়, যদি মোক্ষলাভ হয়৷ কোনও কিছুতেই এদের আনন্দ নেই, কারণ তারা সংগ্রাম থেকে মুখ ফিরিয়েছে৷ তারা সব পরগাছা৷ তারা মানব সভ্যতার গ্লানি ও কলঙ্ক৷ মানুষের সংগ্রামের সাথে তাদের কোনও সম্পর্ক নেই৷ সমাজের সমস্ত সম্পদ চোরের মতো আত্মসাৎ করে, মানুষকে ঠকিয়ে তারা নিজেরা উপভোগ করছে৷ এতেও তারা বাঁচে না৷ তাদের মন মরে, শিক্ষা মরে, সংস্কৃতি মরে, শান্তি মরে, তারা কোনও কিছুতেই শান্তি পায় না৷
কিন্তু উল্টোদিকে তাকিয়ে দেখুন৷ ভিয়েতনামের জঙ্গলে যারা লড়াই করেছে, তাদের রাতে ঘুম ছিল না, যে কোনও মুহূর্তে বোমা পড়তে পারে বলে যাদের রাইফেল কাঁধে সারারাত সজাগ থেকে লড়তে হয়েছে, অথবা দুনিয়ার ইতিহাসে যত বিপ্লবী মাঠেঘাটে লড়েছে, তারা কখনও হয়তো ভাল থেকেছে কখনও থাকেনি, তাদের কখনও খাওয়া জুটেছে কখনও জোটেনি৷ কিন্তু খাওয়া জুটলো কিনা, কোনও কিছুর অসুবিধা হল কিনা, পান থেকে চুন খসলো কি না, আরামে থাকা হল কি না তা নিয়ে তাদের কোনও মানসিক বিকার ছিল না৷ তাদের জীবনগুলো দেখুন৷ তারা কেউ স্কিজোফ্রেনিয়ায় ভোগেনি৷ তারা ছিল অতলান্ত প্রশান্তির প্রতিমূর্তি৷ এই যে লোকগুলো তাদের কি দুঃখ–ব্যথা কিছু ছিল না? হ্যাঁ ছিল৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও আনন্দের সাগরে তারা ডুবে ছিল৷ তার কারণ, দুঃখও তাদের কাছে ছিল আনন্দের একটা রূপ৷ দুঃখকে তারা আনন্দের মতো উপভোগ করতে জানত৷
প্রকৃত জ্ঞান মানুষকে বদলে দেয়
এ প্রসঙ্গে আর একটি বিষয় বলে যেতে চাই৷ পুঁথিগত বিদ্যা আর কিছু তর্ক করার ক্ষমতা, বা কিছু তথ্য দেওয়ার ক্ষমতা থাকলেই তাকে জ্ঞানী বলা যায় না৷ বিশেষ করে কেউ যদি ইংরেজি জানেন, আর তাঁর যদি স্মরণশক্তি ভাল থাকে, পড়াশুনো করার একটা ঝোঁক ও উদ্যোগ থাকে, তা হলেই তিনি অনেক কিছু আওড়াতে পারেন৷ কিন্তু তার দ্বারা তাঁর মধ্যে সত্যিকারের উপলব্ধি কতটা ঘটেছে তা বোঝা যায় না৷ আসলে যথার্থ জ্ঞান এবং পাণ্ডিত্যের মধ্যে পার্থক্য কী, এটা অনেকেই ধরতে পারেন না৷ পাণ্ডিত্য হচ্ছে অনেকটা বোঝার মতো, এক অর্থে সেটা নিষ্ফলা৷ কিন্তু জ্ঞান এবং সংগ্রাম পরস্পর ওতপ্রোতভাবে যুক্ত৷
অথচ ভাববাদীরা, পুঁজিপতিরা, পরগাছারা যুগে যুগে ভাবকে করে ফেলেছে তাদের বিলাসিতার সামগ্রী, জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন মানসিক বিলাসের একটা উপকরণ৷ জীবনে তার কোনও প্রয়োগ নেই, শুধু আলোচনার জন্য আলোচনা৷ কিন্তু যে মানুষ এগোতে চায়, যে মানুষ আশাবাদী, যে মানুষের জীবনের প্রতি বিশ্বাস আছে, শ্রদ্ধা আছে, যে মানুষ প্রকৃতির বিরুদ্ধে পরিবেশের বিরুদ্ধে লড়াই করে এগিয়ে যেতে চায়, সে মানুষের এমন জ্ঞান দিয়ে কাজ হবে না৷ তাই ক্রিয়াহীন যে জ্ঞান সেটা জ্ঞানের নামে কুজ্ঞান৷ সেটা এক ধরনের ভাঁড়ামি৷ সে জ্ঞান অনেক সময় মানুষের চিন্তার যে স্বাভাবিক গতি, সাবলীল গতি, চিন্তা করার যে পদ্ধতি তাকেই গুলিয়ে দেয়, মানুষকে অসুস্থ, অপ্রকৃতিস্থ করে৷ তাই তেমন জ্ঞান যথার্থ অর্থে জ্ঞানই নয়৷
