‘‘ভারতবর্ষের শাসক সম্প্রদায় জাতির নৈতিক চরিত্রটিকে সম্পূর্ণরূপে ভেঙে ফেলার যড়যন্ত্রে লিপ্ত৷ তারা অত্যন্ত ধুরন্ধর৷ তারা জানে যে শত অত্যাচার ও দমনপীড়ন করেও, না খেতে দিয়েও একটা জাতিকে, একটা দেশের জনসাধারণকে শুধু পুলিশ ও মিলিটারির সাহায্যে বেশিদিন পদদলিত করে রাখা যায় না৷ সমস্ত যুগের স্বৈরাচারী শাসকদের অত্যাচারের ইতিহাস একটি কথা বাতলায় যে শোষণ এবং দমন দিয়ে, পুলিশি শাসন ও মিলিটারি শক্তি দিয়ে শেষ পর্যন্ত জনশক্তিকে দমানো যায় না, ক্ষমতা রক্ষা করা যায় না৷ জনশক্তি মাথা উঁচু করে উঠে দাঁড়ায় যদি তারা সঠিক বিপ্লবী আদর্শের হদিশ পায় এবং তাদের নৈতিক বল অটুট থাকে৷’’
…
‘‘বিপ্লব সেই জনসাধারণই করতে পারে, যারা বিপ্লবী রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্যে শিক্ষিত হয়ে খানিকটা অর্থে বিপ্লবের উপযোগী মানসিকতা এবং সংস্কৃতির অধিকারী হয়েছে৷ যে কোনও উপায়ে মানুষকে উত্তেজিত করলেই তার দ্বারা বিপ্লব হয় না, বিপ্লবের নামে প্রতিক্রিয়ার জমি তৈরি হয়৷ ভারতের মাটিতে বারবার ঠিক এই জিনিসটি ঘটেছে৷ ফলে, এই মারাত্মক ভুল রাজনীতি ও কার্যকলাপের জন্য সমাজমানসে যে যুক্তিহীন মানসিকতা বিরাজ করছে তারই সুযোগে আজ প্রতিক্রিয়ার প্রবল অনুপ্রবেশ ঘটেছে৷’’
…
‘‘ইলেকশন হচ্ছে একটা বুর্জোয়া পলিটিক্স৷ জনগণের রাজনৈতিক চেতনা না থাকলে, শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রাম এবং শ্রেণিসংগঠন না থাকলে, গণআন্দোলন না থাকলে, জনগণের সচেতন সংঘশক্তি না থাকলে শিল্পপতিরা, বড় বড় ব্যবসায়ীরা, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিরা বিপুল টাকা ঢেলে এবং সংবাদমাধ্যমের সাহায্যে যে হাওয়া তোলে, যে আবহাওয়া তৈরি করে, জনগণ উলুখাগড়ার মত সেহ দিকে ভেসে যায়৷’’
…
‘‘একটা সরকারের বিরুদ্ধে যখন জনগণ বীতশ্রদ্ধ ও বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে তখন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আরেকটা সরকার আসে৷ সাধারণ মানুষ কতকগুলি লোককে অসৎ মনে করে ভাবে সেহ লোকগুলিকে সরিয়ে দিয়ে তার জায়গায় অন্য কতকগুলি সৎ লোক এসে বসলেহ তাদের মঙ্গল হবে৷ এ ধরনের প্রচার বুর্জোয়া রাজনীতিবিদরা করে থাকে৷ কাজেহ আমি শ্রমিক–কৃষক–মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে বলছি, তাঁরা যেন এহ ধরনের ভাঁওতায় না ভোলেন৷ … ভোটের মারফৎ হাজার বার সরকার পাল্টে বা আক্ষরিক অর্থে আহনকানুন সংশোধন করার চেষ্টার মধ্যে দিয়ে জনসাধারণের পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ও পুঁজিবাদী শোষণ ব্যবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব৷ এহ মুক্তি অর্জনের একমাত্র পথ হচ্ছে, জনসাধারণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সঠিক বিপ্লবী কায়দায় পরিচালনার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে জনসাধারণের অমোঘ সংঘশক্তি গড়ে তোলা এবং বিপ্লবী শ্রমিকশ্রেণির দলের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করা৷’’
…
‘‘আমি যে জায়গাটা নির্দিষ্ট করে বারবার বলতে চাইছি, তা হচ্ছে, ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন, দুর্বার আন্দোলন আগেও হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে৷ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনই হবে৷ কিন্তু, এই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের নেতৃত্ব যদি ভুল পার্টি, অমার্কসবাদী পার্টি, অবিপ্লবী পার্টির হাতেই থেকে যায়, অর্থাৎ এমন দলগুলোর হাতে থেকে যায়, যারা বিপ্লবের নাম ভাঙিয়ে চলে, বিপ্লব–বিপ্লব খেলা করে, অর্থাৎ অসময়ে উগ্র আচরণ করে বিপ্লবের শক্তিকে নিঃশেষিত করে দেয়, আর না হয় বিপ্লব–বিপ্লব স্লোগানের আড়ালে শেষপর্যন্ত সংসদীয় রাজনীতির গণ্ডির মধ্যেই গণআন্দোলনগুলিকে আটকে রাখতে চায়, তাহলে সেই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন সঠিকভাবে পরিচালনা করা কিছুতেই সম্ভব হতে পারে না৷’’
…
‘‘দল যদি অবিপ্লবী দল হয়, তার রাস্তা যদি ভুল হয়, তার বিপ্লবের তত্ত্ব যদি ভুল হয়, তাহলে বিপ্লব–বিপ্লব খেলায় সমস্ত জনগণের কোরবানি, কর্মীদের আত্মত্যাগ হেলায় নষ্ট হয়ে যায়৷ ফলে, জনগণ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে এবং সেই সুযোগে প্রতিক্রিয়া আবার শক্তিশালী হয়৷ কাজেই একটা ভুল রাজনৈতিক দল– নীতি, আদর্শ, সংস্কৃতি, রুচি, রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সমস্ত দিক থেকে ইতিহাস আলোচনা করলেও দেখা যাবে যার মধ্যে ক্ষয় ধরে গিয়েছে, ক্ষয়িষ্ণু–আজও বড় দল বলে যদি তেমন দলেরই আপনারা পৃষ্ঠপোষকতা করেন, তা হলে সেই বড় দল আন্দোলনকে বিপথগামী করবেই, এবং সর্বনাশ আরও বেশি হবে৷ একটা দল বড় কি ছোট, এটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ঠিকই৷ কিন্তু, তার চেয়েও একটা বড় প্রশ্ন রয়েছে, তা হচ্ছে দলের রাজনীতিটা ঠিক কি না, দলের চরিত্রটা ঠিক কি না, এবং দলটা সত্যিকারের বিপ্লবী দল কি না৷’’
…
‘‘ফ্যাসিবাদ হচ্ছে একটি সর্বাত্মক প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থান৷ একদিকে সে মানুষের চিন্তাভাবনাগুলোকে মেরে দিয়ে তাকে আত্মকেন্দ্রিক করে তোলে, মানুষের জ্ঞানবিদ্যাবুদ্ধিকে কারিগরিমুখী করে তোলে, অর্থাৎ দেশে একদল টেকনোক্র্যাট (শিক্ষিত কারিগর) সৃষ্টি করে– যারা মানবিক লক্ষ্য থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যুত, মানুষের প্রতি এবং সমাজের প্রতি যাদের কোনও দায়িত্ববোধ নেই, যারা চাকরিকে এবং গোলামিকেই সর্বস্ব বলে মনে করে, পয়সার বিনিময়ে তারা যা কিছু করতে পারে এবং এইভাবে বিজ্ঞানের চর্চা ও বিদ্যাকে তারা প্রবাহিত করে৷ অপরদিকে যত অধ্যাত্মবাদ, সেকেলে যত রকমের কুসংস্কার, যত যুক্তিহীন মানসিকতা এবং অন্ধতাকে গড়ে তোলে৷ ফ্যাসিবাদ হচ্ছে অধ্যাত্মবাদ, তমসাচ্ছন্ন ভাবনাধারণা এবং যুক্তিহীনতার সাথে কারিগরি বৈজ্ঞানিক বিদ্যার এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ৷ এরকম ঘটনা যখন দেশে ঘটে তখন যুক্তিবাদী মন দেশে মরে যায়৷ … দেশের জমিতে যখন যুক্তিবাদী মন মরে যায় তখনই প্রতিক্রিয়াশীল ভাবধারা সমাজজীবনে প্রবেশের সহজ রাস্তা সৃষ্টি হয়৷ একদিকে উগ্র জাতীয়তাবাদের বিষে মানুষকে ফ্যানাটিক (অতিশয় উগ্র) করা, অন্যদিকে পুরনো ঐতিহ্যবাদ এবং ভাসাভাসা সমাজতন্ত্র, বিপ্লব, আর প্রগতির স্লোগান– এই তিনটিকে যদি একত্রে মেলানো যায় তাহলেই একটা দেশে ফ্যাসিবাদের জমি তৈরি হয়৷ মনে রাখা দরকার, শাসক বুর্জোয়া শ্রেণি দেশের বুদ্ধিজীবীদের বিভ্রান্ত করে একমাত্র তখনই এই তিনটিকে সুন্দরভাবে মেলাতে পারে যখন দেশে সত্যই যুক্তিবিজ্ঞানের ভিত্তিতে আলাপ–আলোচনার মনোভাব সমাজজীবন থেকে তিরোহিত হয়ে যায়৷ এরূপ অবস্থাতেই ফ্যাসিবাদ গড়ে ওঠার সুবর্ণ সুযোগ৷’’
(২৪ এপ্রিল দলের প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক কমরেড শিবদাস ঘোষের কয়েকটি ভাষণের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ উদ্ধৃত করা হল)