Breaking News

সরকারকে দেওয়া বণিকসভার পরামর্শ অর্থনীতির সঙ্কট দূর করতে পারবে না

দেশীয় শিল্পপতিদের সংগঠন সিআইআই (কনফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রি) সম্প্রতি সাধারণ মানুষের হাতে বাড়তি নগদ টাকা জোগানোর লক্ষ‌্যে কেন্দ্রের মোদি সরকারকে একগুচ্ছ পরামর্শ দিয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে, দেশের গরিব মানুষদের বছরে ১০০ দিনের কাজে ন‌্যূনতম দৈনিক মজুরি ২৬৭ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৭৫ টাকা করা, পিএম কিসানের টাকা বছরে ৬ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৮ হাজার করা, তেলের দামে যে ট্যাক্স কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার নেয় তা কমানো, বছরে কুড়ি লক্ষ টাকা পর্যন্ত ব্যক্তিগত রোজগারে করের হার কমানো, স্বল্প আয়ের মানুষদের নির্দিষ্ট কিছু পণ্য পরিষেবায় খরচ করার জন্য বিশেষ ভাউচার দেওয়া, পিএম আবাস যোজনায় আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধি করা সহ আরও কিছু পরামর্শ (সূত্রঃ আনন্দবাজার পত্রিকা ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪)।

পরামর্শ শুনে অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন হঠাৎ পুঁজিপতিদের সংগঠন জনস্বার্থে সরকারকে এই কাজগুলি করার জন্য বলছে কেন? তবে কি পুঁজিপতিরা হঠাৎ জনদরদি হয়ে উঠল? গরিব মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়ল? আপাতদৃষ্টিতে এমন মনে হলেও বাস্তব আদৌ তা নয়। আসলে পুঁজিপতিরা পড়েছে এক মহা সমস্যায়। তাদের উৎপাদিত পণ্য তাদের প্রত্যাশা মতো বিক্রি হচ্ছে না। বাজার মন্দা। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তলানিতে পৌঁছেছে। তাদের হাতে ভোগ্য পণ্য কেনার মতো পর্যাপ্ত টাকা নেই। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের এত মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে যে খাদ্যের সংস্থান করতেই মানুষ হিমসিম খাচ্ছে। তার উপর মাত্রাছাড়া বেড়ে চলেছে ওষুধের দাম। বাড়ছে শিক্ষা সহ আনুষঙ্গিক সব খরচ। এ সব খরচ মিটিয়ে মানুষের হাতে ভোগ্যপণ্য কেনার মতো অবশিষ্ট কিছু থাকছে না। এর আগে আমরা গণদাবীতে উল্লেখ করেছি বিভিন্ন সমীক্ষা রিপোর্ট, যেখানে পণ্য উৎপাদক সংস্থাগুলি বলেছে তাদের বিক্রি কমছে। কারণ, একদিকে জিনিসপত্রের চড়া দামবৃদ্ধি, অন্য দিকে রোজগার না বাড়া।

আচ্ছা, প্রধানমন্ত্রী সহ বিজেপি নেতারা যখন দেশ-বিদেশের নানা সভায় দেশের বিপুল জিডিপি বৃদ্ধির গল্প শোনাচ্ছেন, আর ভারত কত দ্রুত পঞ্চম বৃহৎ অর্থনীতি থেকে তৃতীয় বৃহৎ অর্থনীতিতে পরিণত হয়ে যাচ্ছে, তার ফিরিস্তি দিয়ে চলেছেন তখন জনগণের ক্রয়ক্ষমতা এ ভাবে নামছে কেন? এর পিছনে কাজ করছে আয়ের ভয়ানক অসাম্য। রোজগার যা বাড়ছে তা সমাজের উঁচুতলায় থাকা মানুষদের, একচেটিয়া পুঁজিপতিদের। সাধারণ জনগণের কাছে তা পৌঁছচ্ছে না। জনগণের আয়বৃদ্ধি না হলে ভোগ্যপণ্যের বিক্রি বাড়ে না। কারণ সাধারণ মানুষের আয়বৃদ্ধি হলে ভোগ্যপণ্যের পিছনে ব্যয় যে হারে বাড়ে, ধনীদের আয়বৃদ্ধি হলে সেই হারে তা বাড়ে না। তাদের হাতে যথেষ্ট অর্থ থাকায় আয়বৃদ্ধিতে নতুন করে ভোগব্যয় বিশেষ বাড়ে না। তা ছাড়া, দেশে ধনীদের তুলনায় সাধারণ মানুষের সংখ্যা অনেকগুণ বেশি হওয়ায় দরিদ্র-মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তের আয় বাড়লে ভোগব্যয়ের পরিমাণ অনেকগুণ বাড়ে, যা ধনীদের আয় বৃদ্ধি ঘটে না।

