প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ গত ১২ অক্টোবর তাঁদের হিন্দুত্ববাদী ‘আইকন’ বিনায়ক দামোদর সাভারকার সম্পর্কিত একটি বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে দাবি করলেন – ‘‘বার বার বলা হয়ে থাকে যে বৃটিশ সরকারের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে সাভারকার মুক্তির আবেদন করেছিলেন। কিন্তু সত্য ঘটনা হল, তাঁর নিজের মুক্তির জন্য তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করেননি। … মহাত্মা গান্ধীর পরামর্শে তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করে মুচলেকা দিয়েছিলেন।”
রাজনাথ সিংহ দাবি করে থাকেন, তের বছর বয়স থেকে তাঁর নাকি আরএসএস-এর সঙ্গে সম্পর্ক। ফলে তিনি কতটা হিন্দুত্ববাদী তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রাজনাথ সিংহরা সাভারকারের ‘বীরত্ব’ তুলে ধরতে তার নামের আগে ‘বীর’ বিশেষণটি আরোপ করেন। আর যখনই তাকে ‘বীর’ বলে উল্লেখ করেন, তখনই কতগুলো প্রশ্ন তাঁদের দিকে ধেয়ে আসে। প্রশ্ন আসে, তিনি কেমন বীর যিনি ব্রিটিশ সরকারের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে আন্দামানে সেলুলার জেলে যাওয়ার দু’মাস পর থেকেই মোট পাঁচ পাঁচটি ‘মার্সি পিটিশন’ তথা ক্ষমা প্রার্থনার চিঠি দিয়ে বিশ্বরেকর্ড করেছেন! প্রশ্নটা রাজনাথ সিংহদের কাছে একটা বড় বিড়ম্বনা। এই বিড়ম্বনা কাটাতে এতদিন তাঁরা কম চেষ্টা করেননি। তাঁদের এক একজন নেতা একেকভাবে সেইসব মার্সি পিটিশনের কারণ ব্যাখ্যা করতেন। তাদের অনেক নেতাই এমনকি সমাজ-মাধ্যমেও সেসব ব্যাখ্যা গত কয়েক বছরে পোস্ট করেছেন, যা যে-কেউই এখনও দেখতে পাবেন। সে-সব ব্যাখ্যা কী? কেউ লিখেছেন, ‘ওটা ছিল সাভারকারের কৌশল। কারণ তিনি ছিলেন খুবই বুদ্ধিমান। যখন বুঝতে পেরেছিলেন যে ব্রিটিশরা তাঁকে কিছুতেই ছাড়বে না, তখন সেই কৌশল অবলম্বন করে তিনি বাইরে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন।’ প্রশ্ন আসে, তাই বলে মার্সি পিটিশন! এ তো কাপুরুষতা! সাভারকারের ভক্তরা কেউ কেউ এই সমালোচকদের পাল্টা বলে থাকেন, ‘আগে কালাপানি পার হয়ে আন্দামানের জেলের কুঠুরিতে ক’দিন থাকুন, তারপর সাভারকারের সমালোচনা করবেন।’ আর তক্ষুনি প্রশ্ন ধেয়ে আসে, সাভারকার তা হলে ‘বীর’ রইলেন কী করে? ফলে সাভারকারের বার বার মার্সি পিটিশন দেওয়া, আর তিনি কত ব্রিটিশের অনুগত হয়ে থাকতে চান তার বর্ণনা দেওয়া দরখাস্তগুলি সাভারকারকে কিছুতেই ‘বীর’ বলে প্রতিষ্ঠা দিচ্ছিল না। বরং সেলুলার জেল বা অন্যান্য জেলে অন্যান্য স্বাধীনতা সংগ্রামীরা যে চরম অত্যাচার সহ্য করেও ব্রিটিশের কাছে এতটুকু মাথা নোয়াননি সেই তথ্যই বার বার উঠে এসেছে এবং তাঁদের তুলনায় সাভারকারকে একজন বীর তো নয়ই, বরং অত্যাচারের ভয়ে চরম ভীত একজন বলেই মনে হয়েছে।
