কলকাতা বইমেলা চলছে বিধাননগরে। সেখানে কত মানুষের ঢল, প্রচারের জৌলুস। সেখানে না গিয়ে শহিদ মিনারে কেন? প্রশ্নটা শুনে উত্তর ২৪ পরগণার কলেজ ছাত্রী প্রত্যুষা দাস বললেন, লেনিনকে আমি জানি না। কিন্তু তাঁর শতবর্ষ পালন করতে যাঁদের দেখছি তাঁরা অন্যরকম। ছাত্র জীবনের সমস্যার সামনে পড়ে, আর সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নে ছাত্রদের শিক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্র নিয়েছিল– এই গল্প বড়দের মুখে শুনে ভাবতাম এ কি বাস্তবে ঘটতে পারে? সেটা জানতেই এখানে এসেছি। তিনি প্রথমবার এই ধরনের সমাবেশে এসেছেন পরিবারের বাধা অতিক্রম করে।
পূর্ব মেদিনীপুরের মুগবেড়িয়া থেকে এসেছেন রাহুল দে, চন্দন দাসেরা। খেতমজুরের কাজ করেন। বললেন, আমরা চাঁদা তুলে বাস ভাড়া করে এসেছি। চাষের কাজ চলছে, সেজন্য আরও অনেকে আসতে পারেনি। সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য শুনে বুঝে নিতে চাই রাশিয়ায় কীভাবে শ্রমিক-কৃষক-খেটে খাওয়া মানুষের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পাশেই বসেছিলেন স্কুলছাত্র অশোক দিন্দা। বললেন, জাতীয় শিক্ষানীতি গরিব ঘরের ছাত্রদের শিক্ষার সুযোগ থেকে দূরে সরিয়ে দেবে। এটা জানার পর ছাত্র সংগঠন এআইডিএসও-র সাথে যুক্ত হই। তাদের ডাকেই এসেছি এই মহান মানুষটির সংগ্রামী জীবন নিয়ে সমাবেশে বক্তব্য শুনতে।
দার্জিলিং থেকে এসেছেন উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজের এক দল ছাত্র। জানতে এসেছেন, মহান লেনিন কী ভাবে মেকি সমাজতন্ত্রীদের মোকাবিলা করে সাধারণ মানুষের জন্য শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিলেন এবং তা পরিচালনা করেছিলেন। তারা সোভিয়েত ইউনিয়নে চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতির কথা শুনেছেন। শুনেছেন অসুস্থ ও আহত ব্যক্তিকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে সুস্থ করে তোলার জন্য চিকিৎসা, তাদের স্যানাটোরিয়ামে রেখে সুস্থ করে আবার যুদ্ধক্ষেত্রে কিংবা সাংগঠনিক কাজে পাঠানোর অভিজ্ঞতা। সেই সমাজতন্ত্র সম্পর্কে জানতে এসেছি এই সমাবেশে।
মুর্শিদাবাদ জেলা থেকে আসা মনে-প্রাণে বামপন্থী এক শিক্ষক রামমন্দিরের হুজুগ দেখে বিরক্ত। বললেন, মনে পড়ে যাচ্ছে কবিগুরুর ‘দীনদান’ কবিতাটি–
‘‘… ‘সে মন্দিরে দেব নাই’ কহে সাধু।
রাজা কহে রোষে, ‘দেব নাই! হে সন্ন্যাসী, নাস্তিকের মতো কথা কহ।
রত্নসিংহাসন পরে দীপিতেছে রতনবিগ্রহ–শূন্য তাহা’?