কিন্তু জনগণের রোজগার বাড়ছে না কেন? কারণ মানুষের হাতে কাজ নেই। পুঁজিবাদী অর্থনীতি প্রয়োজন মতো নতুন কাজ তৈরি করতে পারছে না। উৎপাদন যা বাড়ছে তা পুঁজিনিবিড় ক্ষেত্রে। যেখানে নতুন শ্রমিক নিয়োগ প্রায় নেই বললেই চলে। শ্রমনিবিড় ক্ষেত্রগুলি ধুঁকছে। তা হলে তরুণ ছেলেমেয়েরা কাজ পাবে কী করে? কাজ না পেলে তাদের হাতে খরচ করার মতো অর্থ আসবে কী করে? যাঁরা চাকরি করছেন তাঁদের মধ্যেও অনেকেই আগের চেয়ে কম মাইনেতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। এছাড়া ব্যাপক সংখ্যায় কলকারখানা নিয়মিত বন্ধ হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি, উৎপাদনে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে কর্মী-ছাঁটাই।

অন্য দিকে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে যাচ্ছে শ্রমের বাজারে। পাকা চাকরির ব্যাপারটাই আর পুঁজিপতিরা রাখতে চাইছে না। চুক্তিভিত্তিক স্থায়ী চাকরিও এখন থাকছে না। সর্বত্রই এখন নিয়োগ হচ্ছে ‘গিগ’ কর্মী, যেখানে কর্মীদের ন‌্যূনতম নিরাপত্তাটুকুও নেই। ‘কাজ করলে মাইনে’র শর্তে নিয়োগ করা হয় তাঁদের এবং ইচ্ছামতো ছেঁটে ফেলা হয়। এমন চাকরির জোরে কি ভোগব্যয় বাড়ে? ভোগব্যয় বাড়া দূরের কথা, এমন পরিস্থিতিতে কালকের দিনটা কেমন যাবে সেই চিন্তাই মানুষকে অস্থির করে তুলছে।

