70 Year 29 Issue 9 March 2018
স্মরণ করুন ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী প্রচার৷ তিনি নাকি গোপনে ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের এমন বিপুল সম্ভার বানিয়ে ফেলেছেন, যা দিয়ে বিশ্বকে ধ্বংস করে দেওয়া হবে৷ ফলে বিশ্ব শান্তির পাহারাদার মার্কিন–ব্রিটিশ সাম্রাজ্যাবাদ ঝাঁপিয়ে পড়ল ইরাকের উপর৷ ধ্বংস করা হল দেশটাকে৷ বোমা মেরে মেরে ধ্বংস করা হল প্রাচীন মেসোপটেমিয়া সভ্যতার নিদর্শনগুলিকে৷ খুঁজে খুঁজে বের করা হল সাদ্দাম হোসেনকে গোপন ডেরা থেকে৷ বিচারের এক নিদারুণ প্রহসন ঘটিয়ে তাঁকে হত্যা করা হল, সেই ছবি প্রচারিত হল গোটা বিশ্বে৷ পরে প্রমাণিত হল গণবিধ্বংসী অস্ত্রের পুরোটাই সাম্রাজ্যবাদীদের বানানো এক গল্পকথা মাত্র৷ এরপর টার্গেট করা হল লিবিয়ার কর্নেল গদ্দাফিকে৷ সেই একই প্রচার, এবার আর বিচারের কোনও প্রহসন নয়, সরাসরি ন্যাটো বাহিনী প্রকাশ্য স্থানে নৃশংসভাবে হত্যা করল লিবিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান গদ্দাফিকে৷ দুনিয়া ধিক্কার দিল, থোড়াই কেয়ার করল বুশ–ব্লেয়ারের দল৷ এরপর কী? স্বভাবতই টার্গেটে এসে গেল সিরিয়া৷ একই ছক ধরে এগোচ্ছে সাম্রাজ্যবাদীরা৷ কিন্তু সিরিয়াতে তারা বাধা পেল৷ আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী গোষ্ঠী তৈরি করে তাদের যাবতীয় অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে তৈরি করা হল কিন্তু ইরাক লিবিয়ার মতো আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করা গেল না৷ সাম্রাজ্যাবাদীদের তাঁবেদার কোনও সরকারকে সিরিয়ায় বসানো গেল না৷ বিশ্ব জনমত বলল, রাষ্ট্রপতি আসাদের শাসন যদি জনবিরোধী হয়, অত্যাচারী হয় তবে তাকে সরিয়ে কোনও সরকার বসাবার অধিকার একমাত্র সিরিয়ার জনগণের আছে৷ আমেরিকার তাতে নাক গলাবার কী অধিকার? কিন্তু সাম্রাজ্যবাদীরা কোনও দিনই যুক্তির ধার ধারে না৷ ফলে আইসিস, আলকায়দা থেকে শুরু করে যত রকমের নৃশংস–নিষ্ঠুর সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী আছে তাদের পূর্ণ মদত দিয়ে সিরিয়ার অভ্যন্তরে যুদ্ধ পরিস্থিতি জিইয়ে রাখা হল৷ ধ্বংস আর মৃত্যু হয়ে দাঁড়ালো রোজকার সংবাদ৷ এই পরিস্থিতিতেই পুঁজিবাদী রাশিয়া প্রমাদ গুনল৷ পূর্ব ইউরোপের ও বাল্টিক রাষ্ট্রগুলিতে ইতিমধ্যে ন্যাটো ঘাঁটি বসাতে শুরু করেছে৷ ইউক্রেনে রাশিয়ার সমর্থক সরকারকে ফেলে দিয়ে পুরনো ফ্যাসিস্ট শক্তিগুলোকে মার্কিন–ইউরোপীয় মদতে ক্ষমতায় নিয়ে আসা হল৷ রাশিয়ার কোনও ওজর আপত্তিকে পাত্তা দিল না পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদী শাসকরা৷ রাশিয়া বুঝল তাকে সামরিকভাবে ঘিরে ফেলে বশ্যতা মানানোর যে পরিকল্পনা নিয়ে মার্কিন ব্রিটিশ শাসকরা এগোচ্ছে, এখনই পাল্টা কিছু না করলে যুদ্ধ তার ঘরে ঢুকে যাবে৷ ফলে সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নিল রাশিয়া, এই যুক্তিতে যে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী লড়াইয়ে তারা সিরিয়িার পাশে দাঁড়াতে চায়৷ যে আলকায়দা আইসিসের মতো সন্ত্রাসবাদীরা ইরাক, লিবিয়ার পর সিরিয়ায় ঘাঁটি গেড়েছে, তাদের উৎখাত না করলে রাশিয়া বিপন্ন হবে৷ এ নিয়ে রুশ–মার্কিন বাকযুদ্ধ হল প্রবল, কিন্তু রাশিয়াকে রোখা গেল না৷
বিস্তৃত আলোচনায় না গিয়ে এটুকু বলাই যায় রুশ বোমারু বিমানের আক্রমণে ওই সন্ত্রাসবাদীদের ঘাঁটিগুলি বিপন্ন হল৷ আকাশে রুশ বিমান, মাটিতে সিরীয় সামরিক বাহিনী– এই সাঁড়াশি আক্রমণে সন্ত্রাসবাদীদের দখল থেকে সিরীয় শহর আলেপ্পোকে ছিনিয়ে নিল সিরিয়া সরকার৷ সাম্রাজ্যবাদীরা বুঝল সিরিয়ায় তাদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হতে বসেছে৷ ফলে নতুন কৌশল, নতুন ছক, মিথ্যাপ্রচারের নতুন হাতিয়ারের মরিয়া খোঁজ চালাচ্ছিল সাম্রাজ্যবাদী চক্র৷ এই প্রেক্ষাপটেই সিরিয়া সরকারের বিরুদ্ধে শিশুহত্যার অভিযোগকে বিচার করতে হবে৷
সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাসের কাছে পূর্ব ঘোউটা জেলা প্রায় ছয়বছর ধরে জয়েশ আল ইসলাম, আল নুসরা ইত্যাদি আইসিস এবং আল কায়দার সহযোগী বিদেশি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের দখলে৷ যারা মার্কিন সিআইএ, ব্রিটেনের এমআই–৬, ফ্রান্সের ডিজিএসই প্রভৃতি সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা এবং আরবের ধনকুবেরদের সমর্থন এবং অর্থে পুষ্ট৷ সম্প্রতি সিরিয়ার সরকারি বাহিনী এই এলাকায় আটকে থাকা মানুষকে উদ্ধারে নামে৷ তখনই পশ্চিমি সংবাদমাধ্যম মৃত শিশুদের ছবি দেখিয়ে প্রচার শুরু করে সিরিয়া সরকারের অত্যাচারের কাহিনী৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় এই প্রচার তুঙ্গে তোলা হয়েছে৷ স্বভাবতই মানুষ এইসব ছবি দেখে শিউরে উঠছে এবং এই হত্যার জন্য সিরিয়া সরকারকে দায়ী করছে৷ এই অবস্থায় আবার সিরিয়া সরকার কেমিক্যাল গ্যাস দিয়ে শিশুহত্যা করছে এই প্রচার তোলা হচ্ছে৷ এর আগেও কয়েকবার কেমিক্যাল গ্যাস ব্যবহারের অভিযোগ সাম্রাজ্যবাদীরা সিরিয়া সরকারের বিরুদ্ধে তুলেছিল৷ কয়েকটি দেশের মিলিত আন্তর্জাতিক তদন্তে দেখা গিয়েছিল সিরিয়া সরকারের কেমিক্যাল গ্যাসের কোনও ভাণ্ডারই নেই৷ ফলে এখন হাস্যকরভাবে প্রচার