ইদানিং দেখা যাচ্ছে, সাভারকারের ‘বীরত্ব’ রক্ষা করার জন্য আরএসএস এক নতুন পথ বেছে নিয়েছে। তাদের কিছু লেখক, সাভারকারের মুচলেকা-পত্রের সংখ্যা ও সাল-তারিখ উল্লেখ না করে, গান্ধীজির ১৯২০ সালে একটি চিঠি এবং ‘ইয়ং ইণ্ডিয়া’ পত্রিকায় গান্ধীজির একটি লেখাকে বিকৃত করে এবং নিজেদের মনমতো ব্যাখ্যা করে বইপত্র লিখছেন। তেমনই একজন লেখক হলেন বিক্রম সম্পথ। সেই বইকেই আবার ‘রেফারেন্স’ হিসাবে ব্যবহার করে রাজনাথ সিংহরা তাঁদের বত্তৃতা সাজাচ্ছেন এবং পরিবেশন করছেন। সবাই জানেন গান্ধীজি ছিলেন একজন অহিংসবাদী নেতা। তাই, যে অভিযোগে সাভারকারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, সেই কাজকে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর সমর্থন করার কথা নয়। কিন্তু যখন সাভারকার জানিয়েছেন যে তিনি আর স্বাধীনতা আন্দোলনের কোনও কর্মসূচিতেই থাকবেন না, বরং সরকারকেই সাহায্য করবেন, তখন গান্ধীজি জেলবন্দি সাভারকারের সশস্ত্র সংগ্রাম পরিত্যাগ করা এবং মুক্তির বিষয়়ে ‘ইয়ং ইণ্ডিয়া’ পত্রিকায় লিখেছেন। এতেও কোথাও মুচলেকা দেওয়ার পরামর্শ নেই।
ইতিহাস সম্পর্কে যাদের সামান্য ধারণা আছে তারা জানেন, গান্ধীজি ১৯১৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে ফিরে এসেছিলেন এবং অহিংস ধারায় স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু সাভারকার সেলুলার জেলে প্রেরিত হয়েছিলেন ১৯১১ সালের জুলাই মাসের শুরুতে। সেখানে দু’মাস না যেতেই ব্রিটিশ সরকারের কাছে তিনি একটি দরখাস্ত পাঠান। চিঠিটা এখন পাওয়া না গেলেও সেটার প্রাপ্তিস্বীকার যে করা হয়েছে ঐ বছর ৩০ আগস্ট, সেই তথ্য রয়েছে। ১৯১৩ সালে দ্বিতীয় ‘মার্সি পিটিশন’-এ সাভারকার প্রথম পিটিশনটির উল্লেখ করেন এবং লেখেন, I remind your honour to be so good as to go through the petition for clemency I had sent in 1911. ঐ পিটিশনেই তিনি আরও লেখেন I am ready to serve the Government in any capacity they like …. তারপর ব্রিটিশ শক্তির প্রতি ভক্তি দেখিয়ে সাভারকার লিখলেন, … the mighty alone can be merciful and therefore where else can the prodigal son return but to the parental doors of the government. এরপর ১৯১৪ সালে সাভারকার ব্রিটিশ সরকারের কাছে আরও একটি ‘মার্সি পিটিশন’ পাঠান।
এসব পিটিশন যে গান্ধীজি এ দেশে আসার আগেই লেখা হয়েছিল তারাজনাথ সিংহরা খুব ভাল করেই জানেন। সে জন্য এই প্রসঙ্গে বলার সময় সাল-তারিখ উল্লেখ করা থেকে তিনিও বিরত ছিলেন। এদেশে গান্ধীজি আসার পর ১৯১৮ এবং ১৯২০ সালেও সাভারকার মার্সি পিটিশন পাঠিয়েছিলেন। এবার দেখা যাক গান্ধীজির যে চিঠির কথা রাজনাথ সিংহরা উল্লেখ করছেন সেই চিঠিটি কোন প্রসঙ্গে। ১৯২০ সালে সাভারকারের তৃতীয় ভাই