গত দেড় বছরের করোনাবিধ্বস্ত ভারতে যথেষ্ট সংখ্যক হাসপাতাল নেই, হাসপাতালে বেড নেই, উপযুক্ত পরিকাঠামো নেই, প্রয়োজনীয় সুলভ চিকিৎসা পরিষেবা নেই, পর্যাপ্ত ডাক্তার-নার্স নেই, জীবনদায়ী ওষুধ-ইঞ্জেকশন নেই, রোগ প্রতিরোধের যথেষ্ট সংখ্যক টিকা নেই, এমনকি ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীসহ কোভিড যোদ্ধাদের জীবনেরও ন্যূনতম সুরক্ষা নেই। এ তো গেল ভয়াবহ অতিমারির প্রকোপে চামড়া উঠে দগদগে ঘায়ের মতো বেরিয়ে পড়া বেহাল স্বাস্থ্যব্যবস্থার কথা। অর্থনীতি? কর্মসংস্থান? দারিদ্র? বেকারত্ব? সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে, সেখানেও নেই, নেই আর নেই।
সম্প্রতি প্রকাশিত রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্টে দেখা গেছে, ‘সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল’ বা স্থায়ী উন্নতির সূচকে আগের থেকেও কয়েক ধাপ নেমে গেছে বিজেপিশাসিত ভারত। বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কার স্থান ভারতের আগে। দারিদ্র দূরীকরণ, সুস্বাস্থ্য, সকলের জন্য খাদ্যসুরক্ষা, উন্নত মানের শিক্ষা, লিঙ্গবৈষম্য রোধের মতো আরও কিছু বিষয়ের ভিত্তিতে করা এই সমীক্ষায় উঠে এসেছে এ দেশে শিশুস্বাস্থ্যের ভয়াবহ ছবি। রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত দেশের শুধুমাত্র ছ’মাস থেকে ছ’বছরের শিশুদের মধ্যেই ন লক্ষ সাতাশ হাজার শিশু ভয়ানক অপুষ্টির শিকার। এই তালিকার একেবারে প্রথমে আছে বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশ এবং তাদের জোট শাসিত বিহার। শুধু এ দুটি রাজ্যেই এই অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা সাড়ে ছ’লক্ষের বেশি। কাছাকাছিই আছে বিজেপি শাসিত মধ্যপ্রদেশ এবং লাদাখ-লাক্ষাদ্বীপের মতো কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। খোদ কেন্দ্রীয় সরকারের নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রক এ তথ্যকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছে।
মার্কিন গবেষণা সংস্থা পিউ রিসার্চ সেন্টারের সমীক্ষা জানাচ্ছে, অতিমারির শুরু থেকে ৭.৫ কোটি মানুষ নেমে গেছেন দারিদ্রসীমার নিচে, যাদের দৈনিক রোজগার ১৫০ টাকারও কম। এবং এই সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। আজিম প্রেমজি ইউনিভার্সিটির তথ্য অনুযায়ী, অতিমারির ধাক্কায় দেশের ২৩ কোটি মানুষের রোজগার নেমে গেছে ৩৭৫ টাকারও নিচে, যা ন্যূনতম মজুরি হিসাবে স্বীকৃত। অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মী, পরিযায়ী শ্রমিকরা ক্রমশ ডুবে যাচ্ছেন ভয়াবহ অনিচয়তার অন্ধকারে। সমীক্ষায় দিনের আলোর মতো উঠে আসছে আর একটা বিষয়। এই অভাব-অনটন-মৃত্যুর বিপরীতে যে আরেকটা ভারতবর্ষ, সেখানে এতটুকু কমছে না প্রাচুর্যের রোশনাই। সাধারণ মানুষের ভয়াবহ জীবনযন্ত্রণার সাথেই পাল্লা দিয়ে দেশে বাড়ছে বিলিয়নেয়ার বা বহুকোটিপতির সংখ্যা। করোনার প্রথম ধাক্কায় গত বছরের হঠাৎ ঘোষিত লকডাউনের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। গোটা ভারত জুড়ে শ্রমজীবী মানুষের মর্মান্তিক অসহায়তা, একের পর এক গা-শিউরে ওঠার মতো ছবি। কোটি কোটি মানুষ রাতারাতি কাজ হারিয়ে পথে বসছেন, হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিক দিশেহারা হয়ে হাঁটছেন মাইলের পর মাইল। কেউ অনাহারে-অর্ধাহারে-পথশ্রমে অসুস্থ হয়ে, কেউ ট্রাকের তলায়, মালগাড়ির চাকায় পিষে মারা যাচ্ছেন। বারো বছরের মেয়ে জামলো মকদম অসুস্থ শরীরে পথেই ঢলে পড়ছে মৃত্যুর কোলে, পরিযায়ী শ্রমিক শকুন্তলা পথেই সন্তানের জন্ম দিয়ে আবার সেই সন্তানকে বুকে চেপে রক্তাক্ত শরীরে পথ হাঁটছেন। ঠিক এরকম একটা সময় ফোর্বস ম্যাগাজিনে বিশ্বের ধনীদের তালিকায় তিন নম্বরে উঠে আসছে ভারতবর্ষ। দেশের বিলিয়নেয়ার বা শতকোটিপতির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ১৭৭, যার একেবারে প্রথমে রয়েছেন রিলায়েন্স কর্তা মুকেশ আম্বানি। ছ’লক্ষ তেত্রিশ হাজার সাতশো পঞ্চাশ কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক আম্বানি এখন এশিয়ার ধনীতম ব্যক্তি এবং গত মার্চ থেকে অক্টোবরের মধ্যে তার সম্পত্তি বেড়েছে ১০০ শতাংশ। ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের তথ্য বলছে, মুকেশ আম্বানির ভাণ্ডারে এইটুকু সময়ে যা যোগ হল, তা দিয়ে অতিমারি বিধ্বস্ত ভারতের চল্লিশ কোটি অসংগঠিত শ্রমিকের অন্তত পাঁচ মাসের দারিদ্র দূর করা যেত। ভারতবর্ষের দ্বিতীয় ধনী ব্যক্তি আদানি গ্রুপের চেয়ারম্যান গৌতম আদানি তিন লক্ষ আটাত্তর হাজার সাতশ পঞ্চাশ কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক হয়ে বিশ্বের ধনীদের তালিকায় ২৪ নম্বর স্থান অধিকার করেছেন।
মহামারির দাপটে লক্ষ মানুষের অসহায় মৃত্যুর পরেও কোভিডের টিকা পেতে সাধারণ মানুষের প্রাণ জেরবার। টিকা নিয়ে নেতামন্ত্রীরা প্রতিদিনই নিত্যনতুন মনগড়া নিয়মের গল্প ফাঁদছেন, জনসাধারণের স্বাস্থ্যের সমস্ত দায়ভার ঝেড়ে ফেলে টিকার কথা উঠলেই প্রধানমন্ত্রী এবং তার পারিষদেরা রাজ্যগুলোর ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছেন এবং সুপ্রিম কোর্টের চাপে ক’দিন আগে বিনামূল্যে টিকা ঘোষণার (সে ঘোষণা বাস্তবে কতটা কার্যকরী হয় দেখার) আগে পর্যন্ত বেসরকারি সংস্থাগুলোকে টিকা দেওয়ার নামে সাধারণ মানুষকে যথেচ্ছ লোটার লাইসেন্স দিয়ে রেখেছিলেন। অথচ কোভিশিল্ডের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সিরাম ইনস্টিটিউটের মালিক আদার পুনাওয়ালার সম্পত্তির খতিয়ান দেখুন। দেশের মানুষ যখন সাধ্যের বাইরে গিয়ে টাকা খরচ করেও ঠিকমতো ভ্যাকসিন পাচ্ছেন না, প্রথম ডোজ নেওয়ার পর দ্বিতীয় ডোজ পেতে কালঘাম ছুটে যাচ্ছে, বৃদ্ধ-অসুস্থরাও ভ্যাকসিনের জন্য লম্বা লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছেন, তখন পৃথিবীর বৃহত্তম ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক সংস্থার কর্ণধার পুনাওয়ালার সম্পত্তির অঙ্ক দাঁড়িয়েছে পঁচানববই হাজার দুশো পঞ্চাশ লক্ষ কোটি এবং ধনকুবেরদের তালিকায় তিনি রয়েছেন সাত নম্বরে। গত বছরের অতিমারিতে যখন বারো কোটি সাধারণ ভারতবাসী রুজিরুটির সংস্থান হারিয়ে সপরিবারে পথে বসছেন তখনই চল্লিশ জন ভারতীয় নতুন করে ঢুকে পড়ছেন বিশ্বের সবচেয়ে ধনবান ব্যক্তিদের তালিকায়। অ’ফ্যামের একটি রিপোর্ট বলছে, লকডাউনের সময় এই ধনকুবেরদের সম্পত্তি বেড়েছে পঁয়ত্রিশ শতাংশ। এদের মধ্যে প্রথম একশো জনের ভাণ্ডারে শুধু গত বছরের মার্চ থেকে যোগ হয়েছে ১২ লক্ষ ৯৭ হাজার ৮২২ কোটির সম্পদ, যা দিয়ে ১৩ কোটি ৮০ লক্ষ দরিদ্রতম ভারতবাসীর প্রত্যেকের হাতে পৌঁছে দেওয়া যায় প্রায় এক লক্ষ টাকার চেক।
অর্থাৎ মূল কথাটা জলের মতো পরিষ্কার। দেশে সম্পদের অভাব নেই। নিরানব্বই শতাংশ জনগণের রক্ত জল করা শ্রমের ফসল জমা হচ্ছে এক শতাংশ পুঁজিপতির ঘরে। দেশের মানুষের শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কর্মসংস্থানের কথা উঠলেই নেতা-মন্ত্রীরা টাকার অভাবের কথা বলেন। অথচ তাঁদের এবং তাঁদের পরম সুহৃদ পুঁজিমালিকদের টাকার পরিমাণ প্রতি বছর আকাশ ছুঁয়ে ফেলে। গত ১৪ মে কিষাণ নিধির অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলে এসেছেন, তিনি দেশের সেবক। দেশের মানুষ যে সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন তা তিনি অনুভব করছেন, তিনিও তাঁদের যন্ত্রণার সহমর্মী। নরেন্দ্র মোদি এবং তার সাকরেদদের এ ধরনের নির্লজ্জ মিথ্যাচার নতুন কিছু নয়। কিন্তু মহামারিতে স্বজন-হারানো মানুষের আর্তনাদে যখন বাতাস ভারি হয়ে আছে, বড় বড় শহরে গণচিতা জ্বলছে, সভ্য দেশে নদীর বুকে লাশ ভাসছে, কোথাও সেই লাশ কুকুরের খাদ্য হচ্ছে– তখন সেই শবের পাহাড়ে বসে কুড়ি হাজার কোটি টাকা খরচ করে সেন্ট্রাল ভিস্তা বানাচ্ছেন দেশের প্রশাসনিক প্রধান। আসলে তিনি কাদের প্রতি দায়বদ্ধ, কাদের সহমর্মী, কাদের সেবায় নিবেদিতপ্রাণ সেটা পরিষ্কার বোঝা যায় প্রতি বছর এসব সমীক্ষার ফল দেখলেই। দেশের অগণিত অভুক্ত অর্ধভুক্ত জনগণের পাশে মুষ্টিমেয় শিল্পপতির এই ফুলেফেঁপে ওঠা সম্পদের পাহাড় যখন নিষ্ঠুর ব্যঙ্গের মতো প্রকট হয়ে ওঠে, তখন বড় বড় অর্থনীতিবিদ, সমাজতাত্ত্বিকরা বিশ্লেষণে বসেন। কখনও গরিব মানুষকে ঋণ দেওয়া, কখনও স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প, কখনও আর্থিক উন্নয়ন ওপর থেকে নিচে চুঁইয়ে পড়ার তত্ত্ব হাজির করেন। আর এইসব তত্ত্বকথার আড়ালে এই বৈষম্যের আসল কারণটি তারা চাপা দিতে চান বা বাজাররক্ষার তাগিদে চাপা দিতে বাধ্য হন।
কদিন পরেই ৭৫তম স্বাধীনতা দিবসের সূর্য উঠবে ভারতবর্ষের আকাশে। লাল কেল্লায় উড়বে তেরঙা জাতীয় পতাকা। প্রধানমন্ত্রী, বড় বড় নেতা মন্ত্রীরা ভাষণ দেবেন, ‘শান্তি-গণতন্ত্র-উন্নয়নের’ বাণী শোনাবেন। ক্যামেরার ঝলকানি আর রোড শো-এর কুচকাওয়াজের তলায় চাপা পড়ে যাবে বুভুক্ষু ভারত, সেই ভারতের কোটি কোটি মানুষের আর্তনাদ। লক্ষ ভারতবাসীর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার এই পরিণতি হল কেন? স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছরেও কেন শিশুরা অপুষ্টিতে ভোগে ? দেশের বেকারত্বের হার কেন রেকর্ড ছুঁয়ে ফেলে? দারিদ্রের জ্বালায় শ্রমিক-কৃষকের আত্মহত্যা কেন রোজের হেডলাইন হয়? আজ থেকে দুশো বছর আগে মহান দার্শনিক কার্ল মার্কস গোটা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষকে এই কেন-র সঠিক উত্তর দিতে পেরেছিলেন। মার্কসের ক্ষুরধার বিশ্লেষণ দেখিয়েছিল পুঁজিমালিকের মুনাফার উৎস কোথায়।
শ্রমিককে তার উৎপাদিত মূল্যের সমান মজুরি না দিয়ে অর্থাৎ ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করে যে উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি হয়, সেটাই মালিকের মুনাফার উৎস। সর্বোচ্চ মুনাফার লোভে শ্রমিককে ক্রমাগত শোষণ করতে করতে কমতে থাকে শ্রমিকের ক্রয়ক্ষমতা, তৈরি হয় বাজারসঙ্কট। সেই সংকট সামাল দিতে পুঁজি চায় উৎপাদিকা শক্তিকে বন্ধ্যা করে রাখতে। শুরু হয় শ্রমিক ছাঁটাই, লক আউট, লে অফ। গুদামে শস্য পচে, অবিক্রীত পণ্য পড়ে থাকে কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছায় না। মার্কসবাদ শুধু পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ক্রমশ বাড়তে থাকা আর্থিক বৈষম্যের কারণটিই ব্যাখ্যা করেনি, দেখিয়েছে তা থেকে মুক্তির ইতিহাস নির্দেশিত পথও। যতদিন উৎপাদন যন্ত্রের মালিকানা থাকবে ব্যক্তির অধীনে, যতদিন উৎপাদনের উদ্দেশ্য হবে সর্বোচ্চ মুনাফা, ততদিন বাড়বে শোষণ, বাড়বে দারিদ্র। শ্রমিকদের ছিবড়ে করে ফুলেফেঁপে উঠবে পুঁজিমালিকের সম্পদ। পুঁজিবাদের খোল-নলচের মধ্যে কোনও টোটকা, কোনও প্রকল্প, কোনও দান-খয়রাতি দিয়েই এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো যাবে না। এর একমাত্র সমাধান সামাজিক মালিকানার ওপর প্রতিষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক সমাজ, যেখানে মুষ্টিমেয় মালিকের মুনাফা নয়, মানুষের প্রয়োজন মেটানো হবে উৎপাদনের উদ্দেশ্য। মাটির পৃথিবীর বুকে সেই শোষণহীন স্বর্গ প্রতিষ্ঠা করেছিল লেনিন-স্ট্যালিনের রাশিয়া, মাও সে-তুং এর চীন।
পুঁজিবাদী অর্থনীতির অনিবার্য নিয়মে আজ শুধু আমাদের দেশে নয়, গোটা বিশ্বে এই পাহাড়প্রমাণ বৈষম্য, শ্রমজীবী মানুষের হাহাকার, বিক্ষোভ। একমাত্র মার্কসবাদের মধ্যে পুঁজিবাদের মৃত্যুর চাবিকাঠিটি আছে বলেই দারিদ্র বৈষম্য-অর্থনীতি নিয়ে শত জলঘোলা হলেও এই ব্যবস্থার রক্ষকরা নেহাত দায়ে না পড়লে মার্কসের নাম মুখে আনতে চান না। অন্য দিকে এই অন্যায় বৈষম্যের বিশ্বে সমস্ত শোষিত মুক্তিকামী জনগণের সামনে সংগ্রামের অমোঘ হাতিয়ার হল মার্কসবাদ লেনিনবাদ এবং তাঁকে অনুসরণ করে গড়ে ওঠা যথার্থ বিপ্লবী দল।