করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বেসামাল দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। চলছে মৃত্যুমিছিল, জ্বলছে গণচিতা, লাশ ভাসছে নদীর জলে। দেশে সরকার কোথায়?
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে ভারতেও করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমিতের সংখ্যা। লম্বা হচ্ছে মৃত্যুমিছিল। মানুষ আজ বড় অসহায়। সংক্রমিত প্রিয়জনের জন্য অ্যাম্বুলেন্সটুকু জোগাড় করতে অনেককে সর্বস্ব খোয়াতে হচ্ছে– চিকিৎসা তো দূর অস্ত। হাসপাতালের বেডে এক মুমূর্ষর থেকে অক্সিজেন কেড়ে নিয়ে অন্য আরেকজন মুমূর্ষুকে বাঁচানোর চেষ্টাও চলছে অহরহ। অি’জেনের সঙ্কট আজ এতটাই যেখানে মুমূর্ষুদের মধ্যেও কে অক্সিজেন পাবে আর কে পাবে না, তা নিয়েও ট্রায়াজ সিস্টেম (যার বাঁচার সম্ভাবনা নেই তার থেকে চিকিৎসা কেড়ে নিয়ে যার বাঁচার সম্ভানা বেশি তাকে দেওয়া) চালু করতে হচ্ছে। অি’জেনের অভাব আজ মানবিকতার উপরও আঘাত হেনেছে। হাসপাতালে বেড না পেয়ে দিনের পর দিন বিনা চিকিৎসায় অনেকে তার প্রিয়জনকে ঘরে ফেলে রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। চোখের উপর প্রিয়জনের দেহ নিথর হতে দেখে অনেকেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছেন। রোগ নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষার ডেট পেতে হয়রানি হতে হচ্ছে অনেকেই। টেস্ট হলেও রিপোর্ট মিলছে পাঁচ-সাত দিন পরে। তত দিনে রোগীর নাভিশ্বাস উঠছে। অনেকেই রোগ নির্ণয়ের আগেই মারা যাচ্ছেন।
এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখে অনেকেই বাঁচার তাগিদে ভ্যাক্সিন নিতে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ছেন। সকলকে ভ্যাক্সিন নিতে সরকার আবেদনও জানাচ্ছে। কিন্তু ভ্যাক্সিনের অভাবে মানুষ দিনের পর দিন ঘুরেও তা নিতে পারছে না। উপরন্তু চূড়ান্ত অব্যবস্থার জন্য ভ্যাক্সিনের লাইনে গাদাগাদি দাঁড়িয়ে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন অথবা অজানা করোনা রোগীর থেকে সংক্রমণ নিয়ে ঘরে ফিরছেন। করোনা চিকিৎসার জন্য মুষ্টিমেয় যে কয়েকটি ওষুধ রয়েছে, বেশিরভাগ সময়ে বাজারে তা অমিল। ওষুধ, অক্সিজেন, অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে, হাসপাতালের বেড পাওয়া নিয়ে খোলাখুলি ভাবেই কালোবাজারি চলছে। সরকার এবং প্রশাসন নির্বিকার। মনেই হবে না সরকার বলে কিছু দেশে আছে! দু’দিন আগেও ভোটবাজ দলগুলি ভোটের উন্মাদনা তৈরি করতে গিয়ে রোগটিকে ছড়িয়ে দিয়েছে। তখন কিন্তু প্রশাসন ছিল এবং এই কাজে তারা সাহায্যই করেছে। কৃষকরা যখন মানুষের দাবি নিয়ে আন্দোলন করে, সে আন্দোলন ভাঙতে সরকার-প্রশাসন-পুলিশ-মিলিটারি সকলেরই অস্তিত্ব বোঝা যায়। এনআরসি বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য, শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকার রক্ষার্থে মানুষ যখন আন্দোলনে নামে তখন দেখা যায় পুলিশ, মিলিটারি, র্যাফ কখনও লাঠি নিয়ে, কখনও জলকামান গোলা বন্দুক নিয়ে আন্দোলনকারীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। সরকারের অস্তিত্ব মানুষ তখন কিন্তু হাড়ে হাড়েই টের পায়।
আর মানুষ যখন বিপর্যয়ের কবলে পড়ে, দুর্ভিক্ষ, মহামারির কবলে পড়ে খাদ্যহীন, বস্ত্রহীন, বাসস্থানহীন ও চিকিৎসাহীন হয়ে পড়ে তখনই কেবল সরকার ও প্রশাসনের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর পরে সৎকারের সময়ও সরকারের দেখা মেলে না। অস্তিত্ব মেলে কেবল গঙ্গার জলে দেহগুলি ভাসিয়ে দেওয়ার সময়।
