বাংলাদেশ জুড়ে বিদ্যাসাগর বহু বিদ্যালয় খুলেছিলেন। তার একটা বড় অংশই ছিল মেয়েদের জন্য। যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে অনেক জায়গাতেই ব্রিটিশ সরকার বরাদ্দ বন্ধ করে দিলে তাঁকে পায়ে হেঁটে যেতে হয়েছিল। বহু বিদ্যালয়ের জন্য তিনি নিজে অর্থসাহায্য করতেন। জ্যোতিরাও ফুলে মহারাষ্টে্র দলিত সম্প্রদায়ের জন্য বিদ্যালয় খুলেছিলেন। এ রকম একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষিকা রূপে পড়াতে গিয়ে প্রত্যহ নিগ্রহের় শিকার হতেন সাবিত্রী বাঈ ফুলে। বঙ্গভঙ্গের় সময় ইংরেজের শিক্ষাব্যস্থাকে প্রত্যাখান করে যখন এ দেশে ‘জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন’ সম্প্রসারিত হয়েছিল, তখন সেই আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্বরা বহু বিদ্যালয় প্রবর্তন করেছিলেন। সে ভাবেই গোড়াপত্তন হয়েছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই শিক্ষা আন্দোলনের জন্য অর্থ দান করে সুবোধ মল্লিক ‘রাজা’ উপাধি লাভ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে খুলেছিলেন প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র। তাঁর আহ্বানে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা সেই শিক্ষাকেন্দ্রে পড়িয়েছেন। বেগম রোকেয়া কলকাতায় স্থাপন করেছিলেন মুসলিম মেয়েদের জন্য স্কুল। বাধা কম ছিল না। কিন্তু সেই বাধা উপেক্ষা করে তিনি এগিয়ে গিয়েছিলেন। এইভাবে কেবল বাংলায় বা মহারাষ্টে্র নয়, সমগ্র দেশে মানুষের অর্থসাহায্যে, মানুষের দান করা জমিতে গড়ে উঠেছিল শত শত, হাজার হাজার স্কুল। কিন্তু ‘বিশ্বায়নের যুগে’ শিক্ষা যখন আজ পণ্য, তখন সরকারের লক্ষ্যই হল সেই স্কুলগুলি তুলে দিয়ে বেসরকারি স্কুল – তথা বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা। আর তাই গোটা দেশে নিঃশব্দে স্কুল বন্ধের আয়োজন চলছে।
‘র্যাশানালাইজেশন’-এর নামে কোথাও কয়েকটি স্কুলকে সংযুক্ত (মার্জ) করে একটা স্কুলে পরিণত করা হচ্ছে কোথাও বা বিকল্প কোনও ব্যবস্থা না রেখেই সম্পূর্ণ স্কুলটাকেই বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। ২০১৭ সালে ভারত সরকারের ‘নীতি আয়োগ’ মধ্যপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড এবং ওড়িশায় ‘সাস্টেই×নেবল অ্যাকশন ফর ট্রান্সফর্মিং হিউম্যান ক্যাপিটল– এডুকেশন’ (সাথি-ই) নামে একটি প্রকল্প চালু করে। তার ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল রাজ্যগুলির প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থায় ‘যৌক্তিককরণ ও সংহতিকরণ’-এর মাধ্যমে পরিমাণগত ও গুণগত পরিবর্তন ঘটানো। নীতি আয়োগের বক্তব্য, ভারতের গড়পড়তা বিদ্যালয়ে ৫০-৬০ জন করে ছাত্রছাত্রী এবং এক-দুজন করে শিক্ষক-শিক্ষিকা রয়েছেন। সেখানে বেসরকারি বিদ্যালয়ে আছে গড়ে ২৬৫ জন ছাত্রছাত্রী এবং ৯ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা। তাদের তথ্য অনুসারে, দেশের চার লক্ষ বিদ্যালয়ে ৫০ জনের কম ছাত্রছাত্রী এবং মাত্র একজন বা দুই জন শিক্ষক-শিক্ষিকা আছেন। সেই শিক্ষকদের আবার প্রধান শিক্ষকের অভাবে নানা প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতে হয় এবং তার ফলে লেখাপড়ার কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। তাদের মতে এর একমাত্র সমাধান হল, কয়েকটি বিদ্যালয়কে সংযুক্ত করা (মার্জার)।
নয়া জাতীয় শিক্ষানীতিতেও বলা হয়েছে, ভারতের ২৮ শতাংশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এবং ১৪.৮ শতাংশ উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩০ জনের কম ছাত্রছাত্রী রয়েছে। দেশের প্রাথমিক এবং উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে এক একটি শ্রেণি বা গ্রেডে গড়ে ১৪ জন করে ছাত্রছাত্রী আছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ৬ জনের কম আছে। দেশের ১,০৮,০১৭টি বিদ্যালয়ে শিক্ষকের সংখ্যা মাত্র একজন, এদের মধ্যে ৮৫,৭৪৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। (সূত্র এনইপি ২০২০/৭.১) জাতীয় শিক্ষানীতির বক্তব্য হল, ওই শিক্ষকদের অনেককেই একসাথে বিভিন্ন শ্রেণিকে পড়াতে হয়, বিভিন্ন বিষয়ে পড়াতে হয়, এমনকি দক্ষতা নেই এমন বিশেষ কিছু বিষয় যথা সঙ্গীত, কলা, অঙ্কন, ক্রীড়া ইত্যাদি বিষয়ও শেখাতে হয়। ওই বিদ্যালয়গুলির অনেকগুলিতেই খেলার মাঠ বা পরীক্ষাগার নেই। (সূত্র এনইপি ২০২০/৭.৬) তাই তাদেরও পরামর্শ একটি বড় মাধ্যমিক বিদ্যালয় যার পরিকাঠামো আছে তার পাঁচ-দশ কিলোমিটারের মধ্যে পরিকাঠামোহীন অন্য সকল বিদ্যালয় এমনকি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলিকেও সংযুক্ত (মার্জ) করা। (সূত্র: ঐ)
৯ আগস্ট, ২০১৫ ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে দেশে ৮০,৬৪৭টি বিদ্যালয় হয় মার্জ করানো হয়েছে, অথবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে রাজস্থানে ১৭,১২৯, গুজরাতে ১৩,৪৫০, কর্নাটকে ১২,০০০, অন্ধ্রপ্রদেশে ৫৫৩০, ওড়িশায় ৫০০০, তেলেঙ্গানায় ৩০০০, মধ্যপ্রদেশে ৩৫০০, তামিলনাড়ুতে ৩০০০, উত্তরাখণ্ডে ১২,০০০, পাঞ্জাবে ১১৭০ এবং ছত্তিশগড়ে ৭৯০টি বিদ্যালয় এভাবে বন্ধ করা হয়েছে।
২০১৭-১৮ থেকে ২০২১-২২ সাল পর্যন্ত তুলনায় দেখা যাচ্ছে সারা দেশে ৭২,১৫৭টি (-৬.৫৯ শতাংশ) সরকারি বিদ্যালয় মার্জ করা হয়েছে বা পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে উত্তরপ্রদেশে ১৭,২৩২টি, আসামে ৯,২১৯টি, কর্নাটকে ৬২৬টি, কেরালায় ৭৭৩টি, অন্ধ্রপ্রদেশে ১৬৮৫টি, গুজরাতে ২৯০টি, পশ্চিমবঙ্গে ৩২৩০টি, এবং রাজধানী দিল্লিতেও ২৯০টি স্কুল রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে ৮২০৭টি স্কুল বন্ধের নোটিস দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকগুলিই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কোথাও আবার গণপ্রতিরোধে সরকার কিছুটা পিছিয়ে এসেছে।
কিন্তু বিদ্যালয়গুলিতে ছাত্র সংখ্যা কমছে কেন? না, এর কারণগুলি কোথাও বলা নেই জাতীয় শিক্ষানীতিতে। বলা ভাল, কারণগুলিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে বা সযত্নে গোপন করা হয়েছে। না হলে এই সত্য প্রকাশ্যে এসে যেত যে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলির পরিকল্পিত অবহেলার মধ্য দিয়ে এক দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলা হয়েছে। অর্থাৎ লাগাতার অবহেলার মধ্য দিয়ে প্রথমে স্কুল শিক্ষা-ব্যবস্থাকে দুর্বল করা হয়েছে, তারপর সেই দুর্বলতাকে কারণ হিসাবে দেখিয়ে সেগুলি বন্ধ কিংবা সংযুক্তিকরণ ঘটানো চলছে। কেন এতবড় একটা সর্বনাশ ঘটিয়ে চলেছে সরকারগুলি? কারণ এই সব সরকারগুলিই পরিচালিত হচ্ছে পুঁজিবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী শিক্ষা আজ আর রাষ্টে্রর দায়িত্ব নয়, ব্যবসার পণ্য। পুঁজিপতিদের শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা করার সুযোগ করে দেওয়ার জন্যই সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করছে তারা। এই পরিকল্পনারই নকশা হল জাতীয় জাতীয় শিক্ষানীতি। এই পরিকল্পনা মতোই তার়া সরকারি স্কুল থেকে পাশফেল তুলে দিয়েছে। সিলেবাস পরিবর্তন করে মানের অবনমন ঘটানো হয়েছে। দ্বিতীয়ত, উপযুক্ত সংখ্যক শিক্ষক নেই। তৃতীয়ত, পরিকাঠামো অতি দুর্বল। ক্লাস শুরু হওয়ার পর কয়েক মাস কেটে যায় সরকারি পাঠ্যবই পেতে। ক্লাসরুম নেই, ব্ল্যাকবোর্ড নেই, লাইব্রেরি নেই, খেলার মাঠ নেই, ভালো মানের শৌচাগার নেই, পানীয় জলের সুব্যবস্থা নেই। চতুর্থত, মাত্রাতিরিক্ত ছুটি। কোভিড মহামারী বা গরমের ছুটিতে স্কুল বন্ধের সময় অনলাইন শিক্ষা বা বিকল্প শিক্ষার ব্যবস্থা নেই। পঞ্চমত, নির্বাচন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় দীর্ঘকাল বিদ্যালয় ভবন সরকারি অধিগ্রহণে থাকার ফলে স্কুল বন্ধ থাকে। এর ফল কী? সরকারি স্কুলে যেহেতু আর পড়াশোনা হয় না, তাই এই সব স্কুলে সম্পর্কে অভিভাবকদের আস্থাও তলানিতে চলে গেছে। একজন দরিদ্র-নিম্নবিত্ত মানুষও চান তাঁর সন্তান লেখাপড়া শিখে মানুষ হোক এবং পরিবারের দুর্দশা দূর করুক, এই ভাবনা থেকে তাঁরা কষ্ট করে হলেও বেসরকারি স্কুলে সন্তানদের নিয়ে যাচ্ছেন। এসব কারণে গ্র্রামে এবং শহরে অভিভাবকরা বাধ্য হয়ে বেসরকারি স্কুলে নিজেদের ছেলেমেয়েদের ভর্তি করছেন। আর সেই অজুহাতে সরকার ছাত্রসংখ্যা কম দেখিয়ে স্কুল বন্ধ করছে।
জাতীয় শিক্ষানীতির মাধ্যমে শিক্ষাক্ষত্রে এই ভয়ঙ্কর আক্রমণের বিরুদ্ধে দেশের ছাত্রসমাজ সোচ্চার হবে নয়াদিল্লিতে দশম সর্বভারতীয় ছাত্র সম্মেলনে। ছাত্র সংগঠন এআইডিএসও-র আহ্বানে আগামী ২৭-২৯ জুন দিল্লির তালকাটোরা স্টেডিয়ামে (শহিদ উধম সিং নগর) এই ছাত্র সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে।