এবারও শারদীয় উৎসব কাটল করোনা সংক্রমণের আশঙ্কার মধ্যেই। স্বাভাবিক ভাবেই দলের পক্ষ থেকে প্রতি বছরের মতো এবারও রাজ্য জুড়ে শত শত বুক স্টল হলেও সরাসরি জনগণের মুখোমুখি হয়ে বই বিক্রি করা যায়নি। তা সত্তে্বও দলের কর্মীদের আহ্বানে এবং স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মানুষ যে ভাবে এগিয়ে এসে স্টল থেকে বই সংগ্রহ করেছেন তা খুবই অনুপ্রেরণার। দক্ষিণপন্থী শাসক দলগুলির নীতিহীন এবং ভ্রষ্টাচারী রাজনীতি এবং একদা শাসক বামপন্থীদের প্রতিবাদ-আন্দোলন সম্পর্কে অনীহায় যখন সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ তখন এস ইউ সি আই (সি)-র রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সমৃদ্ধ পুস্তক সম্পর্কে আগ্রহ দল সম্পর্কে তাঁদের গভীর প্রত্যাশারই পরিচয় দেয়।
ভারতের নবজাগরণের মনীষীদের এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের আপসহীন ধারার বিপ্লবীদের সম্পর্কে দলের মূল্যায়ন সংক্রান্ত পুস্তকগুলি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের বরাবরের যে আগ্রহ এবারও তার উল্লেখযোগ্য প্রকাশ দেখা গেছে। বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নেতাজি, ভগৎ সিং, মাস্টারদা প্রমুখের জীবনসংগ্রাম ও মূল্যায়ন সংবলিত পুস্তকগুলির পাশাপাশি পার্টির রাজনৈতিক লাইন ও বিশ্লেষণ সম্পর্কিত পুস্তকগুলির প্রতি মানুষের আগ্রহ দেখা গেছে। দলের প্রতিষ্ঠাতা মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষের ‘কেন ভারতের মাটিতে এস ইউ সি আই (সি) একমাত্র সাম্যবাদী দল’, ‘মার্কসবাদ ও মানব সমাজের বিকাশ প্রসঙ্গে’, ‘ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও আমাদের কর্তব্য’, ‘সাম্প্রদায়িক সমস্যা প্রসঙ্গে’, ‘শরৎচন্দ্রের চিন্তা ও সাহিত্য’ প্রভৃতি বইগুলি অনেকেই বেছে নিয়েছেন। একই সাথে দেখা গেল দলের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষের বর্তমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণ সংবলিত পুস্তক, ‘শরৎসাহিত্য পাঠের প্রাসঙ্গিকতা’ এবং মার্কস ও স্ট্যালিনের জীবন-সংগ্রাম ও পথনির্দেশিকা সংক্রান্ত বইগুলি ও গত ৫ আগস্ট বর্তমান পরিস্থিতির উপর যে বিশ্লেষণ তিনি উপস্থিত করেছেন সেই বইটিরও চাহিদা ছিল যথেষ্ট।
ধর্মীয় চিন্তা আজ পথ দেখাতে পারে না। আজ চাই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্তে্রর চেতনা। এ বিষয়ে বই চেয়ে নিয়েছেন ছাত্রযুবরা। উগ্র জাতীয়তাবাদ যে সর্বনাশ ডেকে এনেছে সে বিষয়ে কমরেড প্রভাস ঘোষের আলোচনা সংবলিত বইটির প্রতি খুবই আগ্রহ দেখা গেছে। প্যারি কমিউনের দেড়শো বছর ও দিল্লির চলমান কৃষক আন্দোলন সংক্রান্ত বই দুটি কিনেছেন বহু মানুষ।