‘শূন্য নয়, রাজদম্ভে পূর্ণ’
সাধু কহে, ‘আপনায় স্থাপিয়াছ, জগতের দেবতারে নহে’।’’ বললেন, ধর্ম নিয়ে রাজনীতির প্রতিবাদেই যোগ দিতে এসেছি আজকের সমাবেশে।
উপস্থিত এক সাংবাদিক ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন সমাবেশের চেহারা। শেষে বলে গেলেন, দেখলাম গ্রাম-শহর থেকে, জেলাগুলো থেকে এত মানুষ এসেছেন– শুধু শিক্ষিত মধ্যবিত্তরাই নয়, অসংখ্য গরিব খেটে-খাওয়া মানুষ– তবুও কী শৃঙ্খলা! কী মনোযোগ দিয়ে সকলে প্রভাসবাবুর ভাষণ শুনলেন! অন্য কোনও দলের মিটিংয়ে এমনটা চোখে পড়ে না।
এসেছেন হাওড়া জেলার এক গ্রাম পঞ্চায়েতের ওয়াটার ক্যারিয়ার সুইপার ইউনিয়নের কর্মী সরস্বতী আস। দফতরে সারা দিন ঝাড়ু দিয়ে, টেবিল পরিষ্কার করে এবং পরিশ্রমসাধ্য আরও নানা কাজ করে মাসিক বেতন পান মাত্র ৫০০০ টাকা। বললেন, আমরা শ্রমিক সংগঠন এ আই ইউ টি ইউ সি-র নেতৃত্বে শ্রমিক হিসাবে স্বীকৃতির ও বেতন বাড়ানোর লড়াই করছি। নেতাদের মুখে শুনেছি, রাশিয়ার শ্রমিকরা জার ও বুর্জোয়া কেরেনেস্কি সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিপ্লব করেছিল, নিজেদের জীবনকে মর্যাদাময় করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের শ্রমিকরা কীভাবে মহান লেনিনের বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে লড়াই করত তা জানতেই এসেছি এখানে।
নদীয়ার কৃষ্ণনগর থেকে এসেছেন কৃষক নেতা পরেশ হালদার। তাঁরা লড়াই করছেন এআইকেকেএমএসের নেতৃত্বে। বললেন, আমরা কৃষক জীবনের সমস্যার সমাধানে এলাকায় এলাকায় কৃষক কমিটি গড়ে তুলে আন্দোলন আরও জোরদার করছি। রাশিয়ার বুকে বিপ্লব সফল করতে সোভিয়েতগুলোতে কৃষকরা সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেছিলেন। দেশের বুকে কৃষকদের লড়াই-আন্দোলন সংগঠিত করার জন্য আমরা সেখান থেকে শিক্ষা নিতে এসেছি। নদীয়া থেকেই এসেছিলেন বিশ্বনাথ মণ্ডল। তিনি প্রথম শ্রেণি থেকে ইংরেজি চালুর আন্দোলন দেখে এস ইউ সি আই (সি) দলের সংস্পর্শে আসেন। সোভিয়েত বিপ্লবের রূপকার মহান লেনিনের মৃত্যুশতবর্ষ উদযাপনে শহিদ মিনার ময়দানে মানুষের ঢল দেখে তিনি মুগ্ধ।
সোভিয়েত ইউনিয়নে মহিলাদের পারিবারিক ও সামাজিক শোষণ-নিপীড়ন থেকে মুক্তির খবর শুনেছি। শুনেছি ঘরের কাজের বোঝা থেকে তাদের মুক্তি দিতে যৌথ রান্নাঘর, যৌথ ধোপাখানার কথা। আমাদের কাছে তো এ সব স্বপ্ন মনে হয়! তাই জানতে এসেছি এখানে কী ভাবে, কবে এমন দিন আনা যাবে– বললেন, পুরুলিয়ার আনাড়ার গৃহবধূ অষ্টমী পরামাণিক।
অযোধ্যায় রামমন্দির প্রতিষ্ঠার এত আয়োজন, গ্রামগঞ্জের চারিদিকে নাম-সংকীর্তনের আসর– সে সব উপেক্ষা করে প্রবল শীতের মধ্যে কেন এই সমাবেশে এলেন? দক্ষিণ ২৪ পরগণার গোসাবার জলে-জঙ্গলে কুমির-বাঘের সাথে লড়াই করে দিনকাটানো অঞ্জলি সরদার বললেন, রামমন্দির হলে কী আমাদের কাজ জুটবে? জিনিসপত্রের দাম কমে যাবে? আমাদের ঘরের মানুষগুলোকে বাঘের পেটে যেতে হবে না? তাই শোষণ-বঞ্চনা থেকে রেহাই পেতে বুঝতে এসেছি শোষিত মানুষের নেতা লেনিনের জীবনসংগ্রাম ও শিক্ষা।
পুঁজিপতি শ্রেণির সমাজতন্ত্রবিরোধী শত অপপ্রচার সত্ত্বেও শ্রমিক মেহনতি মানুষ যে আজও বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেন, তা আবারও প্রমাণ হল লেনিন মৃত্যুশতবর্ষের এই সমাবেশ দেখে। আমাদের দেশেও এই বিপ্লব সম্ভব একমাত্র সঠিক কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বেই– এই দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে ফিরলেন শহিদ মিনারে আসা লক্ষাধিক মানুষ। কানে তখনও ভাসছে ‘সর্বহারা মুক্তিসূর্য তুমি, সেলাম তোমায় কমরেড লেনিন’ সঙ্গীতের সুর আর সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষের আহ্বান মানবসভ্যতা ধ্বংসে উদ্যত পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লেনিনের দেখানো পথে সর্বাত্মক সংগ্রামে শামিল হোন।