তার দুই দাদাকে জেল থেকে মুক্ত করার জন্য গান্ধীজির কাছে পরামর্শ চান। উত্তরে গান্ধীজি লিখেছিলেন, I have your letter. It is difficult to advice you. I suggest, however, your framing a brief petition setting forth the facts of the case bringing out in clear relief the fact that the offence committed by your brother was purely political. এসব কথা যে কেউই গান্ধীজির ‘কালেকটেড ওয়ার্কস’-এ দেখতে পাবেন এবং রাজনাথ সিংহের এটাও অজানা থাকার কথা নয়।
তা হলে বিষয়টা কী দাঁড়ালো? সাভারকারের ভাই গান্ধীজির কাছে পরামর্শ চাইলেন। গান্ধীজি বললেন, এমন করে পিটিশন দেওয়া হোক যে তার দাদার অপরাধের বিষয়টা পুরোপুরি রাজনৈতিক, ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য নয়। এখানে মুচলেকা দিয়ে ব্রিটিশের পক্ষে কাজ করার পরামর্শ তো কোথাও নেই। যে কোনও ভারতীয়ই স্বাধীনতা আন্দোলনে গ্রেপ্তার হয়ে ব্রিটিশের কারাগারে থাকা একজনের মুক্তিই চাইবেন, গান্ধীজিও চেয়েছিলেন। এটাই তো স্বাভাবিক। অথচ এই চিঠিটির উল্লেখ করেই স্বাধীনতা আন্দোলনে পেছন থেকে ছুরি মারার অপরাধ থেকে সাভারকারকে দোষমুক্ত করতে আজ আরএসএসের নেতারা এবং রাজনাথ সিংহ গান্ধীজির উপর তার দায় চাপিয়ে দিতে তৎপর।
শুধু মুক্তি পেতে মুচলেকা দেওয়ার বিষয়েই নয়, দেশভাগের যে দায় সাভারকারের উপর বর্তায়, সেখান থেকেও আরএসএস আজ সাভারকারকে দায়মুক্ত করতে ব্যস্ত। যে সাভারকার ১৯৩৫ সালে হিন্দু মহাসভার সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে ঘোষণা করলেন যে মুসলিম ও হিন্দু আলাদা জাতি এবং যা দিয়ে ব্রিটিশের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ বা ‘ভাগ করো এবং শাসন করো’ নীতিকেই সাহায্য করলেন এবং পরবর্তীকালে মুসলিম লিগকেও পাকিস্তানের দাবি তুলতে ইন্ধন যোগালেন, তার সম্পর্কেই উদয় মাহুরকার এবং চিরায়ু পণ্ডিত যে বই লিখেছেন, সেটা হল – ‘Veer Savarkar : The Man Who Could Have Prevented Partition’ এবং তা প্রকাশ করলেন রাজনাথ সিংহ।
স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র আন্দোলনের ‘বখাটে ছেলে’ সাভারকার জেল থেকে মুক্ত হয়ে ‘ব্রিটিশের ভাল ছেলে’ হয়ে এ দেশে হিন্দুধর্মের সাথে জাতীয়তাবাদের মিশেল দিয়ে তাকে উপস্থাপনা করা আর ভারতের ‘পূণ্যভূমিতে’ অন্য ধর্মের মানুষকে বর্জন করার বা অধস্তন রাখার পরিকল্পনাটিকেই প্রচার করতে থাকলেন। তাই তার কাছে ভারত রাষ্ট্র মানেই হিন্দুরাষ্ট্র এবং জাতি মানেই হিন্দুজাতি। সেখানে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে এ দেশ থেকে হটানোর জন্য লড়াইয়ের কোনও কথা নেই। এটাই হল সাভারকারের আদর্শ। তাই ব্রিটিশের ‘ভাগ করো এবং শাসন করো’ নীতির ক্রীড়নক হয়ে মানবজাতির প্রতি ভালবাসার বদলে জীবনভর তিনি প্রচার করে গেলেন বিদ্বেষের কথা।
