স্পর্ধায় এগিয়ে আসুক সহস্র অনু

দিল্লির কুড়ি বছরের মেয়েটি, অনু দুবে, সংসদের ফটকের উল্টো দিকের ফুটপাতে একা বসেছিল একটি প্ল্যাকার্ড হাতে৷ তাতে লেখা, ‘কেন আমি আমার ভারতে নিরাপদ নই?’ কোনও স্লোগান সে তোলেনি, কোথাও ঢোকার চেষ্টাও করেনি৷ কিন্তু পুলিশ এসে টেনে হিঁচড়ে তাকে তুলে নিয়ে গেল থানায়৷ সেখানে লোকচক্ষুর আড়ালে তার উপর চলল মারধর৷ নখ দিয়ে আঁচড়ে দেওয়া হল সারা শরীর৷

কী ছিল তার অপরাধ? একান্ত নিজের অনুভূতি থেকে যে মূল্যবান প্রশ্নটি তুলে ধরতে গিয়েছিল সে, সেটা ছিল আজকের ভারতের সমগ্র নারী সমাজের নিরাপত্তার প্রশ্ন৷ এই সামান্য প্রতিবাদটুকুই ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল প্রশাসনে৷ স্ফূলিঙ্গ থেকেই যে দাবানল তৈরি হয়

মাত্র দিন কয়েক আগে হায়দরাবাদের তরুণী চিকিৎসককে পরিকল্পিতভাবে অপহরণ ও গণধর্ষণ করে চারজন মদ্যপ যুবক৷ তারপর প্রমাণ লোপাট করতে তাকে খুন করে দেহে পেট্রল দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় তারা৷ এই হাড়–হিম–করা ঘটনা অনু দুবের মতো গোটা নারীসমাজের মনে গভীর উদ্বেগ জাগিয়ে তুলেছে৷ তাঁরা অসহায় বোধ করছেন৷ অসহায় বোধ করছেন নিজের এবং নারীসমাজের প্রতিদিনের নিরাপত্তা নিয়ে৷

এরই মধ্যে এল ১৬ ডিসেম্বর৷ ২০১২ সালের এই দিনটিতে দিল্লির এক প্যারা মেডিকেল ছাত্রী দুষ্কৃতীদের পাশবিক অত্যাচারের শিকার হয়েছিল৷ অপরিসীম যন্ত্রণা নিয়ে মাত্র তেরো দিন সে বেঁচেছিল৷ কিন্তু ওই অবস্থাতেও ঘটনার প্রতিবাদ করে, দুষ্কৃতীদের শাস্তি চেয়ে সমাজের কাছে তার শেষ আকুতি ঝড় তুলেছিল সারা দেশে৷ প্রবল শীত উপেক্ষা করে দিল্লির যন্তরমন্তর তিন দিন তিন রাত অবরুদ্ধ হয়েছিল৷ দিল্লি প্রশাসন রক্তচক্ষু দেখিয়ে জলকামান চালিয়েও সেই অবরোধকে ভাঙতে পারেনি৷ দেশের মানুষ সেই তরুণীর নাম দিয়েছিল ‘নির্ভয়া’৷ ৩০ নভেম্বর অনু দুবের নিঃসঙ্গ–নীরব প্রতিবাদে প্রশাসন সেই ঝড়েরই পূর্বাভাস দেখেছিল৷

২০১২ সালে দিল্লির মসনদে ছিল কংগ্রেস সরকার৷ সে সময়ে দীর্ঘদিনের উপেক্ষিত নারী নিরাপত্তার দাবিতে আন্দোলনে উত্তাল হয়েছিল দেশ৷ পরবর্তীকালে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় বসেছে, স্লোগান তুলেছে ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’৷ কিন্তু নারীর নিরাপত্তা সুরক্ষিত হয়নি৷

উত্তরপ্রদেশের উন্নাওয়ে, গোয়ায়, বিজেপির নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই অভিযুক্ত, শ্রীনগরের কাঠুয়ায় বিজেপি বিধায়ক প্রকাশ্যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ছড়িয়ে অভিযুক্তদের সমর্থনে মিছিল করে৷ গোটা দেশে লাগামহীনভাবে বেড়ে যাওয়া নারী ধর্ষণ ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা, একের পর এক নৃশংস হত্যার ঘটনা মানুষের বিবেককে অস্থির করে তুলছে৷

আইন আছে, প্রশাসন আছে, মানুষের প্রতিবাদ আছে, তা সত্ত্বেও এই ঘটনার রাশ টানা যাচ্ছে না কেন? আসলে, গোটা সমাজটা দাঁড়িয়ে আছে অন্যায়ের উপর৷ সরকার ও প্রশাসনের সদিচ্ছা নেই আক্রান্ত–ধর্ষিতা অসহায় নারীদের পাশে দাঁড়াতে৷ তাই রাতের অন্ধকারে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাতেও থাকে না পর্যাপ্ত পুলিশি নজরদারি৷ থানায় গেলে আক্রান্তদের পাশে থাকার বদলে চলে অসহযোগিতা৷ দুষ্কৃতী ও তার দলবলের হুমকির মুখে জোটে না প্রশাসনের নিরাপত্তা৷ পুলিশের যথাযথ উদ্যোগের অভাব ও কোর্টের বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় অপরাধীর শাস্তি যতদিনে হয়, ততদিনে ঘটনার স্মৃতি মানুষের মন থেকে মুছে গেছে৷ বহু সময় অপরাধী ছাড়া পেয়ে যায়৷

সরকার রাজস্ব আদায়ের অজুহাতে মদের ঢালাও লাইসেন্স দিয়ে এলাকায়, এলাকায় দুষ্কৃতী তৈরি করে চলেছে৷ আর দুষ্কৃতীরাই তো ভোটসর্বস্ব রাজনৈতিক দলগুলির শক্তির উৎস৷ তাই তারা যাতে শাস্তি থেকে রেহাই পেয়ে যায়, তার জন্য প্রশাসনের উপর চাপ থাকে৷ প্রশাসন এদেরই অঙ্গুলিহেলনে কাজ করে৷ অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশের মধ্যস্থতায় স্থানীয় প্রভাবশালীদের নির্দেশে টাকার বিনিময়ে ঘটনা চাপা দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলে৷

আজ ক্ষয় ধরা এই পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় মানুষ অর্থনৈতিক সামাজিক নানা নিষ্পেষণে জর্জরিত৷ মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি, ছাঁটাই, লক–আউট, কৃষকের রোজগারহীনতায় মানুষ ব্যতিব্যস্ত৷ তরুণ প্রজন্মের সামনে নেই প্রকৃত শিক্ষার সুযোগ, নেই ভবিষ্যৎ জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তোলার কোনও সুস্পষ্ট দিশা, নেই সামাজিক উন্নত আদর্শ, নীতিনৈতিকতা, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ৷ আছে অপরাধ জগতের হাতছানি, মদেরও ঢালাও ব্যবস্থা, শাসকদলের রাজনৈতিক প্রশ্রয়৷ শাসক শ্রেণির আড়কাঠিরা আমাদের ঘরের ছেলেদেরই ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, করে তুলছে অমানুষ৷ একে রুখতেই হবে৷

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ১৮ সংখ্যা)