সম্প্রতি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও কেন্দ্রের মোদি সরকারে মধ্যে একটি দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এসেছে৷ একদিকে সরকার ও তার অর্থমন্ত্রক ক্রমাগত তোপ দাগছে, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর উর্জিত প্যাটেলকে বলা হচ্ছে, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সরকারের অধীনস্থ একটি সংস্থা, ফলে সরকারের কথা তাকে মানতে হবে৷ নির্দেশ পালনে বাধ্য করতে সরকার নজিরবিহীনভাবে আরবিআই (ধারা ৭) আইন প্রয়োগ করার হুমকি দিচ্ছে৷ অন্য দিকে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বলছে, এটি একটি স্বশাসিত সংস্থা, ফলে সরকারের সব কথা তারা মানতে বাধ্য নয় ইত্যাদি৷
ঘটনার সূত্রপাত কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে দেওয়া তিনটি চিঠি নিয়ে৷ আগস্ট মাসে দেওয়া প্রথম চিঠিতে বেশ কিছু বিদ্যুৎ সংস্থাকে অনাদায়ী ঋণ নিয়মে ছাড় দিতে রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে নির্দেশ দেয় সরকার৷ গত দু’মাসে দেওয়া বাকি দুটি চিঠির প্রথমটিতে সরকারের রাজকোষ ঘাটতি (ফিসক্যাল ডেফিসিট) কমানোর জন্য রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ভাঁড়ার থেকে বেশি লভ্যাংশ সরকারকে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয় এবং দ্বিতীয়টিতে অনাদায়ী ঋণের জন্য রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যে ১১টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ককে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে কড়া বিধি–নিষেধ আরোপ করেছে তা শিথিল করার নির্দেশ আসে৷
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পক্ষ থেকে এই তিনটি নিদের্শই মানতে অস্বীকার করা হয়৷ শুরু হয়ে যায় তরজা৷ রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কী পারে, না পারে বা কেন্দ্রের হাতে কী কী ক্ষমতা রয়েছে তা নিয়ে উভয় পক্ষের তোপ–পাল্টা তোপ চলতে থাকে৷ উভয় পক্ষের এই দ্বন্দ্বের সাথে এ দেশের গরিব, খেটে–খাওয়া সাধারণ মানুষের বিশেষ কোনও সম্পর্ক না থাকলেও এই দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সামনে এসেছে তা আমাদের অবশ্যই ভাবা দরকার৷
এটা ঠিকই যে কেন্দ্রীয় সরকার যে তিনটি নির্দেশিকা শীর্ষ ব্যাঙ্ককে চিঠি মারফত পাঠিয়েছিল তা মেনে নিলে কোনও সমস্যা হত না৷ কিন্তু রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তা মানেনি৷ প্রশ্ন আসে– সরকারের নির্দেশ না মানলে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গর্ভনরকে হয় নিজে থেকে পদত্যাগ করতে হবে না হলে সরকার আরবিআই আইনের ১১ নম্বর ধারা প্রয়োগ করে গভর্নর ও ডেপুটি গর্ভনরকে বরখাস্ত করতে পারে৷ এর পরেই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গর্ভনর রঘুরাম রাজন চিঠি দিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ আনেন৷ বলেন, গভর্নর থাকাকালীন বড় মাপের ব্যাঙ্ক প্রতাবণার মামলার তালিকা তিনি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠিয়েছিলেন৷ কয়েকজন প্রতারকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধও জানানো হয়েছিল৷ কিন্তু এই বিষয়ে সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছে তা তাঁর জানা নেই৷ সম্প্রতি, রঘুরাম রাজন খোদ প্রধানমন্ত্রীর দফতরে ঋণ খেলাপিদের তালিকা পাঠিয়েছিলেন কি না এবং পাঠিয়ে থাকলে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা জানতে চেয়ে আর্জি জমা পড়ে তথ্যের অধিকার আইনে৷ প্রধানমন্ত্রীর দফতর তার কোনও উত্তর না দিয়ে এই আর্জিকে অন্তঃসারশূন্য ও উদ্দেশ্যহীন তকমা লাগিয়ে দিয়েছে৷ কিন্তু রাজন নিজে এই অভিযোগ তোলায় নড়ে চড়ে বসতে হয় সরকারকে৷ সরকারি ব্যর্থতা ঢাকা দিতে কম্প্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল অব ইন্ডিয়া (সিএজি) রাজীব মহর্ষি পাল্টা প্রশ্নবাণ ছুঁড়ে দেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দিকে৷ বলা হয়, দেশের বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি যখন শিল্পপতিদের পাগলের মতো ধার দিচ্ছিল, তখন কী করেছিল শীর্ষ ব্যাঙ্ক?