এর পাশাপাশি আমরা দেখি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের বীরবিপ্লবী ক্ষুদিরাম, রামপ্রসাদ বিসমিল, আসফাকউল্লা, ভগৎ সিং, মাস্টারদা সূর্য সেন সহ স্বাধীনতা আন্দোলনের অসংখ্য সেনানীদের – যাঁরা ব্রিটিশের জেলে চরমতম অত্যাচার সহ্য করেছেন হাসিমুখে। এই সুন্দর পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আকাঙক্ষা তাঁদের কম ছিল না। তবুও ভারতবর্ষের স্বাধীনতার বেদিমূলে তাঁরা তাঁদের প্রিয় জীবনকে ধুপের মতো জ্বালিয়ে দিয়ে দুনিয়ার সামনে দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন, বিপ্লবীরা কীভাবে মৃত্যুভয়কে জয় করে পরাধীন দেশের মুক্তিকামনায় আরও লাখো মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। বিপ্লবী ত্রৈলোক্য মহারাজ, যিনি ব্রিটিশ রাজত্বে সেলুলার জেল, মান্দালয় জেল সহ বিভিন্ন জেলে যৌবনের ত্রিশটি বছর কাটিয়েছিলেন, তিনি লিখেছেন – ‘‘আমি ১৯০৮ সন হইতে ১৯৪৬ সন পর্যন্ত ৩০ বৎসর কারাগারে কাটাইয়াছি, ৪“৫ বৎসর অজ্ঞাতবাসে কাটাইয়াছি। … জেলখানার পেনাল কোডে যেসব শাস্তির কথা লেখা আছে এবং যে-সব শাস্তির কথা লেখা নাই, তাহার প্রায় সব সাজাই ভোগ করিয়াছি।” তবুও ব্রিটিশরা তাঁর মাথা এতটুকু নোয়াতে পারেনি। এই মহান বিপ্লবী দেশ ভাগের পর তাঁর জন্মস্থান পূর্ব পাকিস্তানেই ছিলেন। ১৯৭০ সালে ভারতে এলে একজন সাংবাদিকের একটি প্রশ্নের উত্তরে ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী বলেছিলেন – ‘‘প্রকৃত বিপ্লবীরা কোনও সম্প্রদায়ে বিশ্বাস করে না একমাত্র মানব সম্প্রদায় ছাড়া। আপনারা কি মনে করেন যে, ভারতের হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত বিপ্লবীরা কেবলমাত্র হিন্দুদের স্বাধীনতার জন্যই জীবন উৎসর্গ করেছেন? তারা ভারতের মুক্তি কামনায় জীবন উৎসর্গ করেছিলেন; কোনও বিশেষ সম্প্রদায়ের জন্য তারা গৃহত্যাগ করেননি।” তাঁদের ছিল ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে মানুষের প্রতি গভীর ভালবাসা। আর সাভারকারের জেলজীবনটায় দেখা যাবে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে বার বার মার্সি পিটিশন আর ব্রিটিশ-বন্দনা এবং জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরের জীবনটায় দেখা যাবে উগ্র-হিন্দুত্বের প্রচারের সাথে অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি বিদ্বেষ প্রচার। এই বিদ্বেষের উত্তরাধিকারই বহন করছেন আজকের রাজনাথ সিংহ, অমিত শাহ, নরেন্দ্র মোদীরা। কিন্তু চিন্তাশীল মানুষরা যেহেতু তা পছন্দ করেন না, তাই তাঁদের প্রয়োজন পড়ছে ইতিহাস-বিকৃতি ঘটানোর। সাভারকারের ব্রিটিশের কাছে মুচলেকা দেওয়ার দায় গান্ধীজির উপর চাপিয়ে দেওয়ার এই অপচেষ্টা তারই অঙ্গ।