করা হচ্ছে যে, উত্তর কোরিয়া এই গ্যাস পাঠিয়েছে৷ কিন্তু এই মিথ্যাও টিকছে না৷ সিরিয়ার সরকারি বাহিনী পূর্ব ঘোউটার দখল নিতে চলেছে বুঝেই মার্কিন মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদীরা শিশুদের এবং সাধারণ মানুষকে সামরিক বাহিনীর সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে৷ এই খুনে বাহিনী উদ্ধারকারী দল এবং অবরোধ থেকে মানুষকে বার করে নিয়ে যাওয়া বাসের উপর গুলি চালাচ্ছে৷ তাতে অনেকের দুঃখজনক মৃত্যু ঘটছে৷ দুই পক্ষের গুলিবৃষ্টির মধ্যে শিশুরাও প্রাণ হারাচ্ছে৷ কিন্তু তার জন্য দায়ী কি মার্কিন মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদীরা নয়? এই সন্ত্রাসবাদী বাহিনীর একটি অংশের নাম পশ্চিমী সংবাদমাধ্যমে দেওয়া হয়েছে ‘হোয়াইট হেলমেট’৷ যারা ত্রাণের নামে শিশু এবং সাধারণ মানুষকে অবরোধের মধ্যে ধরে রাখার কাজটি করে চলেছে৷ এই পরিস্থিতিতে মার্কিন রাবারস্ট্যাম্পে পরিণত রাষ্ট্রসংঘ কথিত ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতির অর্থ দাঁড়ায় কোণঠাসা আইসিস সন্ত্রাসবাদীদের বাঁচার পথ করে দেওয়া এবং তাদের হাতে জনসাধারণকে ছেড়ে দেওয়া৷ তাই সিরিয়া সরকার এবং রাশিয়ান বাহিনী উদ্ধারকারী বাসগুলি বেরিয়ে যাবার জন্য নির্দিষ্ট পাঁচ ঘন্টা ছাড়া বাকি সময় আইসিস–এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ কারা মানুষকে বাঁচাতে চাইছে তা বুঝতে অসুবিধা হয় কি?
পশ্চিমী সংবাদমাধ্যম কিন্তু একবারও বলছে না কিছুদিন আগেও সন্ত্রাসবাদীদের কবলে থাকা আলেপ্পো থেকে আইসিস এবং আমেরিকা হটে যাবার পর সেখানকার জনজীবন অত্যন্ত শান্তিতে অতিবাহিত হচ্ছে৷ আলেপ্পোকে মুক্ত করার যুদ্ধের সময়েও মার্কিন শাসকরা কোণঠাসা আইসিসকে বাঁচাতে একই রকম যুদ্ধবিরতির বাহানা তুলেছিল৷ যা সিরিয়া সরকার মানেনি বলেই আলেপ্পো আজ মুক্ত৷ সিরিয়ান ফ্রি প্রেস নেটওয়ার্কের মতে এই মুহূর্তে সিরিয়ার ৮৫ শতাংশ এলাকা সরকারি বাহিনীর দখলে এবং সেখান থেকে মানুষের পালানো, শরণার্থীর ঢল নামার মতো ঘটনাও অনেক কমে গেছে৷ একটু খুঁটিয়ে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে বিবিসি, সিএনএন, আল জাজিরার মতো টেলিভিশন চ্যানেলগুলিতে দেখানো পূর্ব–ঘোউটার তথাকথিত ‘সরাসরি সম্প্রচারিত’ ছবির অনেকগুলিই আলেপ্পো বা অন্য শহরে বহু আগে তোলা৷ এই প্রশ্নও উঠছে, ক্লোরিন গ্যাস আক্রমণ বলে যে ছবি দেখানো হচ্ছে, তা তুলছেন এই চ্যানেলগুলির যে ক্যামেরাম্যানরা তাঁদের কিছু হচ্ছে না কেন? তাঁরা কি আগে থেকে সব জেনে গ্যাস মুখোশ ইত্যাদি নিয়ে ওখানে উপস্থিত হয়েছিলেন?
মার্কিন বন্ধু দেশ কাতারের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হামাদ বিন–জাসিম বিন–জবের আল–থানি গত বছর অক্টোবরেই এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আমেরিকা এবং তার সহযোগীরা সিরিয়ায় সক্রিয় সন্ত্রাসবাদীদের হাতে অস্ত্র সরবরাহ করে চলেছে দীর্ঘদিন ধরেই৷ ‘আমেরিকান হেরাল্ড ট্রিবিউন’ পত্রিকার সাংবাদিক স্টিভেন সাহিউনিয়ে দেখিয়েছেন, ২০১১ সালের মার্চে লিবিয়াতে হত্যালীলা চালানো খুনে বাহিনী সিরিয়ার ডেরা শহরে যে হামলা শুরু করেছিল তা জর্ডন থেকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ (দ্য ডে বিফোর ডেরা, আমেরিকান হেরাল্ড ট্রিবিউন, ১০ আগস্ট ২০১৬)৷ অথচ ২০০৯ সালের আগে বাসার আল আসাদের সঙ্গে মার্কিন–ব্রিটিশ শাসকদের এমন বিরোধ ছিল না৷ এমনকী ২০০২ সালে আসাদকে ব্রিটিশ সরকার সাম্মানিক নাইটহুড দিতে চেয়েছিল৷ কিন্তু ২০০৯ সালের পর থেকে রাশিয়াকে ঘিরে ফেলা ও ইরানের উপর আক্রমণের জন্য সিরিয়ার মাটিতে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি বানাতে দিতে আসাদের আপত্তি এবং মধ্যপ্রাচ্যের সাথে ইউরোপের স্থলপথ ও জলপথের উপর সম্পূর্ণ মার্কিন নিয়ন্ত্রণ ও ইজরায়েলের প্রশ্ণে আসাদের সাথে মার্কিন–ব্রিটিশ মতভেদের পর হঠাৎ করেই আসাদ ‘রক্তলোভী দানব’ হিসাবে মার্কিন–ব্রিটিশ প্রচারের লক্ষ্য হয়ে উঠেছেন৷
মার্কিন বিদেশ সচিব রেক্স টিলারসন ১৭ জানুয়ারি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্তৃতায় এ বিষয়ে বলেছেন, তাঁদের এখনকার উদ্দেশ্য– প্রথমত, বাসার আল আসাদের সরকারকে উচ্ছেদ করতে উত্তর সিরিয়ায় স্থায়ী মার্কিন সামরিক ঘাঁটি স্থাপন৷ দ্বিতীয়ত, সন্ত্রাসবাদীদের দখল করা এলাকাগুলিতে মার্কিন মদতপুষ্ট বাহিনীর ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা৷ তৃতীয়ত, সিরিয়াকে ভাগ করে দখলিকৃত মার্কিন এলাকায় আরও বেশি অস্থিরতা সৃষ্টি করে সিরিয়াকে অতিষ্ঠ করা৷ যার সুযোগে সিরিয়াতে মার্কিন তাঁবেদার সরকার বসানো (ইউ এস পিস কাউন্সিল ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮)৷
সিরিয়া আক্রমণকারী নয়, আক্রান্ত৷ বিশ্বের শান্তিকামী জনসাধারণকে মনে রাখতে হবে, সাম্রাজ্যবাদী প্রচারে বিভ্রান্ত হলে চরম ভুল হবে৷ যে সাম্রাজ্যবাদী দস্যুরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সিরিয়ার মানুষের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে হাজার হাজার মৃত্যুর জন্য দায়ী তারাই৷ প্রতিটি শিশুর মৃত্যু, অমূল্য প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন ধ্বংসের জন্য কাঠগড়ায় তুলতে হবে তাদেরই৷