ভারতীয় সংসদে এখন কীভাবে আইন পাশ হয়? সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে মানুষ কয়েকদিন ধরে দেখেছে সে দৃশ্য। একটার পর একটা বিল সংসদে পেশ করছেন নানা মন্ত্রী। স্পিকার ভোট চাইছেন, উপস্থিত সবাই হাত তুলছেন, মুহূর্তে পাশ হয়ে যাচ্ছে বিল।
এ গেল দৃশ্য, আর শব্দ! একযোগে সাংসদরা গলা মিলিয়েছেন ‘মোদি মোদি’ ধ্বনিতে। ‘একতার’ অপূর্ব নিদর্শন সন্দেহ নেই। কিন্তু বিল নিয়ে আলোচনা, বিতর্ক? সারা পৃথিবীতেই সংসদে কোনও আইন পাশ করার জন্য যে আলোচনা হয় তাকে বলে ‘ডিবেট’, যার অর্থ বিতর্ক। কোথায় তা? তাহলে এ কেমন সংসদ, কেমন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান?
বিতর্ক ব্যাপারটাই ভারি অপছন্দ কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপির। তাই এক এক করে ১৪৬ জন বিরোধী সাংসদকে তারা সংসদ থেকে সাসপেন্ড করে দেওয়ার পর কয়েকটি মারাত্মক বিল পাশ করিয়ে নিলেন। তার মধ্যে রয়েছে ন্যায় সংহিতা দণ্ড সংহিতা বিল, নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের বিল। পোস্ট অফিস ও টেলিকমিউনিকেশন বিলের মাধ্যমে নাগরিকের যে কোনও চিঠি ও ফোনে সরকারের আড়িপাতার অধিকার সংক্রান্ত বিল, প্রেস রেজিস্ট্রেশন আইনের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ বিল তারা কোনও আলোচনার সুযোগ না দিয়ে লোকসভা বা রাজ্যসভায়পাশ করিয়ে নিয়েছে। যে হাতে গোনা কয়েকজন বিরোধী সাংসদ ছিলেন, তাঁদের কণ্ঠস্বর চাপা দিতে একশো-দেড়শো বিজেপি সাংসদ একযোগে চিৎকার করে গেছেন, যাতে তাঁদের কোনও বক্তব্য শোনা না যায়। লোকসভা, রাজ্যসভায় ‘পাশ’, অতএব বিলগুলির ওপর বিজেপিরই একসময়কার নেত্রী বর্তমান রাষ্ট্রপতির দস্তখত পড়তেও কোনও সময় লাগার কথা নয়।
বিরোধী সাংসদদের অপরাধ কী ছিল? তাঁদের দাবি ছিল, ১৩ ডিসেম্বর লোকসভার নিরাপত্তা ব্যবস্থার যে গুরুতর গলদ দেখা গিয়েছিল সে ব্যাপারে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে বিবৃতি দিন। এতবড় একটা ঘটনার পর যা অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই হওয়া উচিত ছিল।একজন সাংসদ তাঁর ন্যায়সঙ্গত ও আইনসঙ্গত অধিকারের জোরেই এই বিবৃতি দাবি করবার অধিকারী।সরকার কোনও অজুহাতেই তা অস্বীকার করতে পারে না।এ ছাড়াও সংসদ চলাকালীন দেশের যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে মন্ত্রীদের কথা বলতে হলে সর্বপ্রথম সংসদে দাঁড়িয়েই বলাটা সর্বজনস্বীকৃত গণতান্ত্রিক রীতি।অথচ ১৩ ডিসেম্বরের ঘটনা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংবাদমাধ্যমে মুখ খুললেন, কিন্তু সংসদে কোনও বিবৃতি দেওয়ার কথায় কর্ণপাতও করলেন না।স্বাভাবিকভাবেই বিরোধী সাংসদরা ক্ষোভের সাথে এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, প্ল্যাকার্ড হাতে লোকসভা, রাজ্যসভার ওয়েলে নেমে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন।
সরকারপক্ষ যেন এ জন্য তৈরি হয়েই বসেছিল।তারা গণহারে বিরোধী সাংসদদের সাসপেন্ড করতে শুরু করে। এ ব্যাপারে লোকসভার স্পিকার এবং রাজ্যসভার চেয়ারম্যান যে ভূমিকা নিয়েছেন তাকে নিরপেক্ষ বলা তো দূরের কথা, তাঁরা যেন ক্ষমতাসীন দলের একজন হিসাবেই কাজ করে গেছেন।যে কারণে ১৪৬ জন সাংসদ সাসপেন্ড হওয়ার পর টিকে থাকা মুষ্টিমেয় বিরোধী সাংসদদের সাথে বিজেপির প্রতিনিধিরা যে অশোভন ব্যবহার করেছেন তা সভার নেতা হিসাবে তাঁদের চোখে এতটুকু খারাপ লাগেনি।
