রাজ্য সরকার জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০-তে ‘ন্যাশনাল কারিকুলাম অ্যান্ড ক্রেডিট ফ্রেমওয়ার্ক ফর আন্ডার গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রাম’ অনুযায়ী চার বছরের ডিগ্রি কোর্সের যে ব্যবস্থা আছে তা কার্যকর করার নির্দেশ জারি করেছে। গত ৩১ মে রাজ্যের উচ্চশিক্ষা দপ্তর এই মোতাবেক প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। এর মাধ্যমে তৃণমূল সরকার কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের জাতীয় শিক্ষানীতি কার্যকর করা শুরু করল।
তৃণমূল সরকার নির্বাচনী রাজনীতির স্বার্থে বিজেপির বিরুদ্ধে নানা কথা বললেও জাতীয় শিক্ষানীতির ক্ষেত্রে বিরোধিতা দূরে থাক, অনেকটা আগ বাড়িয়ে তাকে কার্যকর করতে উদ্যোগী হয়েছে। শিক্ষা যেহেতু যুগ্ম তালিকায় আছে, প্রশ্ন উঠেছিল পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল রাজ্য সরকার, যারা বিজেপির বিরুদ্ধে হামেশাই নানা তর্জন-গর্জন করে, জাতীয় শিক্ষানীতির প্রশ্নে তার ভূমিকা কী হবে। এই প্রশ্ন বারবার ওঠায় তৃণমূল সরকার বিকল্প শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য কয়েক বছরের ব্যবধানে দুটি কমিটি তৈরি করে। ভাবখানা এমন, তাঁরা জাতীয় শিক্ষানীতি মানেন না, তাই বিকল্প নীতির খোঁজ। পার্থ চ্যাটার্জি যখন শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন তখন একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল। তার রিপোর্ট দেখার সুযোগ কারও হয়নি। ব্রাত্য বসু মন্ত্রী হয়ে দ্বিতীয় একটি কমিটি করলেন, দেশ-বিদেশের অনেক দর-ভারওয়ালা লোকজনকে তার সদস্য করা হল। কিন্তু সরকারি অর্থের অঢেল অপচয়ের বিনিময়ে কোনও বিকল্প নীতির সন্ধান তাঁরা পেলেন কিনা তা করদাতারা জানতে পারলেন না, বারবার দাবি উঠলেও তাঁরা জনসাধারণকে তা জানানোর প্রয়োজন বোধ করেননি। অবশেষে ঝুলি থেকে বিড়াল বেরিয়ে পড়ল। গত ১৭ মার্চ রাজ্যের উচ্চশিক্ষা দপ্তর রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে চিঠি দিয়ে ৪ বছরের ডিগ্রি কোর্স চালু করার প্রক্রিয়া শুরু করল, আবারও একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করল এবং ৩১মে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সরকারিভাবে চালু করে দিল। এর মাধ্যমে তৃণমূল সরকার কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের জাতীয় শিক্ষানীতি কার্যকরী করা শুরু করল। ৪ বছরের ডিগ্রি কোর্স চালু করার মাধ্যমে এই প্রথম স্পষ্ট হল, এই সরকার জনবিরোধী জাতীয় শিক্ষানীতিরই পক্ষে এবং তা তাঁরা চালুও করবেন।
নতুন এই ব্যবস্থায় কী থাকছে
উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর কলেজে স্নাতক স্তরে (ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেলের মতো পেশাগত বিষয় ছাড়া) জেনারেল বা অনার্স পড়তে এতদিন তিন বছর লাগত। এখন থেকে অনার্স পড়তে গেলে চার বছর লাগবে। কিন্তু এছাড়াও অনেক কথা আছে। যেমন, কেউ এক বছর বা দুই সেমিস্টার পাশ করে যদি পড়াশোনা ছেড়ে দেয় তাহলে সে একটি সার্টিফিকেট পাবে। যদি দুই বছর বা চার সেমিস্টার পাশ করে ছেড়ে দেয়, তাহলে তাকে ডিপ্লোমা দেওয়া হবে। তিন বছর বা ছয় সেমিস্টার সম্পূর্ণ করে ছেড়ে দেয় তাহলে সে স্নাতক ডিগ্রি পাবে। আর যে চার বছর বা আট সেমিস্টার পাশ করবে, তাকে চার বছরের মাল্টিডিসিপ্লিনারি স্নাতকের অনার্স শংসাপত্র দেওয়া হবে এবং যে এর সঙ্গে গবেষণা করবে তাকে মাল্টিডিসিপ্লিনারি স্নাতকের (গবেষণা সমেত অনার্স) শংসাপত্র দেওয়া হবে। শেষেরটির গুরুত্ব সব থেকে বেশি হবে এবং সেই পড়ুয়া এক বছরের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পাওয়ার উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবে। তাহলে বাকি সার্টিফিকেট, ডিপ্লোমা বা কেবল স্নাতক ডিগ্রিধারীদের ভবিষ্যৎ কী হবে? অর্থাৎ সরকারি ব্যবস্থাপনার হাত ধরে পাঁচ ধরনের নাগরিক সৃষ্টির ব্যবস্থা হল।
আবার সব থেকে বেশি কৌলীন্যের শিরোপা নিয়ে যাঁরা কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরোবেন তাঁদের অবস্থা দেখুন। তাঁদের হাতে থাকবে ‘মাল্টিডিসিপ্লিনার’ নামক গালভরা খেতাব। এর মানে হল, তাঁরা ছাত্রাবস্থায় প্রভূত স্বাধীনতা পেয়েছেন, যার বলে প্রথম বছর পাঠ্য বিষয়গুলি যে কম্বিনেশনে পড়েছেন, দ্বিতীয় বছর আর একটি কম্বিনেশনে পড়েছেন, তৃতীয় বছর অন্য আর একটি কম্বিনেশনে। যেমন, প্রথম বছর হয়ত পদার্থবিদ্যা ও ফ্যাশান ডিজাইন, দ্বিতীয় বছর অর্থনীতি ও রসায়ন, তৃতীয় বছর বাংলা ও মনস্তত্ববিদ্যা ইত্যাদি। অর্থাৎ পাঠ্য বিষয়গুলির মধ্যে কোনও মিলমিশ নেই– সম্পর্কহীন, সংযোগহীন কিছু বিষয়, যার মাধ্যমে পড়ুয়াদের মধ্যে সুসংবদ্ধ জ্ঞান গড়ে ওঠার কোনও সুযোগ নেই এবং যা বিদ্যার্থীর মনে যুক্তিবাদী মানসিকতা, মননশীলতার বিকাশে কোনও সাহায্য করবে না। খুব স্বাভাবিকভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে যে বিষয়ের কম্বিনেশন নিলে নম্বর বেশি উঠবে তাই নেওয়ার প্রবণতা কাজ করবে। তাতে হয়ত নম্বর বেশি উঠবে, কিন্তু জ্ঞান অর্জন হবে কি? এঁরাই হবেন বিজেপি-র দাবি অনুযায়ী তাঁদের পরিকল্পিত উচ্চশিক্ষার সর্বোৎকৃষ্ট ফসল। পড়ুয়াদের পাঠ্যবিষয় নির্বাচনের এমন অদ্ভূত স্বাধীনতা প্রদানকে তাঁরা ‘বিদ্যার্থী-কেন্দ্রিক’ শিক্ষা ব্যবস্থা বলছেন এবং দাবি করছেন, এমন ব্যবস্থা নাকি এর আগে কোনওদিন হয়নি। শিক্ষাবিজ্ঞানের ভাষায় বিদ্যার্থী-কেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার একটি ধারণা আছে, তার সঙ্গে বিজেপি-আরএসএস এর মস্তিষ্কপ্রসূত এই পরিকল্পনার কোনও সম্পর্ক নেই। স্বাধীনতা দেওয়ার নামে ছাত্র-ছাত্রীদের বিভ্রান্ত করে তাঁদের অমানুষ করার এটা এক গভীর ষড়যন্ত্র। প্রশ্ন হল, এতগুলো কম্বিনেশনে পড়ে তিনি যে বিষয়ে অনার্স ডিগ্রি পাবেন, সেই বিষয়ে তাঁর কি জ্ঞানের গভীরতা সৃষ্টি হবে?
আর একটি বিষয় আছে যা আপাতদৃষ্টিতে হাস্যকর মনে হলেও উচ্চশিক্ষায় যতটুকু শৃঙ্খলা আছে তাকে বিপর্যস্ত করার পক্ষে যথেষ্ট। তা হল ‘মাল্টিপল এন্ট্রি’ ও ‘মাল্টিপল এক্সিট’ এবং ‘অ্যাকাডেমিক ব্যাঙ্ক অফ ক্রেডিট’। এর অর্থ হল, একজন পড়ুয়া এক কলেজে কিছুদিন পড়ে ক্রেডিট সংগ্রহ করে সেই কলেজ ছেড়ে আর এক কলেজে ভর্তি হতে পারবেন। সেখানে কিছুদিন পড়ে ক্রেডিট সংগ্রহ করে আর এক জায়গায় ভর্তি হতে পারবেন। এমন করে যাওয়া-আসা করতে করতেই চার বছরের কোর্স সর্বোচ্চ সাত বছর সময়ে সম্পূর্ণ করতে পারবেন। মাঝের বছরগুলোতে যে ক্রেডিট অর্জন করবেন তা উক্ত অ্যাকাডেমিক ব্যাঙ্ক অফ ক্রেডিটে জমা হতে থাকবে এবং নির্দ্দিষ্ট পরিমাণ ক্রেডিট সংগ্রহ হলেই তিনি ডিগ্রি পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবেন। যে কলেজগুলোতে তিনি ভর্তি হবেন তা দেশ জুড়ে যে কোনও জায়গায় থাকতে পারবে। এর মানে কিন্তু এই নয় যে কোনও ছাত্র নতুন কোনও অনামী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বছর পড়ে দ্বিতীয় বছর কলকাতা, যাদবপুরের মতো কোনও সামনের সারির বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়ে যাবেন। তা নির্ভর করবে আসন খালি থাকা না থাকার উপর। প্রশ্ন হল, তিনি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি পাবেন?
দক্ষতা বা স্কিল সৃষ্টি করা উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য হতে পারে না
এখানেই শেষ নয়। এই শিক্ষার মুখ্য উদ্দেশ্য মৌলিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা নয়, ছাত্রদের মধ্যে দক্ষতা বা স্কিল সৃষ্টি করা। তার জন্য উক্ত শিক্ষার্থীদের মাঝে মাঝে স্থানীয় শিল্প ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান যদি কিছু থাকে বা হাতের কাজ যাঁরা করেন তাদের কাছে ইন্টার্নশিপ করতে পাঠানো হবে। তাতে নাকি তাদের শিক্ষান্তে চাকরি পাওয়ার যোগ্যতার বিকাশ হবে! লাখ লাখ ডিপ্লোমা ও গ্র্যাজুয়েট ইঞ্জিনিয়ার যেখানে বেকার, তাতে এই স্কিল দিয়ে চাকরি পাওয়ার কি সুবিধা হবে? রসিকতারও একটা সীমা থাকা উচিত! পঠন-পাঠনের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহারের উপর জোর, ভারতীয় ঐতিহ্যের নামে মধ্যযুগীয় ভাবধারার জাবর কাটা, অনলাইন, দূর-শিক্ষা, অফলাইন, হাইব্রিড, ব্লে্ন্ডেড বা মিশ্রপদ্ধতি যে কোনওভাবেই বিদ্যার্জনের সুযোগ– এই হল নতুন ব্যবস্থার অভিনব আরও কিছু দিক। এত কিছুর সারমর্ম হল, এই স্নাতক কোর্স চার বছরের– তার মধ্যে যে কোনও বছরে ছেড়ে চলে যাওয়া যাবে এবং তদনুযায়ী সার্টিফিকেট পাওয়া যাবে, খেয়াল-খুশি মতো কলেজ ছেড়ে দিয়ে অন্য যেকোন কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া যাবে, প্রতি বছর পাঠ্য-বিষয় পরিবর্তন করা যাবে। এমন আজগুবি ব্যবস্থাকে তাঁরা নজিরবিহীন বলে দাবি করছেন। আসলে এমন স্বাধীনতা দেওয়ার (পড়ুয়া-কেন্দ্রিক) নামে তাঁদের কেরিয়ারে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হবে, তা