দেশ আজ কোভিড অতিমারিতে বিপন্ন। মৃত্যু হচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষের। ওষুধ, ভ্যাকসিন, ভেন্টিলেটর, বেডের হাহাকার চতুর্দিকে। অক্সিজেনের অভাবেই যে কত মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন, তার হিসেব নেই। শ্মশানেও লম্বা লাইন। গঙ্গায় শবদেহ ভেসে যাচ্ছে, কুকুরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে মৃতদেহ। কোনও সংবেদনশীল মানুষ কি এ দৃশ্য সহ্য করতে পারে! কিন্তু আমাদের লৌহকঠিন-হৃদয় প্রধানমন্ত্রী এই বীভৎসতা শুধু অগ্রাহ্য করে চলেছেন তাই নয়, এই ভয়ানক সময়ে তিনি পূর্ণ উদ্যমে লেগে পড়েছেন তাঁর স্বপ্নের প্রকল্প ‘সেন্ট্রাল ভিস্টা’-কে রূপ দিতে।
কী এই সেন্ট্রাল ভিস্টা প্রকল্প? দিল্লিতে রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে ইন্ডিয়া গেট– এই দীর্ঘ রাজপথের দু’ধারে যে সরকারি ভবনগুলো রয়েছে, ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে সেগুলি ভেঙে তৈরি হবে একাধিক বিলাসবহুল প্রাসাদ। তৈরি হবে নতুন সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রী ও উপরাষ্ট্রপতির প্রাসাদোপম বাসভবন। থাকবে বিশেষ রক্ষীবাহিনীর থাকার ব্যবস্থা। এখানে ৫৯ টি মন্ত্রককে একত্রিত করে, আমলাদের একসাথে রেখে দেশে বোধহয় আরও জোরদার সুশাসনই কায়েম করতে চান মোদিজি!
কেন্দ্রের বিজেপি সরকার বলছে, বিশ্বমানের এই সেন্ট্রাল ভিস্টা নাকি দেশের স্বাধীনতার ৭৫ বছরের জাতীয় গৌরব ফলকে পরিণত হবে। ২০২২ সালের ২৬ জানুয়ারি এই নবনির্মিত প্রাসাদেই স্বাধীনতার ৭৫ বছরের প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপিত হবে। তাই অতিমারির হাত থেকে মানুষের প্রাণ বাঁচাতে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের বদলে বিপুল টাকা খরচ করে অতি দ্রুততার সাথে চলছে প্রাসাদ নির্মাণের কাজ। এটি নাকি ‘অত্যাবশ্যকীয় প্রকল্প’। ফলে দিল্লির লকডাউনেও কুছ পরওয়া নেহি। সংক্রমণের তোয়াক্কা না করে সেখানে ১৮০টি গাড়ি চলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কয়েক হাজার শ্রমিককে নিয়ে জোরকদমে চলছে কাজ। এতে দিল্লিতে সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় দিল্লি হাইকোর্টে অভিযোগ জানিয়েছিলেন ইতিহাসবিদ সোহেল হাশমি সহ কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিক। কিন্তু আদালত মোদিজির সহায়। ফলে অপ্রতিরোধ্য মোদি এগিয়ে চলেছেন তাঁর ‘দম্ভ-সৌধ’ নির্মাণে।
জানা গেছে, সেন্ট্রাল ভিস্টা গড়তে ঐতিহ্যমন্ডিত নানা সরকারি ভবন– যেমন উদ্যোগ, কৃষি, বায়ু, রেল, নির্মাণ, শাস্ত্রী ভবন, এমনকি বিখ্যাত বিজ্ঞানভবন, ঐতিহাসিক জাতীয় সংরক্ষণাগার ‘ন্যাশনাল আর্কাইভস’ এবং প্রাসাদতুল্য জওহরলাল নেহেরু ভবন ভেঙে ফেলা হবে। কেটে ফেলা হবে সুপ্রাচীন বিশাল গাছগুলি। সেন্ট্রাল ভিস্টা গড়তে গিয়ে জাতীয় জাদুঘরের প্রায় দুই লক্ষেরওবেশি দুর্মূল্য বস্তুর সংরক্ষণ খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রখ্যাত ঐতিহাসিকরোমিলা থাপার এবং গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, নোবেলজয়ী ওরহান পামুকের মতো শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিকেরা এই ক্ষতিকর প্রকল্প বন্ধের সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়েছেন। কিন্তু ফ্যাসিস্ট শাসকদের মতো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এইসব আপত্তিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেছেন।
প্রশ্ন উঠছে, দিল্লির সবচেয়ে মূল্যবান ১২ একর জমির উপর পাঁচটি বাংলো জুড়ে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন থাকা সত্ত্বেও মোদিজি অতিমারিতে সংকটাপন্ন মানুষকে বাঁচানোর পরিবর্তে বিশ হাজারকোটি টাকার এই প্রকল্পের কাজে এত তৎপর কেন? অনেকে বলছেন, এ হল যে কোনও উপায়ে নিজের নাম ইতিহাসের বুকে খোদাই করে যাওয়ার আকাঙক্ষা। সে কীর্তিসৌধ দেশবাসীর মৃতদেহের স্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে থাকলেও আপত্তি নেই বিজেপি সরকারের। বিদ্বজ্জনদের একাংশের মতে, মোগল ও ব্রিটিশ যুগের যে স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে দিল্লিকে ঘিরে, তা মুছে দিতে চান মোদি ও তাঁর দল। এর পিছনে রয়েছে আরএসএস-এর হিন্দুত্ববাদী পরিকল্পনা।
মোদি সরকারের এই নির্মম কার্যকলাপে স্তম্ভিত দেশের মানুষ ধিক্কার জানাচ্ছে। তাঁরা চাইছেন, এই কঠিন সময়ে বিপুল অর্থ অপ্রয়োজনীয় সৌধ নির্মাণে অপচয় না করে কেন্দ্রীয় সরকার অবিলম্বে অতিমারি মোকাবিলায় মানুষের পাশে দাঁড়াক।