সঙ্ঘবদ্ধ কৃষকদের অনমনীয় দৃঢ়তার সামনে শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকারে বাধ্য হল বিজেপি সরকার। জোড় হাতে ক্ষমা ভিক্ষা করে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করলেন, নয়া কৃষি আইন তুলে নিচ্ছে সরকার। জয়ী হল কৃষকদের টানা এক বছরের ঐতিহাসিক লড়াই।
এ জয় ঐতিহাসিক। ঐতিহাসিক নানা কারণে। কৃষকদের প্রতিপক্ষ হিসাবে ছিল রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন বিজেপির মতো একটি কেন্দ্রীভূত, ফ্যাসিস্ট দল যে গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে দু-পায়ে মাড়িয়ে চলেছে। লাগাতার এক বছর ধরে অনেকগুলি কৃষক সংগঠনকে একত্রিত রেখে আন্দোলনকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া-ও সহজ কাজ ছিল না। তথাকথিত বড় দলগুলির কোনও রকম সাহায্য ছাড়াই জনসাধারণের নিজস্ব শক্তির জন্ম দিয়ে জয় ছিনিয়ে আনা স্বাধীন ভারতের গণআন্দোলনের ইতিহাসে বিরল।
কৃষক আন্দোলনের প্রবল চাপে সরকার পিছু হঠল। কিন্তু এত দেরিতে কেন? আন্দোলনকে কেন্দ্র করে প্রায় সাতশো কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। এর তো কোনও প্রয়োজন ছিল না। এই এক বছর কৃষকরা তাঁদের ঘর-সংসার, পরিবার, জীবিকা, চাষাবাস সব ফেলে রেখে দিল্লির সীমানায় তাঁবুর মধ্যে কাটিয়ে দিয়েছেন। ঝড়বৃষ্টি, প্রবল শীত, গ্রীষ্ম, সরকারের প্রবল চাপ, পুলিশের লাঠি, মিথ্যা মামলা, বিজেপি কর্মী-গুন্ডাবাহিনীর লাগাতার হামলা সহ্য করেছেন।
সরকারের ঘোষণায় কৃষকদের সাথে সারা দেশবাসী উল্লসিত। কিন্তু শুধু কৃষি আইন প্রত্যাহারই তো কৃষকদের দাবি ছিল না। ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়া কৃষকজীবনের দীর্ঘ দিনের সমস্যা। কৃষকদের অন্যতম দাবি ছিল ফসলের নূ্যনতম সরকারি সহায়ক মূল্য ঘোষণা এবং চরম কৃষকস্বার্থবিরোধী তথা জনস্বার্থ বিরোধী বিদ্যুৎ আইন প্রত্যাহারও। যেখানেই কৃষকরা প্রতিবাদে সমবেত হয়েছেন, বিক্ষোভ দেখিয়েছেন সেখানেই পুলিশ তাঁদের নামে মিথ্যা মামলা চাপিয়েছে। সেগুলি প্রত্যাহারের কোনও কথা প্রধানমন্ত্রী বলেননি। এমনকি ঘোষণার সময়ে প্রধানমন্ত্রী মৃত কৃষকদের প্রতি কোনও রকম শ্রদ্ধা জানাননি। তিনি এখনও বলছেন, এই আইনে নাকি কৃষকদের স্বার্থই রক্ষা হত। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এবং তার সরকার নাকি সে-কথা কৃষকদের বোঝাতে পারেননি। অর্থাৎ ঘোষণার মধ্যে কোথাও সরকারের ভুল স্বীকার নেই। বরং কৃষকদের ভুলের কথাই তিনি বলেছেন। এ থেকেই স্পষ্ট সরকার কোনও নীতিগত কারণে এই আইন প্রত্যাহার করছে না। নিছক চাপে পড়েই করছে। অর্থাৎ সুযোগ পেলেই তাঁরা আবার এই আইন নিয়ে আসবেন।
অভিনন্দন এস ইউ সি আই (সি)-র
এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-র সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ ১৯ নভেম্বর এক বিবৃতিতে কৃষি আন্দোলনকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, ফ্যাসিস্ট বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারকে শেষ পর্যন্ত সংগ্রামী কৃষকদের কাছে নতিস্বীকার করতে হল ও তাদের ন্যায্য দাবিগুলি মেনে নিতে হল। ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের এ এক বিরাট জয়। যা আবার প্রমাণ করল নির্ভীক দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মেহনতি মানুষের দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলনই কেবল পুঁজিপতি শ্রেণি ও মাল্টিন্যাশনালদের সেবাদাস শাসক দলগুলির সমস্ত রকম জনবিরোধী ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনাকে পরাস্ত করতে পারে। শোষিত নিপীড়িত সকল জনগণের কাছে এ এক মহৎ শিক্ষা। কৃষক আন্দোলনের সকল শহিদদের প্রতি আমরা লাল সেলাম ও সংগ্রামী কৃষকদের আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। |
ভুল যদি সরকার না-ই করে থাকে তবে আইন পাশের এক বছর পরে কেন তা প্রত্যাহার? কেন প্রধানমন্ত্রীর এমন ক্ষমা প্রার্থনা? গুজরাতে মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন গোধরা গণহত্যার পরে তিনি ক্ষমা চাননি। রাতারাতি নোট বাতিলে কয়েকশো মানুষের মৃত্যু এবং সাধারণ মানুষের জীবনে চরম দুর্গতি দেখেও তিনি ক্ষমা চাননি। প্রথমে এনআরসি এবং পরে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রবল জনমতের সামনেও তিনি ক্ষমা চাননি। রাফালে ভয়ঙ্কর দুর্নীতি কিংবা বেআইনি পেগাসাস কাণ্ডের পরেও তিনি ক্ষমা চাননি। তা হলে এ বার এমন বোধোদয়ের কারণ কী? আসলে বোধোদয়টা কৃষি আইনের ভাল-মন্দ নিয়ে নয়। একদিকে একচেটিয়া পুঁজি মালিকদের সেবাদাস এই পুঁজিবাদী রাষ্ট্রকাঠামোটার আসল চরিত্রটা কৃষকদের চোখে যেভাবে বেআব্রু হয়ে ধরা দিচ্ছে, তা কর্পোরেট প্রভুদের ভাবিয়েছে। ফলে তারা পিছনের দরজা খুঁজতে ব্যগ্র হয়ে উঠেছেন। অন্যদিকে এই প্রভুদের সেবা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী তথা তাঁর দলের সঙ্কট বুঝেই এই বোধোদয়।
একচেটিয়া পুঁজির পূর্ণ মদতে ক্ষমতায় বসা বিজেপি সরকার পুঁজিপতি শ্রেণির মুনাফার জন্য গোটা কৃষিক্ষেত্রটাকে খুলে দিতে চেয়েছিল। তারা ভেবেছিল, আইনের বিরুদ্ধে কৃষকদের প্রতিবাদকে তারা পুলিশ দিয়ে, বিচার ব্যবস্থার একাংশকে কাজে লাগিয়ে, একচেটিয়া পুঁজির মালিকানাধীন সংবাদমাধ্যমের সাহায্যে ক্রমাগত মিথ্যা ও কুৎসা প্রচার করে স্তব্ধ করে দিতে পারবে। যেখানেই কৃষকরা প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন পুলিশ নির্বিচারে তাঁদের নামে মিথ্যা মামলা করেছে, লাঠিপেটা করেছে, জলকামান ব্যবহার করেছে। কৃষকরা যাতে রাজধানীর দিকে এগোতে না পারেন তার জন্য তাঁদের অবস্থানের জায়গার চারদিকে কংক্রিটের ব্যারিকেড তৈরি করে তাতে লোহার ফলা পুঁতে দিয়েছে। তাঁদের জল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, বিদ্যুতের লাইন কেটে দেওয়া হয়েছে। বিজেপি নেতারা লাগাতার আন্দোলনকারীদের দেশদ্রোহী, খালিস্তানি, সন্ত্রাসবাদী বলেছেন, এমনকি আন্দোলনকে পাকিস্তান মদতপুষ্ট বলতেও ছাড়েননি। প্রধানমন্ত্রী নিজে আন্দোলনের নেতাদের বলেছেন, এঁরা কৃষিজীবী নন, আন্দোলনজীবী। সব ব্যঙ্গ বিদ্রুপ কুৎসা কৃষকরা নীরবে সহ্য করেছেন। নিজেদের দাবিতে অনড় থেকেছেন। আর যত দিন গেছে ততই সরকারের মন্ত্রীরা, বিজেপির নেতারা দেখেছেন, আন্দোলন স্তব্ধ হওয়া দূরের কথা, দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে এক রাজ্য থেকে আর এক রাজ্যে, এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রামে। আন্দোলনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন ছাত্র যুব মহিলা শ্রমিক চিকিৎসক বুদ্ধিজীবী সহ সমাজের প্রায় সব অংশের মানুষ। যতই এমনটা ঘটেছে ততই বিজেপির পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেছে। একের পর এক নির্বাচনে ধরাশায়ী হয়েছে বিজেপি। সামনে পাঁচটি রাজ্যের নির্বাচন। কয়েক মাস আগে উত্তরপ্রদেশের পঞ্চায়েত নির্বাচনে গ্রামসভাগুলিতে গোহারা হয়েছে বিজেপি। এবার বিধানসভা নির্বাচনে হারলে ২০২৪-এর লোকসভাও থেকে যাবে অধরা। তাই এই ক্ষমা প্রার্থনার নাটক।
প্রধানমন্ত্রী তথা বিজেপির এই চাল ধরতে পারবে না, এতখানি বেকুব কৃষকরা এবং তাঁদের নেতারা নন। স্বাভাবিক ভাবেই কৃষকরা আন্দোলনে অনড় রয়েছেন। ঘোষণা করেছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না সংসদে আইন পুরোপুরি ফিরিয়ে নেওয়া না হচ্ছে, যতক্ষণ পর্যন্ত অন্য দাবিগুলিও মেনে নেওয়া না হচ্ছে ততক্ষণ তাঁদের আন্দোলন চলবে। লাগাতার আন্দোলনের যে কর্মসূচি তাঁদের রয়েছে তার কোনও নড়চড় হবে না।
এই আন্দোলন থেকে যা শিক্ষণীয় তা হল, গত এক বছর ধরে একটা স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট সরকারের সব রকমের হুমকি, অত্যাচার সত্ত্বেও কৃষকরা তাঁদের দাবিতে, আন্দোলনে অনড় থেকেছেন। যেখানে প্রায়ই দেখা যায় শ্রমিক কৃষক কিংবা সাধারণ মানুষের জীবিকার নানা ক্ষেত্রে গড়ে ওঠা আন্দোলনগুলিতে নেতৃত্বের লজ্জাজনক আপস, মালিকের পায়ে কিংবা সরকারের কাছে জনস্বার্থ বিসর্জন দিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেওয়া, নিজেদের এমএলএ এমপি মন্ত্রী হওয়ার রাস্তাকে মসৃণ করে নেওয়া সেখানে কৃষক নেতারা এ সবের থেকে নিজেদের দৃষ্টান্তমূলক ভাবে রক্ষা করেছেন। কিন্তু কী ভাবে তাঁরা এটা করতে পারলেন?
আসলে কৃষি আইনে কৃষকরা তাঁদের সর্বনাশকে গভীর ভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তাঁরা বুঝেছিলেন, এই আইন চালু হলে তাঁরা সর্বস্বান্ত হবেন। তাঁরা যে কোনও মূল্যে এই আইনকে রুখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দেশের ভোটসর্বস্ব রাজনৈতিক দলগুলির এবং তার নেতাদের চরিত্র তাঁদের চেনা। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকেই তাঁরা বুঝেছিলেন, এই নেতারা কখনওই তাদের জন্য সত্যিকারের লড়াই করবেন না। বরং অন্য সব লড়াইয়ের মতো এ ক্ষেত্রেও তাঁরা কৃষকদের সংগ্রাম, আত্মত্যাগকে পুঁজি করে নির্বাচনী ফয়দা তুলবেন। শুরু থেকেই এই সব ধুরন্ধর, ক্ষমতালোভী, নীতিহীন নেতাদের আন্দোলনের মঞ্চ ব্যবহারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেছিলেন আন্দোলনরত কৃষকরা। তাই কৃষকদের মঞ্চ থেকে কোনও ‘নামকরা’ নেতার গরম গরম বত্তৃতা শোনা যায়নি। এমনকি সরকারি নেতা-মন্ত্রীরাও যাতে নেতাদের প্রভাবিত করতে না পারেন, সে জন্য তাঁরা যখন সরকারের সাথে আলোচনা করতে গেছেন তখনও তাঁরা সরকারের দেওয়া খাবার স্পর্শ করেননি। আন্দোলনকে বিপথগামী করতে সরকার সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমে আইনকে কিছু দিনের জন্য স্থগিত ঘোষণা করে পর্যালোচনার জন্য কমিটি ঘোষণা করেছে। কিন্তু আইনি রাস্তাকে সম্পূর্ণ পরিহার করে কৃষকরা গভীর প্রত্যয়ে ঘোষণা করেছেন, আইন এনেছে সরকার। আলোচনা যা হবে সরকারের সঙ্গে। এখানে বিচারব্যবস্থার ভূমিকা কোথায়!