হবে নজিরবিহীন। কিছু না-শেখা, না-জানা, নম্বর-সর্বস্ব এক শ্রেণির অনার্স ডিগ্রিধারীর জন্ম হবে যাঁরা না পাবেন চাকরি, না পারবেন স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তি হতে, গবেষণা করার যোগ্যতাও কার্যত তাঁদের থাকবে না। অন্যদিকে স্নাতক স্তরের কলেজ ও অ্যাফিলিয়েটিং বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পড়ুয়া ভর্তির অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হবে, কারণ কোনও ছাত্র কখন ভর্তি হবে এবং কখন ছেড়ে যাবে তার নিশ্চয়তা থাকবে না। তার উপর চার বছরের জন্য যে অতিরিক্ত শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষক ও অন্যান্য পরিকাঠামোর প্রয়োজন হবে তা কোথা থেকে আসবে, তার আর্থিক দায়িত্ব কে নেবে সে ব্যাপারে কলেজগুলি খুবই শঙ্কিত। আমাদের মতো শিক্ষা ক্ষেত্রে শুধুই ‘নেই-নেই’-এর রাজ্যে এই আশঙ্কার যথেষ্ট কারণ আছে। ফলে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি দ্রুত অস্তিত্ব সংকটের সম্মুখীন হবে। সরকার পোষিত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির সামনে ঝুলবে বিলুপ্তির অশনি সংকেত। অভিভাবকরা দৌড়োবেন তাঁদের সন্তান-সন্ততিকে নিয়ে মহার্ঘ বেসরকারি কলেজের আঙিনায়। শিক্ষার বেসরকারিকরণের জন্য প্রস্তুত থাকবে লাল-গালিচা অভিবাদনের উজ্জ্বল সম্ভাবনা।
শ্রেণি-কক্ষের পরিবর্তে অনলাইন বা প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষা প্রকৃত মানুষ তৈরির পথে বাধা
প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু বলা প্রয়োজন। এই শিক্ষানীতি অনলাইন শিক্ষার উপর জোর দিয়েছে। ৫০ শতাংশের বেশি পড়ুয়াকে সেই ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করবে বলে সরকার পরিকল্পনা করেছে। এমনকি ১০০ শতাংশ অনলাইন শিক্ষাভিত্তিক স্নাতক ডিগ্রি প্রদানের কলেজও তাঁরা খোলার অনুমতি দিচ্ছেন। কম্পিউটার-ল্যাপটপ-স্মার্টফোন-ইন্টারনেট-অ্যাপ ভিত্তিতে এই শিক্ষা প্রদান করা হবে। এখানে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় গড়তে হবে না, লাইব্রেরি-ল্যাবরেটরি তৈরি করতে হবে না, শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে না। ‘ব্লেন্ডেড’ ব্যবস্থায় ক্লাস নেওয়ার দায়িত্বও শিক্ষকদের থাকবে না, তাঁদের লেকচার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে আপলোড করা থাকবে, পড়ুয়ারা তা ডাউনলোড করে শুনে নেবে। একবার লেকচার আপলোড করলে তা কয়েক বছর থাকবে। তখন আর শিক্ষকের প্রয়োজন হবে না। এই ব্যবস্থায় নতুন শিক্ষক নিয়োগের দায়িত্ব কমে যাবে। ফলে সরকারের আর্থিক দায়িত্ব লঘু হবে। বিত্তশালীরা ছাড়া অন্যরা এই শিক্ষার নাগাল পাবে না। যদি কম্পিউটার-ল্যাপটপ-স্মার্টফোন সবার থাকেও, তাতেও কি আমরা দীর্ঘদিনের প্রচলিত ও সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা শ্রেণি-কক্ষ শিক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তে অনলাইন শিক্ষাকে