অর্থনীতির এমন দুঃসহ পরিস্থিতিতেই সিআইআই সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে লোকের হাতে যেভাবে হোক টাকা গুঁজে দাও, যাতে তারা বাজারে কেনাকাটা করতে পারে। দাওয়াইটা নতুন নয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে মারাত্মক বাজার সঙ্কট থেকে সাময়িক ভাবে হলেও বাঁচাতে গত শতকের তিরিশের দশকের গোড়ায় মহামন্দার পর অর্থনীতিবিদ কেইনস এই দাওয়াই বাতলে ছিলেন। তাতে তাৎক্ষণিক ভাবে সঙ্কট কিছু কমেও ছিল। কিন্তু পুঁজিবাদী অর্থনীতি এমনই যে, সর্বোচ্চ মুনাফা করতে গিয়ে শোষণের মাত্রাকে তা ক্রমাগত বাড়িয়ে চলে। শ্রমিক-কৃষক সহ সাধারণ মানুষ ক্রমাগত নিঃস্বে পরিণত হয়। ফলে কেইনসীয় দাওয়াই জ্বরে জলপটি দেওয়ার মতো ভূমিকা পালন করলেও তাতে রোগ সারে না। বারে বারে সঙ্কটে পড়ে অর্থনীতি। পুঁজিবাদী অর্থনীতির এই সংকটকে বিশিষ্ট মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক শিবদাস ঘোষ বলেছেন এবেলা-ওবেলার সংকট। আজ সেটাই দেখা যাচ্ছে। অবস্থা এতদূর নেমেছে যে, শ্রমিক-কৃষক নেতারা এতদিন যে সব দাবি করতেন, আজ সেই সব দাবি শোনা যাচ্ছে বণিক সভার নেতাদের মুখে। তীব্র বাজার সঙ্কটের প্রেক্ষাপটেই এসেছে পুঁজিবাদী দেশগুলিতে বিভিন্ন খয়রাতি প্রকল্প। যেমন এ রাজ্যের লক্ষ্মীর ভাণ্ডার। মুশকিল আসানের আশায় এমন প্রকল্প নানা নামে রাজ্যে রাজ্যে চলছে। কোথাও লক্ষ্মীর ভান্ডার, কোথাও লাডলি বহিন প্রকল্প। বিজেপি, কংগ্রেস, সিপিএম, আম আদমি সহ জাতীয় এবং আঞ্চলিক সব দলগুলিই এমন প্রকল্প ঘোষণা করে চলছে। এ সবগুলিরই উদ্দেশ্য মন্দায় আক্রান্ত পুঁজিবাদী বাজারকে খানিকটা চাঙ্গা করা। সরকার পুঁজিপতিদের এই জরুরি প্রয়োজনকে আড়াল করেছে জনস্বার্থের আবরণ দিয়ে। পুঁজিবাদী অর্থনীতির সঙ্কটের এই চরিত্রকে যথাযথ ভাবে উপলব্ধি করতে না পেরে কেউ কেউ বলছেন, লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের ভিক্ষা না দিয়ে সকলকে কাজ দাও। সরকারগুলি সকলকে কাজ দিতে পারলে এই ভাবে রাজ্যে রাজ্যে অনুদানের প্রকল্প, খয়রাতির প্রকল্প আনতে হত না এবং পুঁজিপতিদের সংগঠনকে এইভাবে জনস্বার্থের দাবি নিয়ে ওকালতি করতে হত না। কিন্তু এ ভাবে পুঁজিবাদী অর্থনীতির সঙ্কট যে ঠেকিয়ে রাখা যায় না, জনসাধারণের হাতে নগদ টাকা তুলে দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে বণিক সভার এই আকুল আবেদন সে কথাই প্রমাণ করছে।

 বাস্তবে পঞ্চম বৃহৎ অর্থনীতিই হোক, আর তৃতীয় বৃহৎ অর্থনীতিই হোক কিংবা পাঁচ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতিই হোক, তাতে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের কিছু যায়-আসে না। তাতে মুষ্টিমেয় ধনকুবেরের ধনের পরিমাণই শুধু বাড়ে। সাধারণ মানুষ আরও নিঃস্ব হয়। তাই তো দেশের এক শতাংশ ধনীর হাতে জমা হয়েছে দেশের ৭৩ শতাংশ সম্পদ আর নিচেরতলার ৫০ শতাংশের হাতে রয়েছে মাত্র ১ শতাংশ সম্পদ। তাই খয়রাতি দিয়ে মানুষের জীবনের সমস্যা মিটছে না বরং তা আরও বেড়ে চলেছে।

পুঁজিবাদী এই অর্থনীতি ঐতিহাসিক ভাবেই আজ মুমূর্ষু, ক্ষয়িষ্ণু, মৃতপ্রায়। এর সমাধান করার মতো উপায় পুঁজিবাদের হাতে নেই। এই সঙ্কটের সমাধান একমাত্র এই ব্যবস্থাকে ভাঙার মধ্যেই রয়েছে। সমাজের প্রগতির স্বার্থেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার জগদ্দল পাথরকে সরাতে হবে। সে কাজটা শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে শোষিত বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষেরই দায়িত্ব।