২১ জানুয়ারি লেনিন মৃত্যুশতবর্ষের সমাপনী সমাবেশ সফল করুন

লেনিনের দেখানো পথেই শোষণমুক্তি সম্ভব

এ বছর ২১ জানুয়ারি বিশ্বের বুকে প্রথম শোষণবিহীন সমাজ সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা, বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনের মহান নেতা কমরেড লেনিনের ১০১তম মৃত্যুদিবস। এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) কেন্দ্রীয় কমিটি ডাক দিয়েছিল এই শতবর্ষকে যথাযথ গুরুত্ব সহ পালন করার মধ্য দিয়ে লেনিনের বিপ্লবী শিক্ষা শোষিত জনতার সামনে তুলে ধরার। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে দলের সমস্ত নেতা-কর্মী শ্রমিক-কৃষক সহ দেশের শোষিত শ্রমজীবী মানুষ, বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক মানুষ, বুদ্ধিজীবী—সবাইকে যুক্ত করে এই কর্মসূচি পালন করছেন। সারা দেশে গড়ে উঠেছে অজস্র ‘লেনিন মৃত্যুশতবার্ষিকী কমিটি’। এই কমিটিগুলিতে সমবেত হয়েছেন অসংখ্য বামপন্থী মানুষ, গণতান্ত্রিক মানুষ, শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী সহ নানা স্তরের বুদ্ধিজীবীরা। তাঁরা সক্রিয় অংশ নিয়ে শতবর্ষ উদযাপনের কর্মসূচিকে সফল করার উদ্যোগ নিয়েছেন। অজস্র আলোচনা সভা হয়েছে। লেনিন ও রুশ বিপ্লবের ছবির প্রদর্শনী, লেনিনের মূল্যবান বক্তব্য থেকে উদ্ধৃতি প্রদর্শনী, লেনিনের গুরুত্বপূর্ণ বইগুলির ব্যক্তিগত এবং যৌথ পাঠ এবং তা নিয়ে চর্চা হয়েছে। মিছিল, স্কোয়াড, পথসভা হয়েছে। এই সব সভাগুলিতে শোষিত, নিপীড়িত মানুষ মন দিয়ে শুনেছেন শোষণ-অত্যাচার-বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ কী।

যুগ যুগ ধরে দুনিয়ার নিপীড়িত অসহায় মানুষের মনে এই প্রশ্ন ধাক্কা দিয়েছে–ধনী-গরিবের পার্থক্য কি কোনও দিন ঘুচবে না? দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার কি কোনও দিন বন্ধ হবে না? মানুষে মানুষে সমানাধিকার কি কোনও দিন প্রতিষ্ঠিত হবে না? অসহায় নিপীড়িত মানুষের এই বেদনা মহান মানুষদের হৃদয়কে আলোড়িত করেছে। নানা ভাবে তাঁরা এইসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রাণপাত চেষ্টা করেছেন, সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু যথার্থ উত্তর তাঁরা পাননি। সমস্যার সমাধানও করতে পারেননি।

যে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে তাঁদের আবির্ভাব হয়েছিল, সেই পরিস্থিতিতে এইসব সমস্যার সমাধান সম্ভবও ছিল না। সমাজ বিকাশের একটা নির্দিষ্ট স্তরে এসে এই প্রশ্নের, এই সমস্যার সমাধান সম্ভব হল। মানুষের জ্ঞানজগতের সামনে এই সত্য প্রতিভাত হল যে অসাম্যের উৎস শ্রেণিশোষণ। একমাত্র এই শ্রেণিশোষণের অবসানের মধ্যে দিয়েই দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার বন্ধ করা সম্ভব। আর এই শ্রেণিশোষণ বন্ধ করা যাবে যদি উৎপাদন উপকরণের উপর ব্যক্তিমালিকানার পরিবর্তে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা যায়। অর্থাৎ সর্বহারা শ্রেণির একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করা যায়।পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে উৎখাত করে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো কায়েম করে শ্রেণিহীন সাম্যবাদী সমাজের দিকে এগোনো যায়।