বিকল্প হিসাবে বেছে নিতে পারি? অনলাইন শিক্ষা শ্রেণি-কক্ষ ভিত্তিক মূলধারা শিক্ষার সহায়ক হতে পারে, কিন্তু তা তার বিকল্প হতে পারে না। ‘শিক্ষাবিধি’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,‘মানুষ মানুষের কাছ হইতেই শিখিতে পারে … প্রাণের দ্বারাই প্রাণ সঞ্চারিত হইয়া থাকে, … গুরুশিষ্যের পরিপূর্ণ আত্মীয়তার সম্বন্ধের ভিতর দিয়াই শিক্ষা কার্য সজীব দেহের শোণিত স্রোতের মতো চলিতে পারে। যে অনলাইন শিক্ষার ওপর এই নীতি জোর দিয়েছে তাতে প্রযুক্তিনির্ভর যন্ত্রই হল ‘গুরু’ বা শিক্ষক। প্রশ্ন হল যন্ত্র কি কিশোর মনে ‘প্রাণ সঞ্চার’ করবে? ‘গুরু-শিষ্যের আত্মীয়তার’ সম্পর্ক গড়ে তুলবে? তাদের মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখাবে? মননশীলতা সৃষ্টি করবে? না যন্ত্র কেবল যন্ত্রবৎ বা ‘রোবোটিক’ কিছু মানুষের জন্ম দেবে? একদিকে অতীত যুগের গুরুকুল ব্যবস্থা ও গুরু-শিষ্য পরম্পরা উল্লেখ করে ঐতিহ্যের বড়াই করা ও হিন্দুত্ববাদের উস্কানি দেওয়া, অন্যদিকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মানসিক সংযোগবিহীন শুধুমাত্র প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষায় জোর দেওয়া– সীমাহীন দ্বিচারিতা ছাড়া কিছুই নয়। কম্পিউটার ইত্যাদি কেনার আর্থিক সামর্থকে ভিত্তি করে যে ‘ডিজিটাল ডিভাইড’ তার ফলে দু’ধরনের ছাত্রেরও সৃষ্টি হবে। আবার ১৩৭ কোটির দেশের ছাত্রসমাজকে যদি ল্যাপটপ-স্মার্টফোন কিনতে, আম্বানিদের মতো ব্যবসায়ীদের ‘ডেটা’ সিম ব্যবহার করতে, কর্পোরেট সৃষ্ট নানা কিসিমের ‘লার্নিং অ্যাপ’ কিনতে বাধ্য করা যায় তাতে কর্পোরেট হাউসগুলির আশীর্বাদও জুটবে শাসকগোষ্ঠীর মাথায়।
পিছিয়ে যাওয়ার প্রশ্ন ওঠেই না
এখানে একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের অবতারণা প্রয়োজন। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে চার বছরের ডিগ্রি কোর্স চালু করতে গিয়ে তৃণমূল, সিপিএম সমেত সমস্ত শাসক দল যে প্রশ্ন উত্থাপন করছে তা হল, সারা দেশে ইউজিসি-র নির্দেশে যদি চার বছরের ডিগ্রি কোর্স চালু হয়ে যায় তা হলে যে রাজ্যে তা চালু হবে না, সেখানকার পড়ুয়ারা পিছিয়ে যাবে। প্রথমত, যে কোর্সের শিক্ষাগত যৌক্তিকতাই নেই, যা এতক্ষণ আলোচনা করা হল, তা না পড়লে পিছিয়ে যাওয়ার প্রশ্ন আসে কোথা থেকে? দ্বিতীয়ত, রাজ্য সরকার বা উক্ত দলগুলি কি এখনই জানল যে কেন্দ্রীয় সরকার সারা দেশে চার বছরের ডিগ্রি কোর্স চালু করতে যাচ্ছে? তারা জেনেছিল ২৯ জুলাই ২০২০। প্রায় তিন বছর সময় পেয়েও রাজ্য সরকারগুলি কেন কেন্দ্র বা ইউজিসি-র কাছে এই নীতির অসুবিধার দিকগুলি তুলে ধরেনি? তৃণমূল সরকার অতীতের দুটি কমিটির রিপোর্ট জনসমক্ষে আনেনি, তৃতীয় কমিটির রিপোর্টেই সুপারিশ করে দিল, কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ মোতাবেক চলতে হবে! তৃতীয়ত, বর্তমানে প্রচলিত তিন বছরের অনার্স ডিগ্রি কোর্সের সীমাবদ্ধতা কোথায় ছিল, যার জন্য তাকে তুলে দিতে হবে, তা