আরও একটি প্রজাতন্ত্র দিবস পার হয়ে গেল। মহা সমারোহে কুচকাওয়াজ হল। ভারতীয় অস্ত্রভাণ্ডারের প্রদর্শনীও হল। শত শত টিভি ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী দিল্লিতে পতাকা তুললেন, বত্তৃতা দিলেন। প্রতিবারের মতো একই রকম ভাবে প্রজাতন্ত্রের মহিমা বর্ণনা করলেন। সামনের সারি আলো করে বসে থাকলেন দেশের প্রথম সারির শিল্পপতি, বড় বড় ব্যবসায়ী, আমলা, মিলিটারি অফিসাররা আর তাঁদের চকচকে পোশাক পরিহিত পরিজনরা। এ যেন রাজবাড়ির উৎসব। প্রজাদের যোগদান নিষিদ্ধ। থাকলেও অনুষ্ঠানের বাইরে। আস্তাকুঁড়ে উচ্ছিষ্ট কুড়োনোর জন্য।
প্রধানমন্ত্রী যখন লালকেল্লার মঞ্চে দাঁড়িয়ে গলা কাঁপিয়ে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের মহিমা কীর্তন করছেন তখন খোদ দিল্লি সহ দেশের নানা প্রান্তে ধর্নায় বসেছেন লাখ লাখ মানুষ। প্রবল শীতে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাচ্ছেন তাঁরা। মায়েরাও রয়েছেন হাজারে হাজারে। তাঁদের কোলে রয়েছে শিশুরা, কেউ কেউ বসেছেন সদ্যোজাতকে নিয়ে। তাঁদের দাবি, ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্বের সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী কিংবা অন্য কোনও মন্ত্রী কিন্তু একবারের জন্যও এই মানুষগুলির কাছে যাননি। জানতে চাননি তাঁদের মনের কথা। বলেননি, আসুন আমরা আলোচনায় বসি। উল্টে তাঁরা আন্দোলনকারীদের ‘পাকিস্তানি’ বলে দেগে দিচ্ছেন। আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে কোথাও পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছেন। প্রবল ঠাণ্ডার মধ্যে আন্দোলনকারীদের থেকে কম্বল এবং খাবার কেড়ে নিয়ে গেছে পুলিশ। বিরোধী বক্তব্য শোনা তো প্রজাতন্ত্রের ন্যূনতম শর্ত! কোথায় সেই গণতন্ত্র!
সিএএ-র মতো একটা মারাত্মক আইন নিয়ে এলেন বিজেপি নেতারা। অথচ তার আগে কোথাও কারও সাথে কোনও আলোচনাই করলেন না। দেশে কোথাও কোনও বিতর্ক হল না। বিজেপি নেতারা ভাবলেন, আর আইন করে দিলেন! কোথায় গণতন্ত্র? এ তো স্বৈরতন্ত্র। আগে যেমন রাজা যা মনে করতেন তা-ই হত আইন, এ তো ঠিক তাই। এর মধ্যে কোথায় প্রজাতন্ত্র? কোথায় জনগণের ভালমন্দ, কোথায় তাদের মতামতের মূল্য? বরং জনমতকে চরম ঔদ্ধত্যে উড়িয়ে দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ঘোষণা করেছেন, ‘‘যাঁর যত বিরোধিতা করার করুন, সিএএ প্রত্যাহার করা হবে না।” অর্থাৎ দেশের জনগণ যা-ই দাবি করুক, শাসক হিসাবে অমিত শাহ-নরেন্দ্র মোদিরা তার কোনও মূল্য দেবেন না। এই হল তাঁদের মনোভাব। গণতান্ত্রিক রাষ্টে্র নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধানদের মুখে এর থেকে অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী ভাষা আর কী হতে পারে? অথচ তাঁরা ঘটা করে প্রতি বছর পতাকা তুলছেন, ভুরি ভুরি বত্তৃতা দিয়ে প্রজাতন্ত্র দিবস পালন করছেন। প্রজাতন্ত্রের নামে এর থেকে বড় প্রহসন আর কী হতে পারে!
এবার প্রজাতন্ত্র দিবসে প্রধান অতিথি হিসাবে বিজেপি সরকার নিয়ে এসেছিল ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বোলসোনারোকে। কে এই বোলসোনারো? ইনি হলেন ব্রাজিলের সেই নেতা যিনি সে দেশের কর্পোরেট পুঁজিপতিদের টাকার থলি আর প্রচারের জোরে গদির দখল নিয়েছেন। আর গদিতে বসেই তাঁর প্রভু কর্পোরেট পুঁজিপতিদের মুনাফার স্বার্থ রক্ষা করতে একের পর এক জনস্বার্থবিরোধী নীতি নিয়ে চলেছেন। এই বোলসোনারো নির্বাচনী প্রচারে প্রকাশ্যে নারীবিদ্বেষ প্রচার করেছেন। কার্যত ধর্ষণকে বৈধতা দিয়েছেন। তাঁকেই পছন্দ করে নিয়ে এসেছেন মোদি-শাহরা। কোথায় গেল প্রধানমন্ত্রীর নারীর সম্মান রক্ষা আর ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’য়ের স্লোগান আসলে মোদি-শাহরা যেমন এখানে কর্পোরেট স্বার্থে কাজ করে চলেছেন বোলসোনারোও ঠিক তাই। মোদি-শাহরা এবারের প্রজাতন্ত্র দিবসে সঠিক অতিথিই পছন্দ করেছেন! এ জন্য দেশি-বিদেশি কর্পোরেট পুঁজির আশীর্বাদ ঝরে পড়বে তাঁদের উপর!
বিজেপি রাজত্বে কোথায় রয়েছে নাগরিক অধিকার? কাশ্মীরের কথাই ধরা যাক। গত ছ’মাস ধরে গোটা কাশ্মীরে নাগরিকদের সমস্ত গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিয়ে গোটা রাজ্যটাকে কার্যত একটা জেলখানা করে রাখা হয়েছে। অথচ ৩৭০ ধারা বিলোপের সময়ে বিজেপি নেতা-মন্ত্রীরা কী দাবি করেছিলেন? বলেছিলেন, এক দেশে এক আইন কায়েম করতেই তাঁরা এই বিলোপ ঘটাচ্ছেন। পেরেছে নাকি বিজেপি সরকার কাশ্মীরি জনগণকে নাগরিকের যথার্থ মর্যাদা দিতে? বাস্তবে বিদ্বেষ আর দমন নীতি প্রয়োগ করতে গিয়ে বিজেপি নেতারা কাশ্মীরকে মানসিক ভাবে ভারতের থেকে আরও অনেক দূরে ঠেলে দিয়েছেন।
সিএএ-র মতো চরম সাম্প্রদায়িক ও বিভেদকামী আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-আন্দোলন দমন করতে উত্তরপ্রদেশ জুড়ে যোগী সরকার বাস্তবে ফ্যাসিস্টরাজ কায়েম করেছে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে গুলি চালিয়ে পুলিশ সেখানে ১৯ জন নাগরিককে হত্যা করেছে। জামিয়া মিলিয়া ও আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢুকে পুলিশ যেভাবে ছাত্র এবং শিক্ষকদের উপর অত্যাচার চালিয়েছে, জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদী ছাত্র-শিক্ষকদের উপর এবিভিপি গুন্ডাবাহিনী যে ভাবে পুলিশের উপস্থিতিতে হামলা চালিয়েছে, তা কি কোনও গণতান্ত্রিক রাষ্টে্র চলতে পারে? ইন্টারনেট বন্ধ করে, ১৪৪ ধারা জারি করে, পুলিশি সন্ত্রাস চালিয়ে যে ভাবে তারা মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার, আন্দোলনের অধিকার, প্রতিবাদের অধিকারকে স্তব্ধ করতে চাইছে তার নাম কি গণতন্ত্র? কিন্তু তবুও পারছেন না তাঁরা। আন্দোলন ছড়িয়ে যাচ্ছে দেশজুড়ে।
প্রবল জনমতের চাপে রাজ্যে রাজ্যে সরকারগুলি বাধ্য হচ্ছে এই আইনের বিরুদ্ধে বিধানসভায় প্রস্তাব নিতে। ভোটবাজ দলগুলির নেতৃত্বের তোয়াক্কা না করে দেশের সর্বত্র কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলি থেকে বেরিয়ে এসে ছাত্ররা যোগ দিচ্ছে আন্দোলনে। শাসকদের ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে সম্প্রীতির এক নতুন নজির তৈরি করে গড়ে উঠছে শত শত শাহিনবাগ। সর্বত্র আওয়াজ উঠছে, ‘কাগজ আমরা দেখাব না’। সমাজের বিশিষ্ট মানুষ, যাঁরা সাধারণত নিজেদের পেশা বা কাজ নিয়েই থাকেন, সেই কবি সাহিত্যিক বিজ্ঞানী চিকিৎসক ইতিহাসবিদ সাংবাদিক অভিনেতা নাট্যকর্মী বুদ্ধিজীবীরা বিজেপির ঘৃণা, বিদ্বেষ, বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন। এমনকি বিশ্বের দেশে দেশে প্রবাসী ভারতীয়রা বিজেপির এই ভেদনীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। তেমনই বিশ্বের চিন্তাশীল মানুষেরাও বিজেপির কার্যকলাপে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনির কথা বলছেন।
জনসমাজের বিরাট অংশ যখন আজ এভাবে ধর্মীয় বিভেদমূলক এনআরসি-সিএএর বিরুদ্ধে এমন করে সোচ্চার তখন দেশের মানুষের উপর আইনগুলিকে তারা এভাবে চাপিয়ে দিচ্ছেন কীসের জোরে? আসলে এ কাজটি তাঁরা করছেন তাঁদের পিছনে দেশের শিল্পপতি-পুঁজিপতিদের সমর্থনের জোরে। এই যে এনআরসি-সিএএর বিরুদ্ধে দেশজুড়ে এত তোলপাড় চলছে, কোনও শিল্পপতি-পুঁজিপতি, তাদের চেম্বারগুলো কেউ এ নিয়ে মুখ খুলছে? না, একজনও না। কারণ এতে তাদের স্বার্থে কোনও ঘা লাগছে না। বরং শোষিত মানুষ যত ধর্মে-বর্ণে