সর্বত্রই স্টলে পথচলতি সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বামপন্থী মানুষদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য। বসে যাওয়া সিপিএম কর্মীরা এসে পরিচয় দিয়েই বই নিয়েছেন। ফোন নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করতে বলেছেন। এস ইউ সি আই (সি) দলের প্রতি এঁদের সকলেরই আগ্রহ প্রকাশ পেয়েছে। জেলায় জেলায় তরুণ-তরুণীদের মধ্যে অন্য বামপন্থী ছাত্র ও যুব সংগঠনের সমর্থকরা বই নিয়েছেন। ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল, কলকাতার বড়বাজার এলাকায় হিন্দিভাষী বামপন্থী অনেক মানুষ বই নিয়ে যোগাযোগ করতে বলেছেন।
একদা-শাসক বামপন্থী কর্মীদের মধ্যে যথার্থই বামপন্থী অংশটি এস ইউ সি আই (সি)-কে দুই হাত তুলে অভিনন্দন জানিয়েছেন। কলকাতায় লর্ডস বেকারি মোড়ে কর্মীরা ভ্রাম্যমাণ বুক স্টল থেকে বই নেওয়ার অনুরোধ করছিলেন। বামপন্থী একটি দলের একসময়ের গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক লাল সেলাম জানিয়ে বললেন, আপনারা আছেন বলে আজও বামপন্থা আছে। আপনারা চালিয়ে যান। সঙ্গে কমসোমলের এক ছোট্ট কর্মী ছিলেন। ভদ্রলোক তাকে লক্ষ্য করে বললেন, আপনাদের সঙ্গে বাচ্চাটিও সমানে আছে। এমন করেই বর্তমান প্রজন্মকে তৈরি করুন। আমাদের সমস্ত সমর্থন-ভালবাসা রইলো। ঠিক ৫০ গজ দূরে ছিল তাঁর দলের স্টল।
একটি বামপন্থী দলের বেশ কিছু ছাত্র-যুব কর্মী তাঁদের দল সম্পর্কে হতাশা প্রকাশ করে বইপত্র নিয়ে গেলেন। উত্তর চব্বিশ পরগণার ব্যারাকপুরে মধ্যবয়স্ক একজন কয়েকটি বই নিয়ে বললেন, সব পরিস্থিতিতে আপনারাই রাস্তায় থাকেন। একজন বললেন, সিপিএমের উচিত ছিল আপনাদের সঙ্গে থাকা। কলকাতার লেক এলাকায় একজন পুরনো বামপন্থী কর্মী কয়েকটি বই নিয়ে বললেন, সোভিয়েত আমলে প্রকাশিত সাহিত্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস ও ঘটনার বইগুলি আপনারা আবার প্রকাশ করুন।
বাঁকুড়ার সোনামুখীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্রী স্টলে এসে পার্টির বিভিন্ন ধরনের বই নিয়ে বললেন, আমাদের এলাকায় সংগঠনের কাজ শুরু করুন, আমরা থাকব। পরে তাঁদের বন্ধুদের বই নিতে স্টলে পাঠান তাঁরা। ওই জেলারই রামপুরের একজন পরিযায়ী শ্রমিক স্টলে এসে কয়েকটি বই নেন। বলেন আমি বামপন্থায় বিশ্বাসী। যদিও আপনাদের দলের নই। কিন্তু আপনাদের বই ও পত্রিকায় বামপন্থার মূল আদর্শের কথা জানতে পারি। সে জন্যে আপনাদের বই পড়ি। আরও বই নেব শ্রমিক সমস্যার উপর। কয়েক জন বাম নেতৃস্থানীয় সরকারি কর্মচারী ও বাম লেখক বই নিয়ে বলেন, আপনারাই বামপন্থী আদর্শের একমাত্র ভরসা। আপনাদের মতাদর্শ প্রচারে নিরলস প্রচেষ্টা ও সময়োপযোগী ধারাবাহিক সঠিক আন্দোলন জনমনে ও বামপন্থীদের উপর প্রভাব ফেলছে। কলকাতার বেলেঘাটায় নির্বাচনের সময় যোগাযোগ হয়েছিল এমন একজন বামপন্থী মানুষ স্টলে প্রায় ঘণ্টা দুয়েক বসে বললেন, এই প্রথম আমি আমার দলের স্টলে থাকলাম না। জলপাইগুড়ি শহরে স্টল শেষ হয়ে যাওয়ার পর এক জন অফিসে এসে মার্কস, লেনিন, স্ট্যালিন সম্পর্কিত বইগুলি কিনে নিয়ে গেলেন। বামপন্থার প্রতি সাধারণ মানুষের এই আগ্রহ বামপন্থী গণআন্দোলনের উজ্জ্বল সম্ভাবনাকেই নির্দেশ করে।