মানুষ ধরেই নিয়েছিল, যত অন্যায়ই হোক, যত দুর্নীতিই হোক, কেউ কিছু করবে না। সব দল শুধু আখের গোছাতেই ব্যস্ত। ঠিক তখনই যেন শোনা গেল ২৯ জুনের বজ্র নির্ঘোষ– এই অন্যায় চলবে না। এত অন্যায়, এত অনিয়ম, এত দুর্নীতি– কোনও কিছুই মুখ বুজে সইব না। পুলিশের লাঠি, টিয়ার গ্যাস, জলকামান– কোনও কিছুই আটকাতে পারেনি সেই প্রতিবাদকে। ২৯ জুনের আইন অমান্যে হাজার হাজার ছাত্র-যুবক শুধু পুলিশের ব্যারিকেডই ভাঙেনি, ভেঙে দিয়েছে মানুষের অনেক স্থবিরতা, অনড়তাও। পুলিশের নির্বিচার লাঠিচার্জকে যেভাবে মোকাবিলা করেছে ছাত্র-যুবকরা, তা মানুষকে আস্থা জুগিয়েছে, সাহস জুগিয়েছে। মানুষ যেমন এই পুলিশি অত্যাচারের তীব্র নিন্দা করেছে, তেমনই বলেছে, হ্যাঁ, হবে। তোমরাই পারবে এই দুঃসহ অবস্থার বদল ঘটাতে।
সেই আস্থাই প্রকাশ পেয়েছে গত কয়েকদিন রাজ্য জুড়ে। দলের কর্মীরা আইন অমান্যের ছবি ও খবর সংবলিত ‘গণদাবী’ পত্রিকা বিক্রি করতে গেলে মানুষ সর্বত্র গভীর আগ্রহে তা সংগ্রহ করেছেন, গ্রাহক হয়েছেন, নিয়মিত দিতে বলেছেন, দলের আহত কর্মীদের খোঁজ নিয়েছেন, তাঁদের চিকিৎসার জন্য অর্থসাহায্য করেছেন। দক্ষিণ কলকাতার একটি পাড়ায় কর্মীরা যখন গণদাবী বিক্রি করছিলেন, অনেকটা যেন দৌড়েই এগিয়ে এলেন এক ভদ্রমহিলা। বললেন, ‘‘দিন আমাকে একটা কাগজ। আপনাদের কাগজ তো পড়বই। সে দিন ওই মেয়েটিকে দেখেছেন, পুলিশ যখন বাঁই বাঁই করে লাঠি ঘুরিয়ে মারছে, কী অদ্ভূত সাহসের সাথে সেই লাঠি ধরে লড়ল! আমরা সবাই দেখেছি টিভিতে।” যেন একনিঃশ্বাসে কথাগুলি বলে গেলেন ভদ্রমহিলা। শাসক দলের সমর্থক এক ব্যক্তি এগিয়ে এসে বললেন, ‘‘সপ্তাহে একটা করে বেরোয় তো আপনাদের কাগজ, আমাকে দিয়ে যাবেন। আপনারা সঠিক দাবি নিয়ে লড়ছেন।”
এক শিক্ষক বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন, এসএসসি দুর্নীতির বিরোধিতা তো কোনও পার্টির ব্যাপার নয়। সকলেরই এর প্রতিবাদ করা উচিত। আপনারা যে এটা নিয়ে প্রতিবাদ করছেন, এ জন্য ধন্যবাদ। তারপর গণদাবী নিলেন এবং আন্দোলনের ফান্ডে চাঁদা দিয়ে বললেন, আমি আছি আপনাদের আন্দোলনের সাথে।
কলকাতার মানিকতলা বাজারে কর্মীরা প্রতিবাদ সপ্তাহের হ্যান্ডবিল বিলি করছিলেন। এক দোকানদার হ্যান্ডবিল নিয়ে কর্মীটির হাতে থাকা গণদাবী দেখিয়ে বললেন, ওটা দেবেন না? কর্মীটি কাগজটি এগিয়ে দিলে তিনি দাম দিয়ে বললেন, ‘‘আমিও বামপন্থী। অনেক আন্দোলনে থেকেছি, খুঁজলে এখনও গায়ে পুলিশের মারের দাগ পাওয়া যাবে। কিন্তু আমাদের দল তো আর কিছু করবে না, পচে গেছে। আপনারাই মানুষের দাবি নিয়ে লড়ছেন। কাগজটা আমাকে নিয়মিত দেবেন। আপনাদের কাজে সাধ্যমতো সাহায্য করব।”