মনে পড়ে যায় কৃষক আন্দোলনের আর এক গৌরবময় ক্ষেত্র সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের কথা। সেই আন্দোলনেও এমন করেই সাধারণ কৃষকরা পুরুষ-নারী নির্বিশেষ সামিল হয়ে গড়ে তুলেছিলেন আন্দোলনের গণকমিটি। এস ইউ সি আই (সি)-র তৎকালীন রাজ্য সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ আন্দোলনরত কৃষকদের উদ্দেশে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, আপনারা নিজেরা আলোচনা করুন, নিজেরা সিদ্ধান্ত নিন। রাজনৈতিক নেতাদের পরামর্শ শুনবেন কিন্তু সিদ্ধান্ত নেবেন নিজেরা। এই আন্দোলনেও আমরা দেখলাম, কৃষকরা কোনও নামকরা নেতার পিছনে গিয়ে জড়ো হননি। সরকারি কোনও প্রলোভনেও পা দেননি। জয় অর্জনই ছিল তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য। সেই জয় তাঁরা অর্জন করেছেন। অর্জন করেছেন নিজেদের শক্তির জোরে, লক্ষে্যর প্রতি অটলতার জোরে, দাবির প্রতি অনমনীয়তার জোরে। কোনও প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব ছাড়াই। তাঁরা প্রমাণ করেছেন, গণআন্দোলনের শক্তি একটা চরম উদ্ধত সরকারের মাথাও এমন করে নত করে দিতে পারে।
সরকারের চরম ঔদ্ধত্য ও অসংবেদনশীলতা সত্তে্বও এই জয় অর্জিত হতে পারত আরও অনেক আগে। এখন যে রাজনৈতিক দলগুলি এই জয়ের সাফল্য আত্মসাৎ করতে ঢাক-ঢোল নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছে তারা যদি আন্দোলন জোরদার করতে, দেশের প্রান্তে প্রান্তে আন্দোলনের বার্তাকে পৌঁছে দিতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করত। বাস্তবে সংবাদমাধ্যমে প্রচার পাওয়া এই সব দলগুলি কেউই কৃষিআইন প্রত্যাহারের আন্দোলনকে প্রয়োজনীয় গুরুত্ব দেয়নি। কংগ্রেসের কথা বোঝা যায়। তারা এ দেশে বুর্জোয়া স্বার্থের বিশ্বস্ত প্রতিনিধি। কৃষিআইনের মধ্য দিয়ে কৃষিকে একচেটিয়া পুঁজির কুক্ষিগত করার যে প্রচেষ্টা, তার পূর্বসূরি, পথনির্দেশক তারাই। তাই শুকনো কিছু বিবৃতি আর টুইটের বাইরে তারা কিছু করেনি। অন্য আঞ্চলিক দলগুলি সম্বন্ধেও একই কথা খাটে।
কিন্তু বামপন্থী বলে পরিচিত সিপিএম কেন কৃষক স্বার্থে প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করল না? তারা কেরালায় সরকারে আছে, নয় নয় করে অন্তত পশ্চিমবঙ্গে তাদের যতটুকু সমর্থন কৃষকদের মধ্যে এখনও টিকে আছে তাদের সংগঠিত করে কেন তারা পরিপূরক আন্দোলন এই দুটি রাজ্যে অন্তত গড়ে তুললেন না? আসলে কংগ্রেসের মতো তাদেরও উপায় নেই। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ইতিহাস তাদের তাড়া করছে। দেশি-বিদেশি একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থে কৃষকের জমি কেড়ে নিতে তারা গুলি চালিয়ে কৃষকদের হত্যা করেছে, নজিরবিহীন ভাবে মহিলা আন্দোলনকারীদের ধর্ষণ করিয়েছে। যদিও কৃষকদের জয় তারা আটকাতে পারেনি। অন্য দিকে রয়েছে পুঁজিপতি শ্রেণির সঙ্গে তাদের যোজসাজশ। এই যোগসাজশেই তো তারা আজও বুর্জোয়া মিডিয়ায় ভেসে রয়েছে। তাই পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে বলিষ্ঠভাবে কিছু করার ক্ষমতা তাদের