আইনের কাজ কী? মানুষকে সুরক্ষা দেওয়া, সমাজের শৃঙ্খলা রক্ষা করা। জনগণের ন্যায্য অধিকার রক্ষা করার কথা নাকি আইনের? কিন্তু দেশ ও রাজ্যের যা পরিস্থিতি, তাতে প্রশ্ন জাগে– সরকারি আইন কি আদৌ জনতার স্বার্থে কাজ করছে?
এসএসসি-র মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতি প্রকাশ্যে এসেছে, নার্স নিয়োগেও দুর্নীতি ধরা পড়েছে। অথচ উপযুক্ত দ্রুততায় তদন্ত শেষ করে প্রকৃত দোষীদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না। ধর্মের নামে চলছে সাম্প্রদায়িক হানাহানি। জ্বালানি-ভোজ্য তেল-রান্নার গ্যাস সহ সমস্ত জিনিসের মূল্যবৃদ্ধিতে মানুষের জীবন জেরবার। জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে শিক্ষার বেসরকারিকরণে ইন্ধন জোগানো, দুয়ারে মদ প্রকল্পের নামে মাদক দ্রব্যের ঢালাও ব্যবসা, নারী নির্যাতনের সংখ্যা এবং ভয়াবহতা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। এই যখন সমাজের বাস্তব চিত্র, তখন আইনকে আর জনগণের প্রতি সুবিচারের পন্থা বলা যায় কি? যে আইন দিনমজুরের পেটের ভাত কেড়ে নেয়, মানুষকে নেশাচ্ছন্ন করে অমানুষে পরিণত করে, হৃদয়বৃত্তি ভুলিয়ে প্রবৃত্তির দাস বানায়, ছাত্রের শিক্ষার অধিকার কেড়ে নেয়, মা-বোনদের সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দেয়–সে আইনের প্রয়োজন কোথায়? কার্যকারিতাই বা কী? এই প্রশ্নগুলো তুলে ধরতে গত ২৯ জুন গণ আইন অমান্য আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল এসইউসিআই(সি)।
ইতিহাসের পাতায় আইন অমান্য আন্দোলনের কথা পড়া আর নিজে সেই আন্দোলনের শরিক হয়ে ওঠার মধ্যে পার্থক্য অনেক। সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে হিসেবে বাবা-মা বরাবর চাইতেন সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে। বাবা মনে মনে বামপন্থী আদর্শ সমর্থন করলেও পূর্ববর্তী চৌত্রিশ বছর সিপিএম শাসনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ, তৃণমূল ও বিজেপি সরকারের প্রতি ইতিমধ্যে আস্থা হারিয়েছেন। রাজনীতি সম্পর্কে ভুল ধারণা বহুদিন যাবৎ আমার মধ্যেও কাজ করেছে, তবে সে ভুল ভেঙে গেছে এসইউসিআই (সি) দলের সংস্পর্শে এসে। বছর দুই হল, এই দলের নেতা-কর্মীরা আমায় পরিবারের মতো আগলে রেখেছেন। এঁদের মধ্যে পেয়েছি স্বজনের ভালবাসা, আন্তরিকতার ছোঁয়া। তাই কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে এই আইন অমান্যের কথা যখন শুনলাম, আমি পিছিয়ে থাকতে পারিনি।
চোখের সামনে দেখেছি, ২৯-এর আইন অমান্যের জন্য দিনরাত এক করে পরিশ্রম করেছেন দলের কর্মীরা। দেওয়াল লিখেছেন, বাসে ট্রেনে-বাজারে-পাড়ার মোড়ে মাইক, হ্যান্ডবিল নিয়ে পৌঁছে দিয়েছেন পার্টির বক্তব্য, আন্দোলনের জন্য তহবিল সংগ্রহ করেছেন। মানুষ সাগ্রহে সমর্থন করেছেন দাবিগুলো। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের অভিজ্ঞতা বলছে, সিপিএম আমলে চাকরির নিয়োগে যে স্বজনপোষণ, দলবাজি চলত, তার পরিবর্তন হওয়া দূরে থাক, তৃণমূল আমলে তা আরও নগ্ন আকার নিয়েছে। অন্যদিকে দেশের যাবতীয় সরকারি সম্পত্তি পুঁজিমালিকদের কাছে বেচে দিয়ে এবং সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে জুয়া খেলছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। একটা বিরাট অংশের সাধারণ মানুষ তাই সমর্থন করেছেন আন্দোলন, সাধ্যমতো সাহায্য করেছেন তহবিলে। কর্মীদের প্রচার কর্মসূচিতে বহু মানুষ বলেছেন, ‘একমাত্র এই পার্টিটাই আজও সাধারণ মানুষের জন্য লড়াই আন্দোলন করে’। দিনের শেষে আপামর জনতার এই ভালোবাসাই পরিশ্রম করার শক্তি, বেঁচে থাকার রসদ জুগিয়েছে।
অবশেষে এল ২৯ জুন। মৌলালির কাছে রামলীলা পার্কে পিচমবঙ্গের প্রান্ত প্রত্যন্ত থেকে আসা হাজার হাজার মানুষের বিশাল জনসমাবেশ ঘিরে প্রথম থেকেই দেখলাম বিরাট পুলিশি প্রহরা। মিছিল শুরু হল দলের রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্যের বক্তব্য দিয়ে। তরুণ প্রজন্মের কাছে ভয়, দুর্বলতা জয় করে এগিয়ে আসার আহ্বান রাখলেন তিনি। মৌলালি থেকে এস এন ব্যানার্জী রোড ধরে মিছিল এগোচ্ছিল ধর্মতলা অভিমুখে, হাজার হাজার মানুষের সম্মিলিত স্লোগানে কাঁপছিল মহানগরীর রাজপথ। আমার মেসবাড়ির নতুন সদস্যদেরও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। আবেগের শরিক হয়ে তারাও মিছিলে হেঁটেছে। হঠাৎ শান্তিপূর্ণ মিছিলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো পুলিশ, শুরু হল লাঠিচার্জ। দেখলাম, পুলিশের লাঠির সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়ে আছে কাতারে কাতারে ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, শ্রমিক, ডাক্তার, আইনজীবী। জাত নেই, ধর্ম নেই, পেশা নেই–একদিকে আছে শোষিত-বঞ্চিত মানুষ আর অন্যদিকে উন্মত্ত মালিকের পোষা পুলিশ বাহিনী। কেউ পালাচ্ছে না। সবার মুখে এক স্লোগান–আইন ভাঙো, জেল ভরো। দেখলাম, পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে ফেলার ডাক দিয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে এগিয়ে চলেছে জনজোয়ার, ভেঙে পড়ছে ব্যারিকেডের অহঙ্কার। পুলিশ তখন আরও উগ্র মূর্তি ধারণ করেছে। টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কমরেডদের, অনেকে আহত হচ্ছেন। তবু ময়দান ছেড়ে পালাইনি আমরা। ভীরুর মতো পিছন ফিরে নয়, পুলিশের চোখে চোখ রেখে ভরেছি প্রিজন ভ্যান।
জীবনে যে মেয়ে কোনও দিন বাবা-মা’র স্নেহচ্ছায়া ছেড়ে সক্রিয় রাজনীতি করবে বলে ভাবেইনি, সে প্রথম বার দাঁড়াল পুলিশি বর্বরতার মুখোমুখি। পুলিশের লাঠি খেল, বিরোধিতা করল পুলিশের অশালীন মন্তব্যের। রাজনৈতিক বন্দীদের অত্যাচার করার অধিকার পুলিশের নেই। তবু রাজ্য সরকারের পুলিশ শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মোকাবিলা করল লাঠি দিয়ে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দৈহিক আক্রমণ করে। প্রায় একশো জনকে গ্রেপ্তার করল। কিন্তু এসইউসিআই (কমিউনিস্ট) কর্মীদের মনোবল, তেজ এতটুকু টলাতে পারেনি ওরা। মাথা উঁচু করে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ বলতে বলতে আমরা লালবাজারের লক আপ ভরিয়ে ফেললাম। হাসি মুখে সবাই মিলে গাইলাম ‘বাঁধ ভেঙে দাও’, ‘এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে’, ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’। এই প্রথম আমি দেখলাম এক সম্পূর্ণ অন্য ধরনের আন্দোলন, যেখানে বাবা-ছেলে-মা-মেয়ে একসাথে গ্রেপ্তার বরণ করলেন। এই প্রথম দেখলাম, কোনও রাজনৈতিক দলের কর্মী নিজের সন্তানকে আড়াল না করে তাকেও এগিয়ে দিচ্ছেন গণ আন্দোলনে। রক্তের সম্পর্ক ছাপিয়ে আমরা সবাই তখন সংগ্রামের সাথী–‘কমরেড’।
প্রিয়াঙ্কা চ্যাটার্জী, কলকাতা- ৭০০ ০১৩