বিভক্ত থাকবে, পরস্পর হানাহানি করবে ততই তাদের শোষণের স্টিমরোলার তারা নিশ্চিন্তে চালিয়ে নিয়ে যাবে। যে মন্দা নিয়ে, অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এত বিক্ষোভ, অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা এত উদ্বেগ প্রকাশ করছেন, তার জন্য কোনও শিল্পপতি কোনও পুঁজিপতি কি বিজেপিকে কাঠগড়ায় তুলছে? না, তাঁরা এ নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করছে না। কেন করছে না? কারণ এর মধ্যেও পুঁজিপতিদের যথেচ্ছ মুনাফা লুটতে কোনও অসুবিধা হচ্ছে না।
অর্থনীতিতে যত মন্দাই আসুক, বেঁচে থাকার জন্য শ্রমিক, কৃষক, সাধারণ মানুষ তো উদয়াস্ত পরিশ্রম করছে। সেই পরিশ্রমের ফসলটা কে ভোগ করছে? ভোগ করছে দেশের এই শিল্পপতি-পুঁজিপতি-ধনকুবেররা। কারণ মানুষের পরিশ্রমের ফসলটা শেষ পর্যন্ত পুঁজিপতিদের ভাণ্ডারে গিয়েই জমা হচ্ছে। সর্বশেষ এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ভারতে ৯৫.৩ কোটি নাগরিকের মোট সম্পত্তির ৪ গুণেরও বেশি সম্পত্তি রয়েছে মাত্র ৬৩ জন ধনকুবেরে হাতে। কুৎসিত এই বৈষম্য তো ভারতীয় প্রজাতন্তে্ররই ফসল! যথার্থ প্রজার শাসন হলে কি এটা ঘটতে পারত? মন্দায় যখন মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে, ছাঁটাই শ্রমিকরা সপরিবারে প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছে, কর্মহীন যুবকদের দীর্ঘশ্বাসে দেশের বাতাস ভারি হয়ে উঠছে, পুঁজিপতিদের মুনাফা কিন্তু ঠিক লাফিয়ে বেড়ে যাচ্ছে। প্রতি বছর শত-কোটি পুঁজির মালিকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সরকার নির্লজ্জ ভাবে নানা অজুহাতে এই ধনকুবেরদেরই রাজকোষ থেকে লক্ষ কোটি টাকার করছাড় দিচ্ছে, হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাঙ্কঋণ মকুব করে দিচ্ছে। স্বাভাবিক ভাবেই তাদের আশীর্বাদ বিজেপি নেতাদের উপর অনর্গল ঝরে পড়ছে। কারণ বিজেপি রাজত্বে দেশে তেমন কোনও শ্রমিক আন্দোলন নেই, শক্তিশালী প্রতিরোধ নেই। মালিকরা সরকারকে দিয়ে যা খুশি আইন করিয়ে নিচ্ছে। শ্রমিকদের তারা যা খুশি মাইনে দিচ্ছে, যতক্ষণ খুশি খাটাচ্ছে, যখন খুশি ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে। লাখে লাখে চাষিরা আত্মহত্যা করছে, অথচ কৃষি-পণ্যের একচেটিয়া ব্যবসায়ীরা মুনাফায় লাল হয়ে যাচ্ছে। মন্দার কোনও আঁচই তাদের গায়ে লাগছে না। তাই এত উত্তাল সময়েও শিল্পপতি-পুঁজিপতিরা চুপ করে আছে।
সিএএ-এনআরসি বিরুদ্ধে লড়াই আজ গণতন্ত্র রক্ষার, মানুষের নাগরিক অধিকার রক্ষার, সাম্প্রদায়িক বিভেদের বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদী কার্যকলাপের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করার লড়াই। আবার যেহেতু পুঁজিপতি শ্রেণির সমর্থনপুষ্ট হয়েই বিজেপি এই সব নীতি দেশের মানুষের উপর চাপিয়ে দিতে চাইছে তাই এই লড়াইকে একই সাথে পুঁজিপতি শ্রেণির বিরুদ্ধেও পরিচালিত করতে হবে। তথাকথিত ভোটবাজ কোনও দল আজ এই লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে পারে না। পারে একমাত্র সঠিক বিপ্লবী দল, যে দল জনগণের এই দাবিগুলির প্রতি সত্যিই দায়বদ্ধ। পারে সেই দলের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ সচেতন জনগণ। এর জন্য প্রয়োজন সর্বত্র অসংখ্য জনগণের কমিটি গড়ে তুলে জনগণের রাজনৈতিক শক্তির জন্ম দেওয়া।