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি আরও এক ধাপ এগিয়ে সাল তারিখ দেখিয়ে বলেন, ‘বিশ্ব জোড়া মন্দার পরে ২০০৮ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে দেশের অর্থনীতিকে কৃত্রিমভাবে চাঙ্গা দেখাতে ব্যাঙ্কগুলিকে যথেচ্ছ ঋণ দিতে বলা হয়েছিল৷ সেই সময় শীর্ষ ব্যাঙ্ক কী করছিল?’ রাজীব মহর্ষি বা অরুণ জেটলি ঋণ দেওয়ার সময়কাল হিসেবে কংগ্রেসি জমানার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন৷ কেন্দ্রের পূর্বতন কংগ্রেস সরকার দেশের শিল্পপতিদের যে বিপুল অর্থের যোগান দিয়েছিল এবং ঋণখেলাপি কালো টাকার মালিকদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি তা সকলেরই জানা৷ কিন্তু রঘুরাম রাজন তো কংগ্রেস এবং বিজেপি দুই আমলেই গভর্নর ছিলেন৷ ফলে রাজনের অভিযোগ এড়িয়ে যাওয়ার কোনও উপায়ই বিজেপি সরকারের নেই৷ তাছাড়া রাজন যদি কংগ্রেস সরকারকে চিঠি দিয়ে থাকেন তবে ক্ষমতায় বসে বিজেপি সরকার ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করল না কেন, তা দেশের মানুষকে জানাক সরকার৷
সরকারি হিসেবে ২০১৮ সালের মার্চে ব্যাঙ্কগুলির মোট অনুৎপাদক সম্পদের পরিমাণ ৯.৬১ লক্ষ কোটি টাকা৷ এর মধ্যে ৭.০৩ লক্ষ কোটির পাহাড় জমেছে বিভিন্ন শিল্পসংস্থা সময়ে ঋণ শোধ না করার কারণে৷ জুন মাসের রিপোর্ট অনুযায়ী অনাদায়ী ঋণের অঙ্ক আরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২ লক্ষ কোটি টাকা৷ অঙ্কটা বেড়েই চলেছে৷ নীরব মোদি, মেহুল চোকসি, বিজয় মালিয়াদের মতো কালো টাকার মালিকরা ব্যাঙ্ক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ আত্মসাৎ করে বিদেশে পাড়ি দিয়েছে৷ এদের সকলের সাথেই বর্তমান সরকারের নেতা–মন্ত্রীদের ঘনিষ্ঠ যোগসাজশের বিষয়টিও আজ আর কারও অজানা নয়৷ কিন্তু এদের গ্রেপ্তার করা ও শাস্তি দেওয়ার ব্যাপরে মোদি সরকারের কোনও সদিচ্চা দেশের মানুষের চোখে পড়েনি৷ নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এসে দেশের শীর্ষ ব্যাঙ্কের আপত্তি অগ্রাহ্য করে কালো টাকা উদ্ধারের নামে নোট বাতিলের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তা যে দেশের অর্থনীতিকে পুরোপুরি বিপর্যস্ত করে দিয়েছে, বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদরাও তা বলছেন৷ আসলে কালো টাকা উদ্ধারের নামে কালো টাকার মালিকদের ছাড় দিয়ে সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত টাকা ব্যাঙ্কে কেন্দ্রীভূত করে, দেশের অর্থনীতিকে কৃত্রিমভাবে চাঙ্গা করতে চেয়েছে বিজেপি সরকার৷ এখন রাজনের মন্তব্যে ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে এসেছে৷ নোট বন্দির ফলে যে শতাধিক মানুষের প্রাণ গেল, লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবন–জীবিকা থেকে উৎখাত হল বা অসংখ্য কলকারখানা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায় লালবাতি জ্বলল তার কোনও জবাব বিজেপির কাছে নেই৷ ফলে এখন প্রধানমন্ত্রী আসরে নেমে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সাথে আলাপ–আলোচনার মাধ্যমে সমস্যাটি মিটিয়ে নেওয়ার কথা বলছেন৷
বাস্তবে পূর্বতন কংগ্রেস, বর্তমান বিজেপি সরকার সকলেই পুঁজিপতিদের একান্ত সেবাদাস৷ মালিকের সেবা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েই এরা ক্ষমতায় আসে এবং তাদের পলিটিক্যাল ম্যানেজার হিসাবে কাজ করে৷ একই সাথে দেশের পুঁজিপতি শ্রেণির মুনাফা অটুট রাখতে ও আরও সংহত করতে সরকারের পাশাপাশি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সহ অন্য ব্যাঙ্কগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়৷ সাধারণ মানুষের গচ্ছিত টাকায় গড়া ব্যাঙ্কের তহবিল শূন্য করে সরকারের নীতি মেনেই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নিদের্শেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি শিল্পপতিদের বিপুল ঋণ দেয়৷ রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করে না৷ ফলে ব্যাঙ্ক ও সরকার আলাদা কিছু নয়৷ একে অন্যের উপর দায় চাপানোর জন্যই এদের তরজার লড়াই৷ কিন্তু মালিকরা যাতে ফুলেফেঁপে ওঠে ও গরিব মানুষ রিক্ত নিঃস্ব হয়ে যায়– এই নীতির রূপায়ণে উভয়েই ভূমিকা নেয়৷ ফলে এই তরজার সাথে জনস্বার্থের কোনও সম্পর্ক নেই৷
(৭১ বর্ষ ১৫ সংখ্যা ২৩ – ২৯ নভেম্বর, ২০১৮)