অসংখ্য মৃত্যু, চিকিৎসা না পাওয়া, লকডাউনের যন্ত্রণার মাঝে অতিমারির দ্বিতীয় দফাতেও বিষাক্ত সাপের মতো মাথা তুলেছে কাজ না থাকার সমস্যা। শুধু গত এপ্রিল-মে, এই একমাসে কাজ চলে গেছে দেড় কোটি মানুষের। জানুয়ারি থেকে হিসাব করলে সংখ্যাটা হয় ২ কোটি ৫৩ লক্ষ। এই হিসাবের বাইরে রয়ে গেছে অসংগঠিত ক্ষেত্রের ছোট মিস্ত্রি, দিনমজুর, মোটবাহক, ফেরিওয়ালাদের মতো কোটি কোটি মানুষ, কোভিড অতিমারি ও লকডাউন যাঁদের কাছ থেকে উপার্জনের সুযোগ ছিনিয়ে নিয়েছে।
এমনিতেই দেশ বেকার সমস্যায় জেরবার। গত বছরের কোভিড-সঙ্কট সেই সমস্যার তীব্রতা এক ধাক্কায় অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। গত লকডাউনে কাজ হারিয়েছিলেন সরকারি হিসেবেই ১০ কোটি মানুষ। বছরের শেষে লকডাউন উঠে যাওয়ার পর দেখা গেল এঁদের মধ্যে দেড় কোটি আর কাজ ফিরে পাননি। আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমীক্ষা দেখিয়েছিল, গত বছরের লকডাউনে পরিযায়ী শ্রমিকদের ৮১ শতাংশ কাজ হারিয়েছিলেন। ‘স্ট্র্যান্ডেড ওয়ার্কার্স অ্যাকশন নেটওয়ার্ক’ সংস্থার সমীক্ষা দেখাচ্ছে, এ বছর কেন্দ্রীয় ভাবে না হলেও বিভিন্ন রাজ্যে অল্পদিনের যে লকডাউনগুলি হয়েছে, তাতে ইতিমধ্যেই কাজ চলে গেছে ৮১ শতাংশ পরিযায়ী শ্রমিকের। বলা বাহুল্য, এই সবগুলি হিসাবই খাতায়-কলমে। বাস্তব সংখ্যাটা অতি অবশ্যই এর কয়েকগুণ বেশি।
অতিমারির প্রকোপে কাজ হারালেন যাঁরা, লক্ষ করলে দেখা যাবে, তাঁদের অধিকাংশই অস্থায়ী কর্মী তথা চুক্তিশ্রমিক। অত্যন্ত কম বেতন দিয়ে এঁদের শ্রমশক্তি নিংড়ে নেয় দেশের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। ফলে এই দুর্দিনে খেয়ে-পরে বাঁচার মতো সঞ্চয়ের জোর নেই এঁদের। অধিকাংশের জন্যই কোনও সামাজিক সুরক্ষারও ব্যবস্থা রাখেনি সরকার। আর অসংগঠিত ক্ষেত্রের হকার, ফুটপাতের দোকানদার, মুটে-মজুর বা ঠিকামিস্ত্রিদের মতো দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ খেটে-খাওয়া মানুষদের কাছে মাস পোহালে নির্দিষ্ট আয় বা সরকারি সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা তো আকাশের চাঁদ। অথচ ‘গতরে খেটে’ খাওয়া ছাড়া বাঁচবার দ্বিতীয় পন্থা নেই তাঁদের। এই অবস্থায় অসংখ্য মানুষ পরিবার-পরিজন সমেত তলিয়ে যাচ্ছেন দারিদ্রের সীমাহীন অন্ধকারে। আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, গতবারের অতিমারি দেশের ২৩ কোটি মানুষকে দারিদ্রসীমার নিচে ঠেলে দিয়েছে। এ বছর সংখ্যাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে চলেছে, তা এখনও হিসাবের আওতায় আসেনি। কিন্তু সেই সংখ্যা যে আতঙ্কজনক– চারপাশে কাজ খুঁজে খুঁজে হন্যে হয়ে যাওয়া মানুষের ভিড়ের দিকে চোখ পড়লেই তা বেশ বোঝা যায়।
দেশের এই বিপুল সংখ্যক মানুষ, অতিমারি থেকে কোনও মতে প্রাণে বাঁচলেও রুজি-রোজগারের অভাবে যাঁরা আজ মরতে বসেছেন, অভুক্ত সন্তান-পরিজনের মুখে খাবার তুলে না দিতে পারার যন্ত্রণা যাঁদের প্রতি মুহূর্তে তাড়া করছে, ‘আত্মনির্ভর ভারত’-এর প্রশস্তবক্ষ প্রধানমন্ত্রী তাঁদের জন্য কী ব্যবস্থা করেছেন? গত বছর লকডাউনে ত্রাণপ্যাকেজ হিসাবে যে ২০ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার, তার কতটুকু এঁদের জন্য ব্যয় করা হয়েছে? বিনামূল্যে রেশনে যে ৫ কেজি চাল কিংবা গম আর ডাল দেওয়ার ব্যবস্থা করে দায় সেরেছিল সরকার, নভেম্বর মাস থেকে তাও বন্ধ করে দেওয়া হয়।