গত শতাব্দীতেও মানুষ অনেক মহামারি দেখেছে। স্প্যানিস ফ্লু, প্লেগ, গুটিবসন্ত, কলেরা গ্রামের পর গ্রাম উজাড় করে দিয়েছে। কোটি কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সে দিন এ সব রোগের চিকিৎসা ছিল অজানা। জীবাণু সংক্রান্ত জ্ঞান ছিল খুবই সীমিত। সামাজিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সেদিন গড়েও ওঠেনি। ফলে সেদিন মহামারির গতি ছিল অপ্রতিরোধ্য। কিন্তু সেদিন মৃতদেহ গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়ার নজির ছিল কি না তা আমাদের জানা নেই। তবুও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালেও সরকারের অস্তিত্ব কিছুটা হলেও মানুষ সেদিন অনুভব করতে পারত। অন্তত রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে কোয়ারেন্টাইন প্রথা প্রয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল, তা শরৎসাহিত্যের বহু জায়গাতেই দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু বতর্মানের অতিমারিতে সরকার কোথায়? আমাদের দেশের চিকিৎসকরা বৈজ্ঞানিকেরা প্রথম ঢেউয়ের পরে সরকারকে যখন বারে বারে সচেতন করেছে– দ্বিতীয় ঢেউ আসছে, ব্যবস্থা নিন। তখনও সরকারের অস্তিত্ব দেখা যায়নি। দেশ জুড়ে ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক জমায়েতের অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে কিন্তু সরকারের অস্তিত্ব ছিল।
আজ জীবাণু বিজ্ঞান থেকে, জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানের জ্ঞানভাণ্ডার আমাদের কাছে রয়েছে। কন্টেনমেন্ট মেজার্স, দ্রুত রোগনির্ণয়, আইসোলেশন, চিকিৎসা, যে অতিমারি নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারে, তা তো আমাদের জানাই ছিল। তা-ও এর কোনও কিছুই প্রায় আমাদের দেশে প্রয়োগই করা হল না। আসলে তা প্রয়োগ করার মত উপযোগী স্বাস্থ্যনীতি, স্বাস্থ্যবাজেট, সরকারি সদিচ্ছা এবং জনগণের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতা, সর্বোপরি সেই স্বাস্থ্য পরিকাঠামো– এর কোনওটাই এ-দেশে নেই, গড়ে তোলা হয়নি। তাই তো আমরা দেখতে পাই কিউবা, ভিয়েতনামের মত গুটিকয়েক দেশ করোনাকে আজ রুখে দিতে পেরেছে। কারণ সেখানে উপস্থিত রয়েছে জনমুখী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, পরিকাঠামো, মানুষের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতা, ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গির বদলে বিজ্ঞানভিত্তিক ও জনমুখী স্বাস্থ্যনীতি প্রয়োগের মাধ্যমে। বিশ্বের সর্বশক্তিমান দেশ আমেরিকা, জার্মান, ব্রিটেন কিন্তু তা পারল না। কারণ সেসব দেশে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়বরাদ্দ বেশি থাকলেও, তার বেশিরভাগ অংশই খরচ হয় বিমা কোম্পানির টাকা মেটাতে। পুরোপুরি ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে চলা স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় একটা বড় অংশই খরচ হয়ে যায় ঝাঁ চকচকে টার্শিয়ারি ব্যবস্থা নির্ভর স্বাস্থ্যব্যবস্থার ঠাটবাট বজায় রাখতে। জনস্বাস্থে্যর গুরুত্ব সেখানে কোথায়? তাই বনেদি পুঁজিবাদী দেশ হয়েও তারা করোনা সামলাতে ধরাশায়ী হয়ে যায়।
আমাদের দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাও গত তিন দশক ধরে ওই একই খাতে বয়ে চলেছে। বিশ্বের মধ্যে সর্বনিম্ন স্বাস্থ্য বাজেটের এই দেশের নূ্যনতম এই ব্যয়বরাদ্দও চালান হয়ে যায় কর্পোরেটমুখী স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে। জনস্বাস্থ্য সেখানে ভীষণ ভাবে লঙ্ঘিত। অতিমারি রোখার পরিকাঠামো এ দেশে কখনও গড়েই তোলা হয়নি। সুযোগ বুঝে সরকারও নির্বিকার। ফলে এ দেশে প্রতিরোধহীন, নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে করোনা গ্রাস করে চলেছে এ দেশের আপামর জনগণকে। অসহায় মানুষ বানের জলে ভেসে যেতে যেতে খড়কুটো ধরে বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকার করোনা মোকাবিলার নাম করে কখনও সম্পূর্ণ কখনও আংশিক ভাবে লকডাউন ঘোষণা করে দায় সারার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ অপরিকল্পিত লকডাউনের জেরে মানুষের সীমাহীন ভোগান্তি নিবারণে নূ্যনতম চেষ্টায়ও সরকারের অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে না। পরিযায়ী শ্রমিকরা হাজার হাজার মাইল হেঁটে বাড়ি ফেরার পথে তাই অনেকেই প্রাণ হারান। কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষ কাজ হারায়, না খেতে পেয়ে মরে। লকডাউনের বাড়াবাড়িতে চিকিৎসার সুযোগ না পেয়ে অনেকেই মরে। তখন কিন্তু দেশের কোথাও সরকার আছে বলে মনেই হয় না।
ডাঃ সজল বিশ্বাস
সাধারণ সম্পাদক, সার্ভিস ডক্টরস ফোরাম