কি কেন্দ্রীয় সরকার দেখিয়েছে? তাহলে অনার্স ডিগ্রি পেতে গেলে এক বছর অতিরিক্ত পড়তে হবে কেন? সময়ের অপচয় না করে কেন তিন বছরের মধ্যে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলি পড়িয়ে দেওয়া হবে না? তাতে তিন বছরেই অনার্স ডিগ্রির প্রয়োজনীয় ক্রেডিট সংগ্রহ হতে পারত। চতুর্থত, নতুন ব্যবস্থাতেও তিন বছরের স্নাতক কোর্স থাকছে, তা সম্পূর্ণ করলে দু’বছরের স্নাতকোত্তর পড়া ও তারপর ডক্টরেট ডিগ্রি করার সুযোগ থাকছেই। তাহলে কেবল অনার্সের কথা বলে একজনকে অতিরিক্ত এক বছর পড়তে হবে কেন? এপ্রশ্নগুলো কি তৃণমূল, সিপিএম বা অন্য শাসকদলগুলো ইউজিসি-কে করেছে? নাকি সেই দায় এড়িয়ে গিয়ে কেন্দ্রের সুপারিশ মেনে শিক্ষার সর্বনাশের পথই প্রশস্ত করছে?
চার বছরের ডিগ্রি কোর্স শিক্ষায় বিদেশি বিনিয়োগের রাস্তা সুগম করবে
আসলে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এই চার বছরের ডিগ্রি কোর্সের তত্ত্বটি মার্কিন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা থেকে নকল করেছে এবং তা করার আগে একবারও ভেবে দেখেনি যে তা এদেশের জন্য উপযুক্ত কিনা। অন্যদিকে এদেশে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস খোলার যে ব্যবস্থা তারা করছে, তাতে ভর্তির জন্য চার বছরের স্নাতক ডিগ্রিধারী পড়ুয়া লাগবে। অর্থাৎ শিক্ষায় ‘ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট’ বা সরাসরি বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগের রাস্তাকে মসৃণ করার ব্যবস্থা তারা করছে। অথচ এই শিক্ষানীতির ছত্রে ছত্রে তারা ভারতীয় সনাতন ঐতিহ্য ও তার শিক্ষাপদ্ধতির পক্ষে সওয়াল করেছে। কাজেই, এই শিক্ষানীতি ভারতীয় ঐতিহ্যের গভীরে প্রোথিত বলে বিজেপি সরকার যতই বড়াই করুক, বাস্তবে ভারতের পরিবেশ-পরিস্থিতি, পরিকাঠামো এবং সর্বোপরি ভারতীয় ছাত্রসমাজের স্বার্থের কথা না ভেবে শুধুমাত্র ব্যবসার স্বার্থে বিদেশ থেকে সুবিধামতো কপি-পেস্ট করাই হচ্ছে এর মূল উদ্দেশ্য। তৃণমূল সরকারও কেন্দ্রবিরোধী নানা স্লোগান দিতে দিতে বিজেপি সরকারের এই নির্লজ্জ পদক্ষেপকেই কার্যত বিনা বাক্যব্যয়ে সমর্থন করল।
রাজ্য জুড়ে এর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। উচ্চশিক্ষার সঙ্গে যুক্ত শিক্ষকরা প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন। বিশেষ করে সারা বাংলা সেভ এডুকেশন কমিটি লাগাতার প্রতিবাদে সামিল হয়েছে এবং ১৭ জুন কলকাতায় এর বিরুদ্ধে কনভেনশনের ডাক দিয়েছে। এস ইউ সি আই (সি) ১-৭ জুন সারা বাংলা প্রতিবাদ দিবস পালন করেছে। দলের রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য বলেছেন, যে ব্যবস্থা তারা চালু করতে চাইছে তাতে স্নাতক স্তরের শিক্ষা প্রহসনে পরিণত হবে এবং শিক্ষা-বিবর্জিত স্নাতক তৈরির কারখানায় পর্যবসিত হবে বর্তমান কলেজগুলি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ভবিষ্যতও অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে।