‘পুঁজিবাদী দুনিয়ার ইঞ্জিন’ আমেরিকার শ্রমজীবী মানুষের একটা বাস্তব কাহিনী শোনা যাক, যে কাহিনি শুধু মার্কিন দেশের ধনতান্ত্রিক ‘অগ্রগতি’র প্রকৃত চেহারাকেই তুলে ধরে না, গোটা পুঁজিবাদী দুনিয়ারই ছবি যেন তাতে ফুটে ওঠে।
ক্যালিফোর্নিয়ার লস এঞ্জেলেস শহরের কেন্দ্রস্থলে সিটি সেন্টার থেকে মাত্র তিন মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত স্কিড রো। যাকে আড়াল করার জন্য সে দেশের সরকার থেকে ‘উন্নয়নের ভগীরথ’ ধনকুবেররা– সবার চেষ্টার শেষ নেই। আমেরিকার সবচেয়ে বেশি বিলিওনেয়ারের বাস এই ক্যালিফোর্নিয়াতেই। আর সেখানকারই প্রধান শহরের কেন্দ্রস্থলের একেবারে ঢিলছোঁড়া দূরত্বে স্কিড রো হল বহুতল বাড়ি দিয়ে পরিবৃত একটি অঞ্চল, যা সহজে নজরে পড়ে না। সেখানকার রাস্তাগুলিতে অস্থায়ী তাঁবু, ত্রিপল, ছোট ছোট ছাউনি, বাতিল গাড়িতে বসবাস করেন প্রায় ৬ হাজার আশ্রয়হীন মানুষ। অল্প কিছু শৌচালয় ছাড়া কোনও সুযোগ-সুবিধা নেই। সাফাই কর্মীরা ওই অঞ্চল ভুলেও মাড়ান না। এ ক্ষেত্রে পরিবেশ যতটা নিম্নমানের হওয়ার তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। পার্শ্ববর্তী এলাকার ডাস্টবিন থেকে খাদ্য ও ব্যবহার্য নানা জিনিস সংগ্রহ করেন এখানকার বাসিন্দারা। তা থেকেও এদের বঞ্চিত করতে স্থানীয় প্রশাসন নোংরা ফেলার পাত্রগুলি অনেক সময় তালা বন্ধ করে রেখে দেয়। এখানকার বাসিন্দাদের আয়ু খুব বেশি হলে ৪৮ বছর, যা মার্কিন নাগরিকদের গড় আয়ুর থেকে ২০ বছর কম।
১৮৫০ নাগাদ ক্যালিফোর্নিয়া আমেরিকার অংশ হিসাবে অর্ন্তভুক্ত হওয়ার সময় থেকে স্কিড রো-র কাহিনি শুরু। সোনা এবং কাজের সন্ধানে মানুষ পূর্ব থেকে পশ্চিমের এই অঞ্চলে ছুটে এসেছিল। কিন্তু বহুজনের স্বপ্নভঙ্গ হয়, বেকার ও আশ্রয়হীন অবস্থায় অবশেষে তারা স্কিড রো-তে বসবাস করতে বাধ্য হন। ধনী প্রতিবেশীদের কাছে এই আশ্রয়হীন মানুষরা অস্পৃশ্য। ১৯৭০ সালে নগর-কর্তারা এখানকার বাসিন্দাদের বাকি শহরের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে সীমারেখা টেনে দেয়। বহু পুরনো বাড়ি ধসিয়ে নতুন বহুতল তৈরি করে। তারা বুলডোজার দিয়ে স্কিড রো-কে গুঁড়িয়ে দেওয়ারও পরিকল্পনা করে, কিন্তু এখানকার বাসিন্দাদের বাধায় তা ভেস্তে যায়। স্কিড রো-র বাসিন্দারা হুঁশিয়ারি দেয়, একটা স্কিড রো ভেঙে দিলে লস এঞ্জেলেসে আরও অসংখ্য স্কিড রো তৈরি হবে। কর্তৃপক্ষ এই অঞ্চলকে কনটেনমেন্ট জোন হিসাবে সীমাবদ্ধ করে, যাতে পার্শ্ববর্তী এলাকায় গগনচুম্বী প্রাসাদ তৈরিতে অসুবিধা না হয়। তারা স্কিড রো-তেই কিছু শৌচালয় এবং রাস্তার ধারে বসার বেঞ্চ বানিয়ে দেয়, যাতে ‘অবাঞ্ছিত জনসংখ্যা’ একটা এলাকাতেই আটকে থাকে।
এইভাবে স্কিড রো-র অসহায় মানুষদের ‘অবাঞ্ছিত’ করে দেয় গণতন্ত্রের ধবজাধারী মার্কিন সরকার। তারা স্কিড রো এবং পার্শ্ববর্তী এলাকা জেলের মতো তীব্র আলোয় ভরিয়ে রাখে। ডাস্টবিনগুলির তালা বন্ধ করে রাখে, যাতে সেখান থেকে খাবার সংগ্রহ করতে না পারে এখানকার বাসিন্দারা। অথচ অভুক্তদের খাবার দেওয়ার কোনও ঘোষণা সরকার করেনি। আশ্রয়হীনদের জন্য এক অঘোষিত বিচ্ছিন্ন অঞ্চল! ১৯৯০ সালে মানসিক রোগীদের চিকিৎসা তহবিল ফুরিয়ে গেলে হাসপাতাল ও স্যানাটোরিয়াম থেকে তাদের এই অঞ্চলে এনে রাখা হয়, তাদের পক্ষে সেটা মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর জানা সত্তে্বও। পুলিশ প্রায়ই এখানে টহল দেয়। বাসিন্দারা সবসময়ই উচ্ছেদের ভয়ে থাকে। কনটেনমেন্ট জোন করে রাখা এবং কাজহীন, আশ্রয়হীন মানুষদের বিচ্ছিন্ন করে রাখার পরিকল্পনা– এক শহরের আলোর রোশনাই ঢেকে দেয় তারই মধ্যে থাকা আরেকটা শহরকে। এই নেই হয়ে থাকা শহরের বাসিন্দাদের বেকারি, বাসস্থানের অভাব, মানসিক অবসাদ, ড্রাগে আসক্তি– এই সব প্রকৃত সমস্যার দিকে কখনও দৃষ্টি দেয় না শাসকরা। করোনা অতিমারি এবং অর্থনৈতিক সংকট, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বৃদ্ধি মানুষের জীবনকে করে তুলেছে আরও দুর্বিষহ।
অবশ্য স্কিড রো একা নয়। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির দেখা আমেরিকার বহু শহরেই মিলবে। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০-তে আমেরিকার ৫ লক্ষ ৮০ হাজার ৪৬৬ জন মানুষ আশ্রয়হীন অবস্থায় দিন কাটিয়েছেন। দেশের সবচেয়ে ধনী তিনটি রাজ্য– ক্যালিফোর্নিয়া, নিউইয়র্ক এবং ফ্লোরিডায় সবচেয়ে বেশি মানুষ আশ্রয়হীন। নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, আমেরিকার প্রতিটি রাজ্যে আশ্রয়হীন মানুষের সংখ্যা মারাত্মক হারে বেড়ে চলেছে। ওই পত্রিকার রিপোর্ট– গত কয়েক মাসে আমেরিকায় এই সংখ্যা দ্বিগুণ, তিনগুণ হারে বেড়েছে। ১৯৮৬ সালের পর থেকে ঘরভাড়া বেড়েছে অত্যন্ত দ্রুতহারে ফলে সামান্য দিনমজুরি করে, ছোটখাট কাজ করে যারা পেট চালান তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। অতিমারির পরে ৭০ লক্ষ নিম্ন আয়ের মানুষ ঘর ভাড়া দিতে পারছেন না। উচ্চশিক্ষিত বহু মানুষও ঘরভাড়া দিতে না পেরে গাড়িতেই দিন কাটাতে বাধ্য হন।
আফ্রিকান-আমেরিকান ও কৃষiরাঙ্গদের মধ্যে গৃহহীনের সংখ্যা সাদা চামড়া এবং এশিয়ানদের তুলনায় অনেক বেশি। তাঁরা কিন্তু অকর্মণ্য নন, বরং কর্মদক্ষ। কাঠের কাজ, জলের পাইপের কাজ ও অন্যান্য নানা টেকনিক্যাল কাজে তাঁদের ডাক পড়ে উচ্চবিত্তের ঘরে। আশ্রয়হীনদের সাথে অবসরপ্রাপ্তরা যুক্ত হওয়ায় এই সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে। তারা কর দিয়ে এবং কাজের মধ্য দিয়ে দীর্ঘকাল দেশকে সমৃদ্ধশালী করেছেন। আশা ছিল তাঁরাও উপযুক্ত সামাজিক সুরক্ষা পাবেন। উদারিকরণের যুগে সে সুরক্ষা প্রায় নেই। কেউ কেউ নামমাত্র সুরক্ষা ভাতা পান। ‘দেশের জন্য’ যাঁরা যুদ্ধ করেছেন, সেই অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকদেরও ১১ শতাংশ আশ্রয়হীন। ৪০ থেকে ৬০ হাজার এমন সৈনিকের কোনও আশ্রয় নেই। এদের অর্ধেকের বয়স ৫১ বছরের উপরে অর্থাৎ নতুন কোনও কাজ তাঁরা পাবেন না। বেকার, অবসরপ্রাপ্ত নাগরিক, সৈনিক, যুবক সহ বহু পেশার সাথে যুক্ত নাগরিকরা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে রাস্তায় জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন।
রাস্তায় দিন কাটানোর ফলে মানসিক অবসাদ ও নানা অনিশ্চয়তায় ভুগে অনেকে ড্রাগ-আসক্ত হয়ে পড়ে। তাদের এর থেকে মুক্ত করার বদলে সরকার এটাকেই প্রচারের হাতিয়ার করে সকল আশ্রয়হীন মানুষকেই আরও প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দেয়। নাক উঁচু উচ্চবিত্ত এবং বড় বড় সংবাদমাধ্যমের ঠাণ্ডা ঘরে বসা সাংবাদিকদের দিয়ে প্রচার তোলা হয় এই আশ্রয়হীনদের জন্য প্রয়োজনীয় আশ্রয়স্থল সরকার করে দিয়েছে। তবু রাস্তায় থাকা এদের যেন একটা সখ! বাস্তব হচ্ছে, এই শেল্টার হোমগুলিতে থাকতে চেয়ে ওয়েটিং লিস্টে নাম লিখিয়ে বসে থাকেন যাঁরা, একেকটা হোমেই তাঁদের সংখ্যাটা হাজার জনের বেশি হয়ে যায় প্রতি রাতে। সরকারি প্রচার, এরা কাজ করতে চায় না। কিন্তু বাস্তব হল, এরা দক্ষ এবং কাজ করতে ইচ্ছুক, কিন্তু কোনও কাজ তারা পায়নি। তাদের কোনও ঠিকানা এবং ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ না থাকায় এই সমস্যা বেড়েছে বহু গুণ।
২০০৮-এ মার্কিন অর্থনীতিতে ভয়াবহ মন্দার পর বিশেষজ্ঞরা বহু দাওয়াই বাতলে বলেছিলেন, এবার ঘুরে দাঁড়াবে মার্কিন তথা বিশ্বের পুঁজিবাদী অর্থনীতি। বাস্তবটা কি তা ওই একটুখানি রাস্তা স্কিড রো-ই দেখিয়ে দিচ্ছে চোখে আঙুল দিয়ে। এই পুঁজিবাদের অনিবার্য সংকট থেকে রেহাই নেই কারও। তাই ভয়াবহ ধনবৈষম্যে যেমন ভুগছে দরিদ্রতম দেশ তেমনই সে রোগের দগদগে ঘা আস্তে আস্তে গ্রাস করছে মার্কিন দেশকেও। অট্টালিকার পুলটিশ দিয়ে স্কিড রোয়ের ঘা কতদিন ঢেকে রাখবে মার্কিন শাসকরা? পারবে ততদিন যতদিন ওই আশ্রয়হীন মানুষগুলির মতো কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষের থেকে সমাজবদলের প্রকৃত রাস্তাটাকে ওরা আড়াল করতে পারবে। তবে সেটাও চিরকাল পারবে না।