নেই। এ রাজ্যের মানুষ তাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছেন, কৃষক মোর্চার দেওয়া কর্মসূচিগুলিকে তারা প্রয়োজনীয় গুরুত্ব দেয়নি। ২৭ সেপ্টেম্বরের ভারত বনধ তার জ্বলন্ত উদাহরণ। এস ইউ সি আই (সি) তার সর্বশক্তি নিয়োগ করে যখন বনধ সফল করার জন্য নেমেছিল, তখন তারা কাগুজে বিবৃতি দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে। তারা যে আপসহীন লড়াইয়ে গুরুত্ব দেয়নি তার অকাট্য প্রমাণ– তাদের দলের সাধারণ সম্পাদকের একটি প্রস্তাব। তিনি গত ৩১ ডিসেম্বর দ্য হিন্দু পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কৃষক আন্দোলনের ফয়সালা করতে কৃষক নেতারা সরকার এবং দেশের একচেটিয়া পুঁজিপতিদের সাথে বৈঠকে বসুক। স্বাভাবিক ভাবেই আন্দোলনের ময়দান থেকে প্রশ্ন উঠেছে, বৈঠকে পুঁজিপতিদের রাখার এমন প্রস্তাব কেন? বুঝতে অসুবিধা হয়নি, অন্দোলনে নাম কা ওয়াস্তে থেকে আসলে তারা কার প্রতিনিধিত্ব করছে।
এ রাজ্যে তৃণমূল সরকারের চরিত্রটিও এই কৃষক আন্দোলন বেআব্রু করে দিয়েছে। তাদের নেত্রী মুখে কৃষি আইনের বিরোধিতা করছি বললেও বাস্তবে আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে তাঁর দল বা সরকার কিছু করেনি শুধু নয়, বাধা দিয়েছে। কৃষক মোর্চা যতগুলি সর্বভারতীয় ধর্মঘট ডেকেছে এ রাজ্যে সবগুলির বিরোধিতা করেছে তৃণমূল সরকার। এমনকি কর্মসূচি সফল করতে গিয়ে তৃণমূল সরকারের পুলিশ এস ইউ সি আই (সি) কর্মীদের গ্রেফতার করে জেলে ভরেছে।
এই আন্দোলন আরও একটি শিক্ষা মানুষের সামনে রেখে গেল। এতদিন নাগরিক সমাজ বলতে বোঝাত সমাজের শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী অংশকে। এনআরসি বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে কৃষক আন্দোলন দেখাল সমাজের কোনও নির্দিষ্ট অংশ নয়, লড়াকু জনতাই নাগরিক সমাজ। শোষিত নিপীড়িত জনতা চেতনার ভিত্তিতে দাঁড়ালে তারা নিজেরাই পারে আন্দোলন গড়ে তুলতে, নেতৃত্ব দিতে, জয় ছিনিয়ে আনতে।
গোটা দেশ জুড়ে সাধারণ মানুষের জীবনের পরিস্থিতি যে ভয়ঙ্কর আকার নিয়েছে তাতে বহু মূল্যে অর্জিত এই ঐতিহাসিক জয়ের গুরুত্ব বিরাট। মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সাধারণ মানুষের দুর্দশা। ধনী-দরিদ্রে বৈষম্য আকাশ ছুঁয়েছে। সরকারি ভাণ্ডারে খাদ্য উপচে পড়লেও ক্ষুধা এবং অপুষ্টি দেশে গুরুতর আকার নিয়েছে। চিকিৎসা অধিকাংশ মানুষের কাছেই অধরা। একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থে সরকার বেপরোয়া বেসরকারিকরণ এবং শ্রম আইনের বদল কোটি কোটি শ্রমিক কর্মচারীর জীবনকে অনিশ্চিত অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিয়েছে। বিরাট অংশের মানুষ যখন আজ হতাশার আচ্ছন্ন, তখন এই জয় তাদের নতুন জীবনীশক্তিতে উজ্জীবিত করে তুলবে। মালিক শ্রেণির হিংস্র আক্রমণের সামনে দাঁড়িয়ে দেশের কোটি কোটি শ্রমিক যখন আত্মসমর্পণই ভবিতব্য বলে ভাবতে শুরু করেছিলেন তখন এই জয় তাদের সামনে আলোকবর্তিকার কাজ করছে। তাঁরা নতুন উজ্জীবিত শক্তিতে ভাবছেন, পথ আছে। আন্দোলনই সেই পথ।