সংগ্রামহীন জ্ঞান অলস বিলাসিতা
তা হলে দেখা যাচ্ছে, জ্ঞান বা চিন্তাও একটি ক্রিয়া৷ যে চিন্তা বা জ্ঞান, ক্রিয়া বা সংগ্রামের সাথে যুক্ত নয়, সেটা অলস বিলাসিতা৷ অনেক সময় দেখা যায়, একজন লোক মহাপণ্ডিত, কিন্তু কমপ্লিটলি মাডলড (সম্পূর্ণ তালগোল পাকানো)৷ তিনি অনেক পড়াশুনা করেছেন, কিন্তু শেষপর্যন্ত অধীত বিষয়গুলিকে ইনটিগ্রেট (সংযোজিত) করতে বা মেলাতে পারেননি, অর্থাৎ সিস্টেমেটাইজ (শৃঙ্খলাবদ্ধ) করে, ব্যালেন্স করে (ভারসাম্য বজায় রেখে) বিষয়গুলোকে ধরতে পারেননি৷ তিনি একসময়ে যা ভাবেন, ঠিক পরের মুহূর্তেই তার ঠিক উল্টোটা ভাবছেন৷ আমি এ প্রসঙ্গে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে যেতে চাই৷ সমস্ত কমরেড বিভিন্ন বিষয় খুব মন দিয়ে পড়ুন, ভাল করে পড়ুন, এটা আমি চাই৷ এই যে আমরা পড়াশুনো করছি বা করতে বলছি, সেটাও আমাদের সংগ্রাম পরিচালনারই একটি অঙ্গ৷ এ কথা কেন বলছি? না, আমরা দায়িত্ব বহন করছি, লড়াই পরিচালনা করছি, সাধারণ মানুষের কাছে আমাদের কথাগুলো পৌঁছে দিচ্ছি, তাদের বোঝাবার চেষ্টা করছি, তাদের শিক্ষিত করার চেষ্টা করছি, সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই নিজেদেরও আমরা তৈরি করছি, শিক্ষিত করে গড়ে তুলছি৷ এখানে পড়াশুনো করাটা একটা লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যের সাথে যুক্ত৷ এই সংগ্রামের মধ্য দিয়েই আমাদের অভিজ্ঞতা, বিশ্বাস এবং প্রত্যয় গড়ে উঠছে৷ এটার জন্যপ্রয়োজন আমাদের চিন্তাভাবনাকেও সুবিন্যস্ত করা৷ অবিন্যস্ত চিন্তা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে না পারলে চিন্তার ক্ষেত্রে নানা ধরনের জট দেখা দেয়, মেন্টাল ডিসর্ডার (মানসিক বৈকল্য) দেখা দেয়৷ তাই আমরা প্রসেস অব থিংকিং–এর (চিন্তাপদ্ধতির) উপর এত জোর দিই৷
আর একটা কথা আপনাদের বুঝতে হবে৷ তা হচ্ছে, বিপ্লব মানে কী? কোনও বিশেষ কার্যক্রমকে সম্পূর্ণ করার নাম কি বিপ্লব? না৷ একটা সমাজ পরিবর্তনের দ্বন্দ্বের ধারা–প্রতিধারার সফল পরিণতি হল বিপ্লব৷ যুগ যুগ ধরে বিপ্লব আসছে, বিপ্লব হয়ে চলবে৷ তাই বলছি, বিপ্লব হল ক্রমাগত সাধনা ও সংঘর্ষ, একটা বিরামহীন সংগ্রাম, এর শেষ নেই, এ একটা হায়ার ফর্ম অব স্ট্রাগল (উচ্চস্তরের সংগ্রাম)৷ আপনারা ভাবছেন, আজকের লড়াইটা খুব কঠিন৷ কিন্তু সমস্ত মহান কমিউনিস্ট নেতারা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন, বিপ্লবের পর তাকে রক্ষা করা, সংহত করা আরও কঠিন৷ বিপ্লব–পূর্ববর্তী সংগ্রামের মধ্যে উত্তেজনা আছে, আঘাত আছে৷ সে লড়াই করা এক অর্থে অনেক সহজ৷ বিপ্লবের পরে আরামের সুযোগ, স্বাচ্ছন্দ্যের সুযোগ বেশি৷ সেখানে উত্তেজনার খোরাক কম৷ তখন রাষ্ট্রশক্তি আর প্রত্যক্ষ শত্রু থাকে না৷ তখন লড়াই করতে হয় অপ্রত্যক্ষ শত্রুর