চলতি অর্থবর্ষে ১০০ দিনের কর্মসংস্থান প্রকল্পের জন্য কেন্দ্রীয় বাজেটে বরাদ্দ কমেছে গত অর্থবর্ষের থেকে ২৫ শতাংশেরও বেশি। গত অর্থবর্ষে তার আগের অর্থবর্ষের থেকে ৩৪ শতাংশের বেশি কমানো হয়েছিল। একটা সরকার যখন জনকল্যাণমূলক খাতে বরাদ্দ এইভাবে ক্রমাগত কমিয়ে চলে তখন প্রমাণ হয়ে যায় তারা জনস্বার্থ নিয়ে আদৌ ভাবিত নয়। দেশের একটা বড় অংশের মানুষ, যাদের পরিবারে দু’বেলা খাবার জোগাড় করাটাই কঠিন, তাদের কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে সরকার দেখে তা বোঝা যায় এই পরিসংখ্যান থেকে।
সংসদীয় কমিটিতে ১০০ দিনের প্রকল্পে কাজের দিন বাড়িয়ে ১৫০ দিন করার প্রস্তাব করা হয়েছে। অথচ বাস্তবে গড়ে ৫০ দিনের বেশি কাজের সুযোগ পান না দেশের গ্রামীণ এলাকার মানুষ। ২০২৩ সালে প্রতি পরিবারে ১০০ দিনের কাজ পৌঁছতে ২.৬৪ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ করা দরকার ছিল। সেখানে এ বছরে মাত্র ৭৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, এতে সাড়ে সাত কোটি পরিবারে বড়জোর ৩০ দিনের কাজ দেওয়া সম্ভব।
সরকার বরাদ্দ কমাচ্ছে কেন? ১০০ দিনের কাজের চাহিদা কী কমছে? বাস্তবে মোটেও কাজের চাহিদা কমছে না। নানা সংস্থার গবেষণা রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, বেকারি, দারিদ্র বাড়ছে ভারতে। সম্প্রতি প্রকাশিত রাষ্ট্রপুঞ্জের উন্নয়ন সূচকে (২০২১-২২) ভারত রয়েছে ১৩২ নম্বরে। বিশ্বের ১৯১টি দেশের মধ্যে দেশের এই লজ্জাজনক স্থান। উন্নয়ন সূচকের প্রধান মাপকাঠি শিক্ষা এবং মানুষের কোনওরকমে খেয়ে-পরে জীবন যাপন করা। স্বভাবতই এর সাথে একজন মানুষের আয়ের প্রশ্নটি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
প্রধানমন্ত্রীর ‘আচ্ছে দিনে’র ভারত গত ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বাধিক বেকারির দেশে পরিণত হয়েছে। বেকারের সংখ্যা হু হু করে বেড়ে চলেছে। এর জন্য দায়ী পুঁজিবাদী সংকটগ্রস্ত বাজার অর্থনীতি। শিল্পে ভয়ঙ্করতম মন্দা চলছে। কারখানা খোলার বদলে একের পর এক লালবাতি জ্বলছে, হচ্ছে ছাঁটাই। করোনাজনিত লকডাউনে গত দু’বছরে পরিযায়ী শ্রমিকরা কাজ ছেড়ে গ্রামে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন, কাজের নিশ্চয়তা না থাকায় তারা অনেকেই আর ফিরে যাননি। গ্রামে চাষবাস অলাভজনক। মুনাফালোভী পুঁজিবাদী বাজারের কবলে পড়ে ছোট চাষি, এমনকি মধ্যবিত্ত চাষিরাও পরিবার প্রতিপালন করতে হিমসিম খাচ্ছেন। ফড়ে-আড়তদারদের পাল্লায় তাদের জীবন জেরবার। বহু পরিশ্রমে ফলানো ফসলের লাভের গুড় খেয়ে যাচ্ছে তারা। ফলে চাষি পরিবারের বহু যুবক হয় শহরের দিকে দৌড়চ্ছে কোনও একটা কাজের খোঁজে অথবা ১০০ দিনের প্রকল্পে দৈনিক ২২৩ টাকার ভরসায় গ্রামেই কোনওরকমে দিন কাটাচ্ছে। পুকুর বা বাঁধের মাটি কাটা, খেতে-ইটভাটায় কাজ, গাছের চারা পোঁতা ইত্যাদি সামান্য কাজ পাওয়ার আশায় পঞ্চায়েত দপ্তরে কিংবা প্রভাবশালী নেতাদের আশেপাশে চরকি পাক খাচ্ছে। দৈনিক ২২৩ টাকা পেতে অসংখ্য মানুষকে যখন বারবার প্রশাসনিক দপ্তরে দৌঁড়তে হচ্ছে, তার পরও নেতা-মন্ত্রীরা কি দাবি করতে পারেন, ১০০ দিনের কাজে চাহিদা কমছে? তা হলে এই খাতে সরকার বরাদ্দ কমাচ্ছে কেন?
