গত অর্থবর্ষে স্বাস্থ্যখাতে জিডিপির যত শতাংশ অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছিল, সেই নিরিখে এ বছর কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য বাজেটে তা আরও কমানো হয়েছে। অথচ সরকার নিজেই বলছে এবার দেশের জিডিপি বৃদ্ধির হার ৬ থেকে ৬.৮ শতাংশ এবং বতর্মানে ভারত জিডিপির নিরিখে বিশ্বে পঞ্চম স্থানে রয়েছে। সামগ্রিক বাজেটের নিরিখে ধরলে গত বছর যেখানে সমগ্র বাজেট ছিল ৪১.৯ লক্ষ কোটি টাকা, সেখানে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ছিল ৮৬,২০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ স্বাস্থ্য বাজেট ছিল মূল বাজেটের ২.০৫ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে কেন্দ্রীয় সরকারের সমগ্র বাজেট হল ৪৫.০৩ লক্ষ কোটি টাকা এবং স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে ৮৮,৯৫৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ স্বাস্থ্য বাজেট মোট বাজেটের ১.৯৭ শতাংশ, যা জিডিপির হিসেবে অতি নগণ্য অংশ। যেখানে বর্তমানে ব্রিটেন, অস্টে্রলিয়া ইত্যাদি দেশে জিডিপি-র ৯ শতাংশ, জাপান, ফ্রান্সের মতো দেশে ১০ শতাংশ, এমনকি আমেরিকার মতো দেশে ১৬ শতাংশ বরাদ্দ রয়েছে স্বাস্থ্যখাতে। শুধু অঙ্কের হিসাবে দেখলেও এই বাজেটের সামগ্রিক পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে যৎসামান্য। ঢাক ঢোল পিটিয়ে দেখানো হচ্ছে, গতবারের তুলনায় ১২.৬ শতাংশ বেশি। অথচ এই সময়ে টাকার যা অবমূল্যায়ন হয়েছে এবং জনসংখ্যা যা বেড়েছে তা অঙ্কের নিয়মে ধরলেও এ বছরের বাজেটে গতবারের চেয়েও ৬ শতাংশ কম বরাদ্দ করা হয়েছে। যেখানে এ বছর মিলিটারি বাজেট বাড়ানো হয়েছে ১.৬২ লক্ষ কোটি টাকা, যা সমগ্র স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের জন্য ব্যয় বরাদ্দের দ্বিগুণ।
উপরন্তু বরাদ্দকৃত বাজেটের একটা বিপুল অংশ রয়েছে যা প্রত্যক্ষভাবে স্বাস্থ্য পরিষেবার সাথে সম্পর্কিত নয়। শিক্ষা, জল, স্যানিটেশন, গবেষণা, ফার্মা ইনোভেশন ইত্যাদি বিষয়গুলিতেই বাজেটের সিংহভাগ বরাদ্দ করা হয়েছে। ১৫৭টি নার্সিং কলেজ এবং মাল্টি ডিসিপ্লিনারি ট্রেনিং সেন্টার তৈরির কাজে একটি বিরাট অংশ খরচ হবে। ফলে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের বুনিয়াদি পরিষেবাগুলির জন্য অল্পই অবশিষ্ট থাকবে। অর্থাৎ প্রাথমিক, মধ্যম ও টার্সিয়ারি পরিষেবাগুলি ভীষণভাবে মার খাবে। মার খাবে প্রতিরোধমূলক কর্মসূচিগুলি। বর্তমানে যেখানে অসংক্রামক রোগ ভীষণভাবে বাড়ছে এবং মোট মৃত্যুর প্রায় ৭০ শতাংশই ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হার্টের রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, সেরিব্রাল স্টে্রাক ইত্যাদি রোগের ফলে ঘটে থাকে, সেখানে এই সব রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক খাতে বরাদ্দ কমালে কী ভয়ঙ্কর অবস্থা সৃষ্টি হবে তা সহজেই অনুমেয়। অন্য দিকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এইমস মানের যে প্রতিষ্ঠানগুলি গড়ে তোলা হচ্ছিল সেই খাতে বরাদ্দ ৯৪১১ কোটি থেকে কমিয়ে করা হয়েছে ৩৩৬৫ কোটি। অর্থাৎ কমানো হয়েছে ৬৪ শতাংশ। ফলে এই প্রতিষ্ঠানগুলির ভবিষ্যৎ বিশ বাঁও জলে। অথচ এগুলি থেকে সাধারণ মানুষ উন্নতমানের চিকিৎসা পেতে পারতেন। করোনার মতো মারণ রোগ প্রতিরোধের জন্য গত বছর ব্লক স্তরে পাবলিক হেলথ ল্যাবরেটরি গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়েছিল। এ বছর সেই খাতেও ৫ শতাংশ বরাদ্দ কমানো হয়েছে। ন্যাশনাল হেলথ মিশনের যেসব কর্মসূচিগুলি চলছে, কমানো হয়েছে তার বরাদ্দও। কিউরেটিভ কেয়ার সম্পর্কে বাজেটে বিশেষ কিছু বলাই হয়নি।
অর্থাৎ প্রকৃত অর্থে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে মানুষের জীবন-মরণের সাথে সম্পর্কযুক্ত দৈনন্দিন প্রক্রিয়ায় যতটুকু খরচ আগে করা হত, এ বছর সেইসব খাতের বরাদ্দ ভীষণভাবে কমানো হয়েছে। যতটুকু বরাদ্দ হয়েছে তা কার্যত বিমানির্ভর স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মাধ্যমে বিমা কোম্পানিগুলির পকেট ভরানোর জন্যই। স্বাস্থে্যর মৌলিক কাঠামো এবং জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচিতে জোর না দিয়ে কার্যত সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে পঙ্গু করার চেষ্টা হয়েছে। এর ফলে জনসাধারণের চিকিৎসা খরচ বাড়বে। বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুমিছিল লম্বা হবে। পকেট ভরবে বিমা কোম্পানির এবং কর্পোরেট স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীদের।