আবার উত্তপ্ত প্যালেস্তাইন। আবার সংঘর্ষ– যার একদিকে অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ইজরায়েলি সেনাবাহিনী, অন্যদিকে সাধারণভাবে নিরস্ত্র প্যালেস্তিনীয় জনগণ, ইট ও পাথর ব্যতীত অস্ত্র বলতে যাদের হাতে আর কিছুই নেই এবং তাদের হয়ে হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়া হামাস যোদ্ধারা। অস্ত্র বলতে তাদের হাতেও সামান্য কিছু হাতে তৈরি রকেট– ইজরায়েলি অত্যাধুনিক অস্ত্রসম্ভারের সাথে যার কোনও তুলনাই চলে না। তবু এরই নাম দেওয়া হয়েছে যুদ্ধ। হামাসের পক্ষ থেকে ছোঁড়া রকেটসম্ভারের ছবি প্রচারিত হয়েছে বিশ্ব জুড়ে টিভিতে, খবরের কাগজে। ১১ দিনের সংঘর্ষে সাধারণ মানুষের প্রাণহানি, ক্ষয়ক্ষতির কথাও প্রচার পেয়েছে মেনস্ট্রিম মিডিয়ায়। যেটা প্রচারের আলো থেকে দূরেই থেকে গেছে তা হল, ইজরায়েলি সেনার শতগুণ শক্তিশালী আক্রমণের ছবি, শরণার্থীতে গিজগিজ করতে থাকা ফিতের মতো সরু গাজা স্ট্রিপে ইজরায়েলি সেনার বিমান হানা, অন্তত ৯৫০টি লক্ষ্যবস্তু গুঁড়িয়ে যাওয়ার ছবি, যার মধ্যে রয়েছে অন্তত ৪টি বহুতল আবাসিক বাডি, ৪০টি স্কুল, ৪টি হাসপাতাল। হ্যাঁ, ইজরায়েলি পক্ষেও হামাসের ছোঁড়া রকেট আক্রমণে মারা গেছে ১৩ জন– আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কল্যাণে সে কথা আমাদের জানতে বাকি নেই কারওরই। কিন্তু নজরের অনেকটাই আড়ালে যেটা রয়ে গেছে তা হল, প্যালেস্তিনীয় পক্ষেও মৃত্যুর সংখ্যা অন্তত ২৫৪ জন, যার মধ্যে ৬৬ জনই শিশু। আহত অন্তত ১৯০০ মানুষ, ঘরবাড়ি হারানো নতুন উদ্বাস্তুর সংখ্যা ৭২,০০০। না, এই নিহত, আহত, ঘরবাড়ি হারানো মানুষগুলো কেউই কিন্তু হামাসের যোদ্ধা নয়, নিতান্তই সাধারণ মানুষ।
জিওনাবাদীদের অন্যায় আক্রমণ
এবারের ঘটনার সূচনা শেখ জারা এলাকাতে। পূর্ব জেরুজালেম থেকে মাত্র ২ কিলোমিটার উত্তরে এটি একটি ছোট্ট পাড়া মাত্র। যদিও তার ইতিহাস সুপ্রাচীন। দ্বাদশ শতব্দীতে সুলতান সালাদিনের ব্যক্তিগত চিকিৎসক শেখ জাররাহ’র বাড়ি ছিল এই এলাকাতে। তাঁর কবরস্থলও এখানেই অবস্থিত। সেই থেকেই এলাকাটির নাম শেখ জারা। মিশ্র বসতিপূর্ণ জেরুজালেম শহরের এই অংশটিতে চিরকালই আরব মুসলমান জনসংখ্যারই সংখ্যাধিক্য। এমনকি উনবিংশ শতাব্দীতে অটোমান সুলতানদের আমলের জনগণনাতেও দেখা যায় এর সত্যতা। ১৯৪৮ সালে ইজরায়েল গঠনের পর আরব-ইজরায়েল যুদ্ধে এই অঞ্চল চলে যায় জেরুজালেম শহরের পূর্ব অংশের সাথে জর্ডনের হাতে। সেইসময় ইজরায়েল থেকে যে লক্ষ লক্ষ প্যালেস্তিনীয়কে উচ্ছেদ করে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়, তাদের একাংশের পুনর্বাসনের জন্য ১৯৫৬ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দপ্তরের পূর্ণ সহযোগিতাতেই এই অঞ্চলে জর্ডন সরকারের আনুকূল্যে গড়ে তোলা হয় উদ্বাস্তু কলোনি।
কিন্তু ইজরায়েল অধিকৃত পিচম জেরুজালেম এবং প্যালেস্তিনীয় অধ্যুষিত পূর্ব জেরুজালেম-এর মধ্যে বিভেদ রেখাটিও গেছে এই অঞ্চলের মধ্য দিয়েই। ফলে ১৯৬৭-র যুদ্ধে ইজরায়েল জর্ডন নদীর সম্পূর্ণ পিচম তীর (ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক) এলাকা নিজেদের দখলে নিয়ে আসার পর থেকেই ছলে-বলে -কৌশলে এই অঞ্চলে নিজেদের আধিপত্য কায়েমে উদ্যোগী হয়ে ওঠে। ১৯৭০ সালেই ইজরায়েল একটি নতুন আইন তৈরি করে, যাতে বলা হয় পূর্ব জেরুজালেমে জর্ডন সরকার যেসব জায়গায় উদ্বাস্তুদের বসতি স্থাপন করেছে, সেখানকার জমির আইনি হস্তান্তরের দলিল কেউ না দেখাতে পারলে সেখানে তাদের দখলীসত্ত্ব স্বীকৃত হবে না। পুরনো দলিল দেখাতে পারলে যে কেউই সেখানকার জমি পুনর্দখল করতে পারবে। স্বাভাবিকভাবেই এই নতুন আইনের পূর্ণ সুযোগ নিতে উগ্র ইহুদিবাদী জিওনিস্ট গোষ্ঠীগুলি ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১৯৭২ সালে ইজরায়েলি কাস্টডিয়ান জেনারেল এই অঞ্চলের বেশিরভাগ সম্পত্তিই বিভিন্ন ইহুদি ট্রাস্টের মালিকানাধীন বলে রেজিস্ট্রি করে। তারপর থেকেই এইসব ইজরায়েলি ট্রাস্টগুলি এই অঞ্চলের বিভিন্ন অংশের উপর নিজেদের মালিকানা দাবি করতে শুরু করে ও অধিবাসীদের কাছ থেকে বসবাসের জন্য ভাড়া দাবি করতে শুরু করে। অন্যদিকে ইজরায়েলি আদালতও এই অঞ্চলের জমিবাড়ির মালিকানা সংক্রান্ত বিভিন্ন পুরোনো দলিল, যা অটোমান আমলের রাজধানী ইস্তানবুলে সংরক্ষিত আছে, তা অস্বীকার করে ইহুদি ট্রাস্টগুলির পক্ষেই রায় দিতে শুরু করে। এইভাবে এখানকার বহু প্যালেস্তিনীয় সাধারণ নাগরিক উচ্ছেদ হতে থাকে এবং তার বদলে বাইরে থেকে আসা ইজরায়েলি ইহুদি সেটলারদের উপনিবেশ গড়ে উঠতে শুরু করে। এইভাবেই ২০০১ সালে এই অঞ্চলের বিখ্যাত আল-কুর্দ পরিবারের বাড়িও দখল করে তার অধিবাসীদের উচ্ছেদ করে তুলে দেওয়া হয় ইহুদি সেটলারদের হাতে। Øনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত এই পরিবারের তৎকালীন প্রধান, মাথার উপর ছাদহীন অবস্থায় তার ১১ দিন পরে প্রাণ হারান। ঐতিহাসিক পরিবারগুলিরই যেখানে এই অবস্থা, ১৯৪৮-এর পরে স্থাপিত বসতিতে বসবাসকারী সাধারণ মানুষের অবস্থা তো সেখানে সহজেই অনুমেয়। অসংখ্য পরিবার সেখানে ইতিমধ্যেই এইভাবে আইনি পথে উচ্ছেদের শিকার হয়ে আক্ষরিক অর্থেই গৃহহীনে পরিণত। এই অবস্থায় আগুনে ঘৃতাহুতির কাজ করে ইজরায়েলি শীর্ষ আদালতে বিচারাধীন আরেকটি মামলার রায় দান। প্যালেস্তিনীয়দের আশঙ্কা, এর ফলে নতুন করে ৫৭টি আবাসনের আরও অন্তত ৭৫টি পরিবার উদ্বাস্তুতে পরিণত হতে চলেছে। স্বাভাবিকভাবেই রায়দানের আগে থেকেই সমগ্র এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।
অন্যদিকে বিষয়টি নিয়ে প্যালেস্তিনীয় কর্তৃপক্ষের বক্তব্য খুবই পরিষ্কার। এমনকি রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার কমিটিও তাদের দাবিকেই মান্যতা দিয়েছে। তাদের বক্তব্য হল, শেখ জারা সহ পূর্ব জেরুজালেম বাস্তবে ইজরায়েলের বেআইনি দখলীকৃত এলাকা। ইজরায়েলের বৈধ সীমানার বাইরে তার অবস্থান। তাই সেখানে ইজরায়েলের আইন কার্যকরী হতে পারে না। আর জমিবাড়ির মালিকানা সংক্রান্ত পুরোনো সমস্ত দলিল, যা ইস্তানবুলের লেখ্যাগারে সংরক্ষিত, তাকেও মান্যতা দেওয়া উচিত। যাই হোক, এবারের মামলার রায়দানের দিন ছিল ৯ মে, যার ফলে উপরোক্ত পরিবারগুলির মধ্যে অন্তত ৬টি পরিবার এখনই সরাসরি উচ্ছেদের শিকার হবে। তার আগেই ৬ মে পূর্ব জেরুজালেমে এই সম্ভাব্য রায়ের বিরুদ্ধে প্যালেস্তিনীয়রা বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করলে ইজরায়েলি পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে তাদের উপর আক্রমণ চালায়, ফলে উত্তেজনা ছড়াতে থাকে। এরপরে, ইজরায়েলি মিডিয়ার খবর অনুযায়ী, ৭ মে ইজরায়েলি পুলিশের উপর নাকি প্যালেস্তিনীয় পক্ষ থেকে আক্রমণ চালানো হয় (যদিও সেই আক্রমণের অস্ত্র হিসেবে কিছু ভাঙা ইটের টুকরো ব্যতীত কিছু তুলে ধরা ইজরায়েলি সংবাদমাধ্যমের পক্ষেও সম্ভব হয়নি)। কিন্তু সেই আক্রমণ দমন করতেই পাল্টা প্রতি আক্রমণে যেতে নাকি বাধ্য হয় ইজরায়েলি পুলিশ। এবং তা করতে গিয়ে তারা কাছেই থাকা বিখ্যাত আল আকসা মসজিদ এবং তার পার্শ্ববর্তী একটি ক্লিনিকে গ্রেনেড ছোঁড়ে। আল আকসা মসজিদে তখন ইদের আগের শেষ শুক্রবারের নমাজে অন্তত ৭০ হাজার মানুষের ভিড়। ফলে এই গ্রেনেড হামলায় ৩০০-রও বেশি মানুষ আহত হয়। এর পর থেকেই পুরো এলাকাই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। প্যালেস্তিনীয় তরুণ-কিশোররা ইট পাথর ছুঁড়ে প্রতিরোধে নামে। আর অন্যদিকে ইজরায়েলি পুলিশ কাঁদানে গ্যাস, জলকামান, রবার বুলেট থেকে শুরু করে গ্রেনেড পর্যন্ত সবই যথেচ্ছ ব্যবহার করতে শুরু করে। পরদিন ৮ মে প্যালেস্তিনীয়রা দীর্ঘদিন ধরেই জেরুজালেমের উপর তাদেরও অধিকার দাবি করে জেরুজালেম দিবস পালন করে। সেই মিছিলের উপরও পুলিশের হামলা চলে। আহতের সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় ৬০০-রও বেশি, যার মধ্যে অন্তত ৪০০ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। এরই প্রতিরোধে হামাসের পক্ষ থেকে পরদিন রাতে প্রথম রকেট হামলা চালানো হয়।
উত্তেজনা বাড়তেই থাকে। ১০ মে দ্বিতীয়বার ইজরায়েলি পুলিশ আল আকসা মসজিদ ও সংলগ্ন এলাকা খালি করতে অভিযান চালায়। প্যালেস্তিনীয় পক্ষ থেকেও সাধ্যমতো প্রতিরোধ করা হয়। ফলে অন্তত ৩০০ পালেস্তিনীয় সাধারণ নাগরিক আহত হয়। অন্যদিকে ২১ জন ইজরায়েলি পুলিশও অল্পবিস্তর আহত হয়। প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে অন্যত্রও। পিচম তীরের অন্তত ২০০ জায়গায় বিক্ষোভ হয়। ইজরায়েলি পুলিশ ও সেনাবাহিনীও অত্যন্ত কঠোর হাতে সেই বিক্ষোভ দমন করতে অভিযান চালায়, যার ফলে অন্তত ১১ জন বিক্ষোভকারীর মৃত্যু ঘটে। ইজরায়েলি পক্ষে অবশ্য প্রাণহানি শূন্য। হামাসের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ১০ মে সন্ধে ৬টার মধ্যে ইজরায়েলি দখলদারী সৈন্যদের শেখ জারা ছেড়ে সরে যেতে হবে। উল্লিখিত সময়সীমা পেরিয়ে গেলে তাদের পক্ষ থেকে দ্বিতীয়বার রকেট হামলা চালানো হয়, এবার গাজা থেকে। ইজরায়েলি সেনার দাবি মোট ১৫০টির মতো রকেট হামলা হয় তাদের উপর। এরপরেই ইজরায়েলি সেনা গাজা লক্ষ করে শুরু করে দেয় সরাসরি কামান থেকে গোলাবর্ষণ ও বিমানহানা। ফলাফল আগেই বর্ণিত।
ইহুদিরা আজ আর কোনও বিশেষ জনগোষ্ঠী নয়
ইজরায়েলি সাম্রাজ্যবাদের চরিত্র অবশ্য এমনই– দেশ হিসেবে তার জন্মলগ্ন থেকেই, বা বলা ভালো তারও আগে থেকেই। ১৮৯০-এর দশকেই ইহুদিবাদী কিছু বুদ্ধিজীবী মধ্যপ্রাচ্যের এই অংশে বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট এবং অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের উপর ভিত্তি করে এই অঞ্চলে ইহুদিদের জন্য একটি দেশ তৈরি করার পরিকল্পনা করতে শুরু করে। কিন্তু তাদের দাবি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে একেবারে প্রথম থেকেই। কারণ ইহুদি বলতে আজ থেকে দু’হাজার বছর আগে একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীকে বোঝালেও, বর্তমানে ইহুদি একটি ধর্ম সম্প্রদায় মাত্র, যারা ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। কোনও বিশেষ জনগোষ্ঠী নয়, বরং দু’হাজার বছর আগে বর্তমান প্যালেস্তাইন অঞ্চলে বসবাসকারী যে জনগোষ্ঠী ইহুদি নামে পরিচিত ছিল, তারাই দীর্ঘ এই দু’হাজার বছরে ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁকের মধ্য দিয়ে এসে ওখানে ধর্মীয় অর্থে এক মিশ্র জনগোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটিয়েছে। প্রথমে রোমান এবং তারপরে পূর্ব রোমান বা বাইজান্টিয়াম সাম্রাজ্যের অধীন থাকাকালীন এই অঞ্চলে খ্রিস্টধর্ম বিস্তারলাভ করে। পরে ইসলামিক সম্প্রসারণের সময় এই অঞ্চল আরব মিলিট্যান্ত ধর্ম প্রচারকদের অধীনে চলে গেলে জনসংখ্যার এক বিরাট অংশ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। পরে আবার এই অঞ্চলেই জেরুজালেম পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে দ্বিতীয় সহস্রাব্দের প্রথম কয়েক শতকে পরিচালিত হয় ধর্মযুদ্ধ বা ত্রুসেড। এইসময় ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, ইংল্যান্ড এবং ইউরোপের বিভিন্ন অংশ থেকে আসা ধর্মযোদ্ধা ও প্রচারকদের প্রভাবে আবার একধরনের খ্রিস্টীয় প্রাতিষ্ঠানিক ঐতিহ্যও পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ১৪৯২ সালে স্পেনে গ্রানাদা ও আল আন্দালুস থেকে আগের মুসলমান মুর শাসকরা রেকনকিস্তার ধাক্কায় বিতাড়িত হলে সেখানে তাদের আশ্রিত কয়েক লক্ষ মানুষের ইহুদি জনগোষ্ঠীও পুরোপুরি বিতাড়িত হয়। পিচম ইউরোপীয় ও মুর জনগোষ্ঠীর ইহুদিরাও সেসময় এই প্যালেস্তাইন অঞ্চলের উদার মুসলমান শাসকদের বদান্যতায় সেখানেই আশ্রয় পায়। ষোড়শ শতব্দীতে সাইপ্রাস থেকে পর্তুগিজভাষী ইহুদিদের একটা অংশও অটোমান সুলতানদের ঔদার্যে এই অঞ্চলে আশ্রয় লাভ করে। ফলে স্বভাবতই এই অঞ্চলে গড়ে ওঠে এক মিশ্র সংস্কৃতি।
ইহুদি রাষ্ট্র গড়ে তোলার পিছনে মদত ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের
অন্যদিকে আজকের কট্টর জিওনবাদী মতবাদের জন্ম কিন্তু মধ্য ইউরোপে ১৮৯০-এর দশকে। অস্ট্রীয় সাংবাদিক টেওডোর হাৎর্সল ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘‘ড্যের ইউডেনস্টাট” নামক জার্মান ভাষায় লিখিত বইতে প্রথম একটি ইহুদি রাষ্ট্রের দাবি তোলেন। লক্ষ্য ছিল, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা এবং স্বভাবতই বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের একত্রিত করে ইহুদি ধর্মীয় মতে ঐতিহ্যশালী প্যালেস্তাইন অঞ্চলে সম্পূর্ণরূপে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গড়ে তোলা। প্রথম দিকে তাঁর এই বক্তব্য স্বভাবতই বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীতে বিভক্ত ইউরোপীয় ইহুদিদের কাছে মনে খুব একটা দাগ কাটেনি। যদিও সেইসময় থেকেই বিশেষত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের একটা অংশ তাদের পিছনে দাঁড়াতে শুরু করে। তাদের মদতেই জিওনিস্টদের সংগৃহীত ফান্ড ইউডিশে কলোনিয়ালোবাঙ্কের প্রত্যক্ষ ইনভেস্টমেন্টে ১৯০২-০৩ সালে আজকের প্যালেস্তাইনের জাফাতে প্রতিষ্ঠিত হয় অ্যাংলো-প্যালেস্তিনিয়ান ব্যাঙ্ক (সেন ইয়ারে সিওনিসমুস, ডি ভেল্ট, কলোন, ১৯০৬, পৃঃ-১৯)। লক্ষ্য ছিল তাদের ভবিষ্যতের পরিকল্পিত ইজরায়েল রাষ্ট্রে ইহুদি মালিকানায় কৃষি ও শিল্পের বিকাশ ঘটানো ও পরিকাঠামো গড়ে তোলা। ১৯১৭ সালে বালফোর ডিক্ল্যারেশনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ সরাসরিই প্যালেস্তাইনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে মুখ খোলে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পরিস্থিতি কিছুটা পালটায়। এই অঞ্চলের অধিকার সেইসময় অটোমান তুর্কিদের কাছ থেকে চলে যায় ব্রিটিশদের হাতে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সাথে হাত মিলিয়ে এইসময়েই ইউরোপের ধনী ইহুদিদের একটা অংশ এই অঞ্চলে জমি কিনে চলে আসতে শুর়ু করে। অন্যদিকে রাশিয়ায় বিপ্লবের ফলে সে দেশ থেকে প্রতিক্রিয়াশীল ইহুদি ব্যবসায়ীদের যে অংশ পালিয়ে আসে, তারাও সেই সময় এখানেই ব্রিটিশদের মদতেই আশ্রয় পায়। ফলে ১৯২২ সালেই দেখা যায় এই অঞ্চলে ইহুদি জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে পৌঁছে গেছে ৮৩ হাজার ৭৯০ জনে (সার্ভে অব প্যালেস্তাইন, ১৯৪৬, ভল্যুম ১, ষষ্ঠ অধ্যায়, পৃঃ – ১৪১)। এইসময় থেকেই ধীরে ধীরে এই মূলত ইউরোপীয় ইহুদি ধনী জনগোষ্ঠী পয়সার জোরে ও ব্রিটিশের মদতে স্থানীয় অনুন্নত, প্রায় অশিক্ষিত এবং কিছুটা যাযাবর আরব ভাষাগোষ্ঠীর মানুষের কাছ থেকে সংগঠিতভাবে জমি কিনে নিতে শুরু করে। এরাই ছিল এই অঞ্চলে ইহুদি রাষ্ট্রের মূল দাবিদার, যার পিছনে স্বভাবতই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদেরও পরোক্ষ মদত ছিল। এখানে মনে রাখা দরকার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ইউরোপে অত্যাচারিত ইহুদিদের সাথে কিন্তু এদের কোনও সম্পর্ক ছিল না। বরং ইউরোপের বিভিন্ন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে ইহুদি বন্দিদের বাঁচানোর উদ্দেশ্যে এই অঞ্চলে পুনর্বাসন দেওয়ার একাধিক মরিয়া প্রস্তাবও এই সময় এই জিওনবাদীরা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে। কারণ তাদের মতে ওই সর্বস্বলুন্ঠিত, অত্যাচারিত ও দুর্বল জনগোষ্ঠী কোনও কাজের ছিল না, তাদের পরিকল্পিত জিওনবাদী শক্তিশালী রাষ্ট্রের জন্য ছিল তারা অনুপযুক্ত। ফলে ১৯৪৪ পর্যন্ত মাত্র ৫১০০০ ইউরোপীয় অত্যাচারিত ইহুদি প্যালেস্তাইনে আশ্রয় পায়। এরপরও ব্রিটিশের প্রত্যক্ষ মদতে ঠিক হয় মাসে মাত্র ১৫০০-র বেশি ইউরোপীয় উদ্বাস্তুকে সেখানে আশ্রয় দেওয়া যাবে না। ফলে ১৯৪৫-এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষপর্যন্ত সেখানে আশ্রয় জোটে আরও মাত্র ২১০০০ ইহুদির (প্যালেস্তাইন কনফারেন্স, গভর্নমেন্ট পলিসি, এইচ সি ডেব, ১৯৪৭, ভল্যুম ৪৩৩, পৃঃ – ৯৮৫-৮৬)। এখানে মনে রাখা ভালো, এইসময়ে ইউরোপে ৬০ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করা হয় এবং আরও ন্যূনতম সমপরিমাণ ইহুদি বিভিন্ন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে অবর্ণনীয় দুর্দশার মধ্যে কাটাতে বাধ্য হন।
রাষ্ট্রসংঘ পরিকল্পিত ‘দুই রাষ্ট্রনীতি‘ বিশ বাঁও জলে
যাই হোক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে সেখানে হলোকাস্টের ভয়াবহ চিত্র সামনে আসে। ফলে সারা বিশ্বের সহানুভূতি সেখানকার অত্যাচারিত ইহুদিদের প্রতি ধাবিত হয়। সেইসময় সেই সহানুভূতিকে কাজে লাগিয়েই রাষ্ট্রসংঘে ১৯৪৭ সালে প্যালেস্তাইনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রস্তাব পাশ হয়। ঠিক হয় প্যালেস্তাইনকে দু’টি ভাগে ভেঙে একটি নবগঠিত ইহুদি রাষ্ট্র তৈরি করা হবে ও সেখানকার আরবিভাষী অন্যান্যদের জন্যও থাকবে আরেকটি রাষ্ট্র। ১৯৪৭-এর ২৯ নভেম্বর রাষ্ট্রসংঘে এই প্রস্তাব পাশ হওয়ার সাথে সাথেই উল্লসিত জিওনিস্টরা স্থানীয় আরবিভাষী মানুষের উপর হিংস্র আক্রমণ চালাতে শুরু করে, যার ফলে ১৯৪৭-৪৯, এই দু’বছরের মধ্যেই অন্তত ৭,১১,০০০ প্যালেস্তিনীয় মানুষ দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয় (জেনারেল প্রোগ্রেস রিপোর্ট ও সাপ্লিমেন্টারি রিপোর্ট টু দ্য ইউনাইটেড নেশন কনসিলিয়েশন কমিশন ফর প্যালেস্তাইন, ডিসেম্বর ১১, ১৯৪৯ -অক্টোবর ২৩, ১৯৫০)। ফলে ১৯৪৮-এ ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময়ই প্যালেস্তিনীয় জনগোষ্ঠীর এক-চতুর্থাংশ পরিণত হয় উদ্বাস্তুতে। এরপর প্রথম আরব-ইজরায়েল যুদ্ধে মার্কিন-ব্রিটিশ অস্ত্র ও সাহায্যে বলীয়ান ইজরায়েল জয়লাভ করলে প্রায় সমগ্র প্যালেস্তাইন এলাকা জুড়ে তাদের রাষ্ট্রই প্রতিষ্ঠা পায়। আইন করে সেইসময়েই ইজরায়েল উদ্বাস্তু প্যালেস্তিনীয়দের দেশে ফিরে আসার সমস্ত অধিকার অস্বীকার করে। কেবল মিশরের হাতে থাকা প্যালেস্তাইনের একেবারে দক্ষিণ-পিচম অংশে সমুদ্রতীরে একটি ফিতের মতো সরু এলাকায় (গাজা) এবং জর্ডনের হাতে থাকা জর্ডন নদীর পিচম তীরস্থ একটি অঞ্চলে এই উদাস্তু প্যালেস্তিনীয়দের জন্য বসতি গড়ে ওঠে। কিন্তু ১৯৬৭-র ‘ছয় দিনের যুদ্ধে’ এই এলাকাগুলিও ইজরায়েল দখল করে নেয়। বর্তমানে এই এলাকাগুলি তাদেরই মিলিটারি অকুপেশনে রয়েছে। ফলে ১৯৪৭ সালের পরিকল্পিত দুই রাষ্ট্র সমাধান নীতি বাস্তবে বিশ বাঁও জলেই নিক্ষিপ্ত হয়েছে।
সাম্রাজ্যবাদী ইজরায়েলের সঙ্গে শাসকদের ঘনিষ্ঠতার বিরুদ্ধে ভারতের যুদ্ধবিরোধী মানুষ
আমাদের দেশেও দীর্ঘ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের ঐতিহ্য থেকে সাধারণ মানুষ চিরকালই এই ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন সমস্যায় অত্যাচারিত ও নিজস্ব রাষ্ট্রবঞ্চিত প্যালেস্তিনীয়দের পক্ষেই ছিল, যেমন ছিল সারা পৃথিবীর আপামর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শান্তিপ্রিয় জনসাধারণ। দেশের মধ্যে এই জনমতের তীব্র প্রাবল্যের ফলেই আমাদের দেশের শাসক গোষ্ঠীও দীর্ঘ কয়েক দশকব্যাপী ইজরায়েলের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করতে সক্ষম হয়নি। কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সেই সংগ্রামী ঐতিহ্যের স্মৃতি আজ আমাদের মনে সময়ের সাথে সাথে ফিকে হয়ে এসেছে। সেই সুযোগে আজ আমাদের দেশের সাম্রাজ্যবাদী শাসকগোষ্ঠীও নানা অছিলায় ইজরায়েলের সাথে সামরিকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রেই সহযোগিতা ও এমনকি যৌথ পরিকল্পনা নিয়েও চলতে শুরু করেছে। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের দীর্ঘদিনের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ঐতিহ্যের পরিপন্থী এই নির্লজ্জ নীতি থেকে সরে এসে আমাদের দেশের শাসকদের অত্যাচারিত প্যালেস্তিনীয়দের পক্ষে দাঁড়াতে বাধ্য করা– আমাদের দেশের সংগ্রামী মানুষের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। সেই লক্ষ্য তীব্র জনমত সংগঠিত করা ও আন্দোলন গড়ে তোলা তাই আজ আমাদেরও ঐতিহাসিক দায়িত্ব।