আইন অমান্যের পরদিন সকালে সোনারপুরে মর্নিং ওয়াক করছিলেন একদল মানুষ। এস ইউ সি আই (সি)-র স্থানীয় নেতার সাথে দেখা হতে সকলেই প্রায় সমস্বরে বললেন, ‘‘পুলিশ কী ভাবে আপনাদের কর্মীদের মেরেছে আমরা কাল টিভিতে দেখেছি। পুলিশ অত্যন্ত অন্যায় কাজ করেছে। আপনাদের ওপর সিপিএম সরকারও অত্যাচার করেছে, আবার তৃণমূল সরকারও অত্যাচার করছে। আপনারাই তো মানুষের দাবিগুলি নিয়ে লড়াই করছেন।” একজন বললেন, ‘‘ওনারা না লড়লে তো প্রাইমারিতে ইংরেজিটাই চালু হত না!”
বাঁকুড়ার একটি বাজারে পুলিশি অত্যাচারের কথা মাইকে বলছিলেন দলের কর্মীরা। স্থানীয় এক শিক্ষক দাঁড়িয়ে সবটা শুনলেন। তারপর আহত কর্মীদের চিকিৎসার জন্য একশো টাকা আর এক বাক্স মিষ্টি দিয়ে বললেন, ‘‘আজ রথের দিন। আপনারা অনেক পরিশ্রম করছেন, এগুলো খাবেন। শুধু আমি নয়, এখানকার মানুষ আপনাদের সাথে আছে। আপনারা চালিয়ে যান।”
জেলার বহু গ্রামের সংযোগস্থল লক্ষ্মণপুর। পুলিশি অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভা চলছিল সেখানে। সভার বক্তব্য শুনে এবং পুলিশি আক্রমণের ছবি দেখে এক গরিব খেতমজুর যুবক বললেন, বহু বছর আগে বহু মানুষ বাম আন্দোলনে যোগ দিত, মারও খেত। বাবা কাকা পাড়ার মুরুব্বিদের কাছে শুনেছি। আজ আবার আমরা তা দেখলাম আপনাদের মধ্যে। আপনারা রক্তঝরা পথে জীবনপণ করে এগিয়ে চলেছেন। মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছেন। আমি আপনাদের গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। আন্দোলনের জন্য আপনারা যে গণকমিটি গড়ার কথা বলছেন আমি তাতে থাকতে চাই।
পূর্ব মেদিনীপুরের কেশাপাট বাজারে কর্মীরা প্রতিবাদ সপ্তাহের প্রচার করছিলেন। এক ব্যক্তি এগিয়ে এসে কিছু টাকা দিয়ে বললেন, আপনাদের কর্মীদের চিকিৎসার জন্য আমার পক্ষ থেকে এই সাহায্যটা রাখুন। বললেন, আমার বাবা সিপিএম করতেন। আমার পরিবার এবং আমিও সিপিএমে ছিলাম। আগে আপনাদের অনেক বিরোধিতাও করেছি। এখন বুঝেছি, সিপিএম একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। আপনাদের আন্দোলনে আমার পূর্ণ সমর্থন রয়েছে।
এই সমর্থনই প্রকাশ পেয়েছিল আইন অমান্যের দিন এস এন ব্যানার্জী রোডের দু-দিকের দোকানদারদের মধ্যে। পুলিশ যখন হঠাৎই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আন্দোলনকারীদের উপর নির্মম ভাবে লাঠি চালাতে লাগল তখন রাস্তার ধারের দোকানদাররা দ্রুত কর্মীদের দোকানের মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়েছেন। আহত কর্মীদের ঠাণ্ডা জল দিয়েছেন, এমনকি দোকান থেকে ঠাণ্ডা পানীয় এনে বলেছেন, ব্যাগে রাখুন পরে আপনারা খেয়ে নেবেন।
পশ্চিম মেদিনীপুরের পাঁশকুড়ায় এক ছাত্রকর্মী সংগঠনের সঙ্গে থাকলেও সক্রিয় কর্মী ছিলেন না। টিভিতে আইন অমান্যে পুলিশি আক্রমণ এবং কর্মীদের সাহসী প্রতিরোধ দেখে তিনি এক সংগঠককে ফোন করে বললেন, দিদি, এতদিন সিওর ছিলাম না। আজকে হলাম। আমি এআইডিএসও-র কর্মী হতে চাই। কালকের লড়াইটা দেখে মন বলছে, এবার রাস্তায় নামার সময় হয়ে এসেছে। নামটা পার্মানেন্ট করে দাও।
দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার মগরাহাট এলাকার এক মহিলা কর্মী পুলিশের লাঠির আঘাতে আহত হয়েছিলেন। পরদিন তাঁকে নিয়ে স্থানীয় এক চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলেন দলের এক কর্মী। তাঁদের দেখেই পুরনো শাসক বামপন্থী দলের কট্টর বলে পরিচিত এক কর্মী দ্রুত এগিয়ে এলেন। তাঁদের কোনও কথা বলতে না দিয়েই আর একজনকে চা-বিস্কুট আনতে বললেন। তারপর টিভিতে দেখা ঘটনোর কথা নিজেই বলতে থাকলেন। কর্মীদের বুক চিতিয়ে নির্ভীক লড়াইয়ের কথা, পুলিশের নৃশংস আক্রমণের কথা, অন্যান্য কথা। তাঁর ভাব দেখে মনে হচ্ছিল যেন যুদ্ধ ফেরত সৈনিকদের কাছ থেকে যুদ্ধের যাবতীয় খুঁটিনাটি খবর জেনে নিচ্ছেন। ডাক্তার বাবু আহত কর্মীটিকে দেখার পর ফি নিতে অস্বীকার করে বললেন, ও তো আন্দোলনে আহত হয়েছে। কোনও ফি দিতে হবে না।
পুলিশের লাঠিচার্জের পর কর্মীরা যখন আন্দোলনকারীদের পা থেকে খুলে যাওয়া জুতো, ছড়িয়ে থাকা ব্যানার প্রভৃতি যখন একটা একটা করে কুড়িয়ে নিয়ে আসছেন তখন এই দোকানদাররাই অন্যদের বলেছেন, দেখুন, এই হচ্ছে এস ইউ সি আই! কর্মীদের ফেলে যাওয়া জুতোগুলিও কী ভাবে যত্নে তুলি নিয়ে যাচ্ছে! একটা ছেঁড়া ব্যানারও ফেলে রাখছে না। সব দলের থেকে এরা আলাদা।
বাস্তবিক, মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি, ছাঁটাই, ছোট-মাঝারি দোকান ও ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়া, শাসকদলের নেতাদের দুর্নীতি ও নীতিহীন আচরণ, বিরোধিতার নিষ্ক্রিয়তার মাঝে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর লাগাতার আন্দোলনের কর্মসূচিতে মানুষ আস্থা খুঁজে পাচ্ছেন। সর্বত্র তাঁরা দলের রাজনীতির প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করছেন, দলের কর্মসূচিতে যোগ দিচ্ছেন, কর্মীদের ডেকে নিয়ে যাচ্ছেন, বলছেন– আমাদের ওখানে আসুন, আপনাদের বক্তব্য মানুষকে বলুন, সংগঠন গড়ে তুলুন। কার্যত তাঁরাই সংগঠকের ভূমিকা পালন করছেন।