১০০ দিনের প্রকল্পে বরাদ্দ কমানোই শুধু নয়, এই প্রকল্প নিয়ে চলছে সীমাহীন অবহেলা। তার উপর চলছে ব্যাপক দুর্নীতি। বহু মানুষ বছরের শেষে জবকার্ড পাচ্ছেন। ফলে ১০০ দিন দূর অস্ত, ১৫-২০ দিনের হিসেবে কাজ পাচ্ছেন তারা। তাও তার টাকা পাচ্ছেন না অনেকে। এমনকি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে তাদের নামে টাকা এলেও সেই টাকা তুলে নিচ্ছে দালালরা। প্রকৃত জবকার্ডধারী অর্থাৎ ১০০ দিনের কাজ পাওয়ার যোগ্য যারা তাদের বাদ দিয়ে সরকারের কাছের লোক হিসাবে পরিচিতদের কাজ পাইয়ে দেওয়া চলছে। এ ছাড়াও কাজের চাহিদা কম, এই ভুয়ো দাবি করে কাজের দিন কমানো হচ্ছে।
একদিকে কেন্দ্রীয় সরকার দুর্নীতি রোধের অছিলায় পশ্চিমবঙ্গের মতো বিরোধী দল শাসিত রাজগুলিতে ১০০ দিনের কাজের টাকা আটকে রেখেছে। অন্যদিকে এই অজুহাতেই যে সব শর্ত চাপাচ্ছে তাতে জবকার্ডধারীদের হাতে উন্নত স্মার্টফোন ও হাইস্পিড ইন্টারনেট না থাকলে হাজিরা নথিভুক্ত করাই অসম্ভব। ভারতের গ্রামাঞ্চলে এই দুটি শর্ত পূরণ করতে পারেন কত শতাংশ মানুষ? বেশিরভাগই পারেন না। ফলে কাজ পাওয়াটাই অনিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে।
অথচ সরকার যদি সমস্ত কর্মক্ষম মানুষকে কাজ দিতে চাইত, তাহলে এই প্রকল্পে ২২৩ টাকা নয়, ন্যূনতম মজুরির হারে শ্রমিকদের মজুরি দিত। পরিকল্পনামাফিক স্থায়ী পরিকাঠামো ও সম্পদ সৃষ্টির কাজে ১০০ দিনের কাজকে লাগাতে পারলে গ্রামীণ জনগণের স্থায়ী কর্মসংস্থানও হতে পারত। কৃষিমজুরিকে এই প্রকল্পের অর্ন্তভুক্ত করলে কৃষিশ্রমিকের সমস্যারও সমাধান কিছুটা হতে পারত। কিন্তু সরকার তো বেকার সমস্যা সমাধানে আগ্রহী নয়। বেকারত্বের চাপে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা একেবারে যাতে ভেঙে না পড়ে তার জন্য যতটুকু ঠেকা দিয়ে গরিব মানুষকে গ্রামে আটকে রাখা যায় তার বেশি তারা করতে নারাজ। তাই ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পকে শাসক দলগুলো দেখায় তাদের বদান্যতা হিসাবে, মানুষের কাজ পাওয়ার অধিকার হিসাবে নয়। সে জন্যই নানা অজুহাতে এই প্রকল্পে বরাদ্দ ছাঁটাই করে চলে শাসকরা। অথচ বৃহৎ শিল্পপতিদের ট্যাক্স ছাড় দিতে, ঋণ মকুব করতে তাদের আটকায় না। এর থেকে বোঝা যায়, গ্রামীণ দরিদ্র জনসাধারণের প্রতি সরকারের কোনও দায়দায়িত্ব নেই। তাদের যত দায় শিল্পপতিদের প্রতি।