এঙ্গেলস বলেছেন, ‘এতদিন মানুষ পরলোকে স্বর্গ পাওয়ার কল্পনা করেছে। আমরা সেই স্বর্গ এই মাটির পৃথিবীতেই প্রতিষ্ঠা করতে চাই।’ এই স্বর্গ বলতে এঙ্গেলস শোষণহীন সমাজব্যবস্থার কথা বলেছেন—যেখানে সমস্ত রকম শোষণ-নিপীড়ন থেকে মুক্ত হয়ে মানুষের বিকাশের সমস্ত বন্ধ রাস্তাগুলি খুলে যাবে। অধিকাংশ মানুষ মনে করেছিলেন, এই কথাগুলি সঠিক, কিন্তু সত্যিই কি দুঃখ-দারিদ্রের অবসান সম্ভব! কিন্তু রাশিয়ায় লেনিনের নেতৃত্বে নভেম্বর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব প্রমাণ করল—এ সম্ভব। এই মাটির পৃথিবীতেই স্বর্গ কায়েম করা যায়। আর তা পারবে একমাত্র শ্রমিক শ্রেণি। ইতিহাসের চালিকাশক্তি হিসাবে এই দায়িত্ব তার কাঁধেই বর্তেছে।

মার্ক্স-এঙ্গেলস বললেন, সমাজতন্ত্র কোনও ব্যক্তিমানুষের শুভ ইচ্ছার ফল নয়। কোনও কল্পনাপ্রসূত চিন্তাও নয়। সমাজবিকাশের নিয়মেই সমাজতন্ত্র অবশ্যম্ভাবী। কারও ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সৃষ্টি নির্ভর করে না। বললেন, আমরা সমাজ বিকাশের ধারাকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে অনুধাবন করতে পারি, তার যথার্থ চরিত্র বুঝে তার বিকাশ ত্বরান্বিত করতে পারি এবং সমাজের বিপ্লবী রূপান্তর ঘটানোর ক্ষেত্রে নিজেদের যোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারি। বিজ্ঞানসম্মত, ইতিহাসসম্মত বিশ্লেষণের মাধ্যমে মার্ক্স দেখালেন, সভ্যতার অগ্রগতির পথে পুঁজিবাদ আজ প্রধান বাধা হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে। ফলে তাকে বিপ্লবের আঘাতে অপসারিত করতে হবে। আর এই বিপ্লবের অপ্রতিরোধ্য শক্তিকে পুঁজিবাদ নিজের অভ্যন্তরেই সৃষ্টি করেছে। এই শক্তিই হল শ্রমিক শ্রেণি।

পুঁজিবাদের শোষণ অত্যাচারের হাত থেকে মানবসভ্যতাকে রক্ষা করে তার অপ্রতিহত বিকাশের দুয়ার খুলে দেওয়ার দায়িত্ব আজ শ্রমিকশ্রেণির কাঁধে বর্তেছে। ইতিহাস নির্ধারিত এই দায়িত্ব শ্রমিক শ্রেণিকে পালন করতেই হবে। মার্ক্স আরও দেখালেন, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মূল সমস্যা হল, এখানে উৎপাদনের চরিত্র সামাজিক, কিন্তু মালিকানা ব্যক্তিগত। এই সমস্যার বিজ্ঞানসম্মত সমাধান হল উৎপাদন যন্তে্রর উপর সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা। মার্ক্স বললেন, শ্রমিকশ্রেণিই হল সেই শক্তি যার নেতৃত্বে অন্য সমস্ত শ্রমজীবী জনগণ সংগঠিত হবে এবং পুঁজিবাদকে ধবংস করে কায়েম করবে সমাজতন্ত্র। কিন্তু শ্রমিক শ্রেণি এ কাজ করতে পারবে না যদি না সঠিক বিপ্লবী দলের নেতৃত্বে সংগঠিত হয়।

মার্ক্স এঙ্গেলস লেনিনের শিক্ষাকে আরও বিকশিত করে ভারতের শ্রমিক শ্রেণির সামনে বিপ্লবের সঠিক রাস্তাকে তুলে ধরেছেন যিনি, সেই মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক শিবদাস ঘোষ দেখালেন, ‘‘শুধু বিপ্লব চাই—এটা কোনও বিপ্লবী চেতনা নয়। তাই শ্রমিক শ্রেণি, সর্বহারার কথা আমি চিন্তা করি এটাও কোনও সর্বহারা শ্রেণিচেতনা নয়। সঠিক বিপ্লবী চেতনা হল, সঠিক সর্বহারা শ্রেণিচেতনা, আর সঠিক সর্বহারা শ্রেণিচেতনা হল সঠিক পার্টিচেতনা—অর্থাৎ আপনারা সঠিক বিপ্লবী পার্টি চিনতে পেরেছেন কি না।’’

আজ ভারতের সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দিকে তাকালে দেখা যাবে—শ্রেণি-বৈষম্য বাড়তে বাড়তে বীভৎস আকার নিয়েছে। একদিকে সীমাহীন দারিদ্র, অন্য দিকে আকাশছোঁয়া বৈভব। ২০২৩ সালের অক্সফ্যাম রিপোর্ট বলছে, মাত্র ৫ শতাংশ নাগরিকের হাতে জমা হয়েছে দেশের মোট সম্পদের ৬০ শতাংশ। আর নিচের তলার ৫০ শতাংশ মানুষের জন্য জুটেছে তার মাত্র ৩ শতাংশ। এই হিসেবই দেখাচ্ছে, ২০২০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ভারতে শতকোটিপতির সংখ্যা ১০২ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬৬। দেশ বেকারে ছেয়ে গেছে। নতুন কলকারখানা তৈরি হচ্ছে না। পুরনোগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ছাঁটাই হচ্ছে হু হু করে। খাদ্যদ্রব্যের দাম আকাশছোঁয়া। শিক্ষা-চিকিৎসার বেসরকারিকরণের ফলে তা দ্রুত সাধারণ মানুষের আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের জীবনে নেমে এসেছে ভয়াবহ আর্থিক সঙ্কট। এই বিপুল বৈষম্য সম্ভব হয়েছে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার কারণেই। রাজ্যে রাজ্যে সরকারি দলের নামের পার্থক্য থাকলেও এই শোষণমূলক ব্যবস্থাটাকে টিকিয়ে রেখে পুঁজিপতি শ্রেণির সেবা করাই ভোটসর্বস্ব সংসদীয় সব দলেরই লক্ষ্য। তাই ভোট দিয়ে সরকার বদলালেও শোষণ ব্যবস্থার বদল হয় না, মানুষের দুরবস্থার পরিবর্তন হয় না। বরং তা ক্রমাগত খারাপের দিকে যাচ্ছে। বামপন্থার নাম নিয়ে বহু বামপন্থী দল রয়েছে যারা মুখে শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থের কথা বলে, বাস্তবে পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থই রক্ষা করে। ভোটসর্বস্ব এই দলগুলিকে চিনে নিয়ে তাদের প্রভাব থেকে শ্রমিকদের সরে আসতে হবে। এটাও লেনিনের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।

আজ এটা অত্যন্ত স্পষ্ট যে, এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটিকে টিকিয়ে রেখে শুধু ভোট দিয়ে সরকার বদলে দেশের ৯৯ ভাগ মানুষের দুরবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়। তা সম্ভব একমাত্র শোষণমূলক এই সমাজকাঠামোকে বদলানোর মধ্য দিয়ে। আর সেই বদলের জন্য প্রয়োজন বিপ্লবী বামপন্থার চর্চা, যা রাশিয়াতে লেনিন করেছিলেন। ভারতেও আজ এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটির পরিবর্তনের জন্য দেশের মানুষকে অবশ্যই লেনিনের দেখানো সেই পথে সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে, যে পথে তিনি রাশিয়াতে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করে শোষণহীন সমাজতন্ত্র কায়েম করেছিলেন। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই এস ইউ সি আই-কমিউনিস্ট লেনিন শতবর্ষের উদযাপনের ডাক দিয়েছে। তাই শ্রমজীবী মানুষ মাত্রেরই অবশ্য কর্তব্য ২১ জানুয়ারি লেনিন শতবার্ষিকীর সমাবেশে শহিদ মিনার ময়দানের সভায় যোগ দেওয়া, ভারতের বর্তমান পরিস্থিতিতে লেনিনের শিক্ষাকে কার্যকর করার মাধ্যমে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার লক্ষ্যে অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া।