বিরুদ্ধে৷ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রযন্ত্রের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আন্তর্জাতিক নীতি সম্পর্কে কোনও বিচ্যুতি ঘটল কি না সে সম্পর্কে তীক্ষ্ণ ও সজাগ দৃষ্টি রাখতে হয় এবং সামান্যতম বিচ্যুতির হাত থেকেও তাকে রক্ষা করতে হয়৷ অর্থাৎ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর এক নতুন ধরনের সংগ্রামে প্রবেশ করতে হয়৷ এই যে আদর্শগত লড়াই যেটা বিপ্লবের আগেও করতে হয়েছে, সেটা কি খুব সহজ লড়াই? বিপ্লবের আগে লড়াইটা শুধু রাজনৈতিক লড়াই ছিল না, সংস্কৃতিগত ক্ষেত্রেও লড়তে হয়েছে৷ এই যে সংস্কৃতিগত ক্ষেত্রে বিপ্লব সেটা বিপ্লবের আগেও যেমন দরকার, সেই বিপ্লবকে রক্ষা করার জন্য বিপ্লবের পরেও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তীব্র আদর্শগত লড়াই প্রয়োজন৷ মার্কসবাদের এটা বুনিয়াদি শিক্ষা৷ তাই রুশ বিপ্লবের আগে লেনিনকে মাখ–এর বিরুদ্ধে, টলস্টয়–এর বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে, এমনকী প্লেখানভ–এর বিরুদ্ধেও কলম ধরতে হয়েছে৷ শুধু অর্থনীতির উপর কেতাব লিখেই হয়নি৷ বিপ্লবটা যদি শুধু অর্থনৈতিক লড়াই হত তা হলে আমাদের এত কিছু আলোচনার দরকার ছিল না৷ দর্শনের এত তত্ত্বের মধ্যে ঢোকারও কোনও প্রয়োজন ছিল না৷
বিপ্লবের প্রতি আনুগত্যের শক্তি অপরাজেয়
আর একটি বিষয় আলোচনা করেই আমি শেষ করব৷ ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট আন্দোলনের যথার্থ প্রতিনিধি হিসাবে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) গড়ে উঠেছে৷ এ প্রসঙ্গে পার্টির সমস্ত কর্মীকে একটি বিষয়ে আমি সচেতন করতে চাই৷ তা হচ্ছে, যে জনগণের জন্য আপনারা লড়ছেন, বহু সময় সেই জনগণের অনেকেই আপনাদের টিটকিরি দেবে, হয়তো বা মারধোর করবে– এ ধরনের অবস্থার সম্মুখীন হওয়ার জন্য এস ইউ সি আই(কমিউনিস্ট)কর্মীদের প্রস্তুত থাকতে হবে৷ যে জনগণের জন্য আপনারা লড়ছেন, আপনাদের লড়াইয়ের উদ্দেশ্য না বুঝে বা ভুল বুঝে তারা আপনাদের অবমাননা করতে পারে৷ দুনিয়ার ইতিহাসে সকল বিপ্লবী আন্দোলনকেই প্রথম দিকে এইসব সহ্য করতে হয়েছে৷ এতে পিছিয়ে পড়ার কিছু নেই৷ এ কথা জেনেই আমরা নেমেছি যে, এই আন্দোলনে অনেক ঝঞ্ঝাট৷ বিপ্লবের এই সাধনায় তাই অনেক শক্তির দরকার৷ সে শক্তি হল জ্ঞানের শক্তি, সাধনার শক্তি, বিপ্লবের প্রতি আনুগত্য ও প্রত্যয়ের শক্তি, আর উন্নত নীতি–নৈতিকতার আধারে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামের শক্তি৷ এটা শুধু নিজের মুক্তির জন্য নয়, সমস্ত মানুষের মুক্তির মধ্য দিয়েই নিজের মুক্তি অর্জনের জন্যই এটা প্রয়োজন৷ আপনারা সকলে সেই সংগ্রামে অনেক বেশি দায়িত্ব নেবেন, নিজেদের যথার্থ ও উপযুক্ত কমিউনিস্ট বিপ্লবী হিসাবে তৈরি করার জন্য নিরলস প্রচেষ্টায় নিমগ্ন থাকবেন– আপনাদের সকলের উদ্দেশে এই আবেদন জানিয়ে আমি এই স্কুল শেষ করছি৷