জনধন যোজনায় মহিলাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে মাসে ৫০০ টাকা করে দেওয়ার কথা বলেছিল সরকার। কিন্তু তিন মাস পরেই সেটুকুও বন্ধ করে দেওয়া হয়। যে একশো দিনের কাজ প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের কিছু মানুষ উপার্জনের মুখ দেখেন, গত বছর অতিমারির পর বাধ্য হয়ে সেই প্রকল্পে বরাদ্দ কিছুটা বাড়িয়েছিল কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। এ বছরে বাজেটে আবার ওই প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে দুর্দশার কালো মেঘ খেটে-খাওয়া মানুষগুলির জীবন ছেয়েই রেখেছিল। এর উপর এ বছর অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ায় আজ তাঁদের জীবনযন্ত্রণার সীমা নেই। অথচ পরিসংখ্যান বলছে, দেশের শতকোটিপতি বৃহৎ কর্পোরেটদের সম্পদের পরিমাণ গত বছরের লকডাউনের সময়েই ৩৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। এ থেকে তো এ কথাই প্রমাণ হয় যে ব্যাপক ছাঁটাই ও পদ বিলোপ করে মুনাফার পরিমাণ বিপুল বাড়িয়ে নেওয়া ছাড়াও সরকারি ত্রাণ প্যাকেজের বড় অংশটা থেকে ফায়দা তুলেছে হাতে-গোনা এই পুঁজিমালিকরাই! তা না হলে এঁদের সম্পদের এই বিপুল বাড়বাড়ন্ত সম্ভব হল কোন ম্যাজিকে! শুধু একচেটিয়া মালিকদের বিপুল মুনাফা কামানোর সুযোগ করে দেওয়াই নয়, অতিমারির সুযোগে সরকার শ্রম সংস্কারের নামে শ্রমিকদের কাজের ন্যূনতম স্থায়িত্ব, তাদের সুরক্ষার সমস্ত অধিকারই প্রায় কেড়ে নিয়েছে। নতুন শ্রমকোডে স্থায়ী কাজ, নির্দিষ্ট বেতন এ সব কিছু প্রায় অবলুপ্ত হবে– এই আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
অতিমারির আক্রমণে চূড়ান্ত দুর্দশায় রয়েছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ যে খেটে-খাওয়া মানুষ, তাঁদের শ্রমের উপরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে গোটা দেশ। অথচ সরকার তাঁদের বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্বটুকু পর্যন্ত আজ আর পালন করতে রাজি নয়। দেশের আসল মালিক পুঁজিপতি শ্রেণির রাজনৈতিক ম্যানেজার হিসাবে সরকারের যাবতীয় দায়বদ্ধতা শুধুমাত্র পুঁজিমালিকদের প্রতি। তাই অতিমারিতে যেখানে কোটি কোটি বোরোজগার মানুষ দু’বেলা দু’মুঠো জোটানোর চেষ্টায় মাথা কুটে মরছেন, তখন অ’ফ্যামের রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশের মাত্র ১০০ জন বৃহৎ শিল্পপতির সম্পদ আকাশ ছুঁয়েছে। তার পরিমাণ এতটাই যে এই কয়েকমাসের বাড়তি টাকাটা দেশের ১৩ কোটি ৮০ লক্ষ দরিদ্রতম মানুষের মধ্যে ভাগ করে দিলে প্রত্যেকের হাতে আসতে পারে ৯৪ হাজার ৪৫ করে টাকা!
এই সরকারের কাছে তাই খেটে-খাওয়া মানুষের আশা করার কিছু নেই। সঠিক নেতৃত্বে একজোট হয়ে লাগাতার গণআন্দোলনের চাপে দেশের সাধারণ মানুষের প্রতি দায়িত্ব পালনে বাধ্য করতে হবে এই সরকারকে। ছিনিয়ে নিতে হবে নিজেদের অধিকার। পাশাপাশি চূড়ান্ত অন্যায়ের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে থাকা এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা উচ্ছেদের লক্ষে্য একটু একটু করে শক্তি সংগ্রহ করতে হবে। তা না হলে মেহনতি মানুষের শ্রম নিংড়ে মুনাফা লুটতে লুটতেই খারাপ সময় এলে তাদের ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার খেলা চালিয়ে যাবে শোষক পরজীবী পুঁজিপতিরা। আর পুঁজিবাদী রাষ্টে্রর সরকার ত্রাণ-প্যাকেজ দেওয়ার নামে ভরিয়ে তুলতে থাকবে পুঁজিমালিকদের মুনাফার সিন্দুক।