একটা সামান্য বিবৃতি দিতে বিজেপি নেতৃত্ব এতটা নারাজ কেন? যা প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংবাদমাধ্যমে কিংবা দলীয় সভায় বলেছন, সেই কথাগুলোই সংসদের ভেতরে বললে অসুবিধা কী ছিল? আসলে বিজেপি বার্তা দিতে চেয়েছে গণতন্তে্র বিরোধীদের কোনও অস্তিত্বটাই তারা মানে না। প্রধানমন্ত্রী যখন বিরোধী সাংসদের সংখ্যা আরও কমিয়ে দেওয়ার কথা বলেন, দেশের মানুষের কাছে আরও পরিষ্কার হয়ে যায় গণতন্ত্রের মন্দির বলে তিনি সংসদের সিঁড়িতে যতই প্রণাম করুন না কেন, বাস্তবে তাঁর চিন্তায় গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটাও নেই, অস্তিত্ব নেই কোনও বিরোধী স্বরের প্রতি মর্যাদার।
বিরোধীদের বার করে দিয়ে ১২ মিনিটে দুটি বিল পাশের রেকর্ড গড়েছে উপরাষ্ট্রপতির নেতৃত্বাধীন রাজ্যসভা। লোকসভাতেও কোনও বিতর্ক ছাড়াই একাধিক বিলে সিলমোহর পড়ে গেছে। এর আগেও কৃষক বিরোধী তিনটি আইন, বনসংরক্ষণ আইন সহ বহু আইনই সংসদে পাশ হয়ে গেছে কোনও আলোচনা ছাড়াই। আলোচনা ছাড়া বিল পাশে পূর্বসূরী কংগ্রেস সরকারকেও বহু দূর ছাড়িয়ে গেছে বিজেপি। এমনকি ২০১৪ থেকে বিজেপি সরকার সংসদে সামান্য কয়েকটা ছাড়া কোনও বিলকেই স্ট্যান্ডিং কমিটিতে পূর্ণাঙ্গ আলোচনার জন্য পাঠায়নি। কোনও বিল সংসদে পাশ করানোর আগে তার পর্যাপ্ত পর্যালোচনার দরকার তারা বোধই করে না। বিজেপি সরকার কোভিড লকডাউন চলার সুযোগে কোনও আলোচনা ছাড়াই যেভাবে জাতীয় শিক্ষানীতি দেশের মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে, তা তাদের স্বৈরাচারী চরিত্রকে নগ্ন করে দেখিয়েছে আগেই।
ভারতে আজ ক্ষয় পেতে পেতে সংসদীয় গণতন্তে্রর ছিটেফোঁটাটুকু যা টিকে আছে বিজেপি তার রেশটুকুও মুছে দিতে চলেছে। মহান মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছেন, বর্তমান যুগে সমস্ত বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই ফ্যাসিবাদ একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য হিসাবেই দেখা দেয়। ভারতের শাসক বুর্জোয়া শ্রেণি সংসদীয় ব্যবস্থার খোলসের আড়ালে ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েমের চেষ্টা দীর্ঘদিন ধরেই করে চলেছে। বুর্জোয়া শ্রেণির রাজনৈতিক ম্যানেজার হিসাবে বিজেপি এখন সেই প্রচেষ্টাকে আরও বেগবান করে তুলেছে। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকার ফলে বিজেপি আজ কোনও গণতান্ত্রিক রীতিরই তোয়াক্কা করছে না, প্রায় সমস্ত বিরোধী সাংসদকে গায়ের জোরে বার করে দেওয়া, মনগড়া অভিযোগে বিরোধী সাংসদকে বহিষ্কার পর্যন্ত করার সাহস দেখাচ্ছে।
তারা যে এই ঔদ্ধত্য দেখাতে পারছে তার অন্যতম কারণ, দেশে বিকল্প বামগণতান্ত্রিক আন্দোলন আজ কার্যত অনুপস্থিত।এই দুর্বলতার কারণেই নরেন্দ্র মোদির সরকারের গণতন্ত্র হত্যার ন্যক্কারজনক কাজগুলিও রাজনীতিতে অসচেতন জনগণের একটা অংশের কাছে দুঃখজনক ভাবে বীরত্বব্যঞ্জক হয়ে উঠতে পারছে। মোদি সরকারের আর্থিক নীতি, একচেটিয়া মালিক তোষণ নীতির বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ কম নয়। অথচ তা আন্দোলনের রূপ নেওয়া দূরে থাক জনগণের ঘাড়ের ওপর নামিয়ে আনা সর্বনাশা নীতির আক্রমণ, মানুষের সমস্ত ধরনের প্রতিবাদের কণ্ঠরোধ করার অপচেষ্টাকেও একদল বৃহৎ সংবাদমাধ্যম তুলে ধরছে নরেন্দ্র মোদির অপরাজেয় শক্তির পরিচয় হিসাবে। অসহায় সাধারণ মানুষ এর বিরুদ্ধে মাথা তুলতে চেয়েও পথ পাচ্ছে না। কংগ্রেস কিংবা অন্যান্য বিরোধী বুর্জোয়া দলগুলিও বিজেপির সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ এবং ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতির সাথে প্রতিযোগিতার তাগিদে একই ধরনের সাম্প্রদায়িক এবং জাতপাত ভিত্তিক রাজনীতির গোলকধাঁধাতেই ঘুরপাক খাচ্ছে। ফলে বিজেপি-আরএসএস যে ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতির বিষ দেশে ছড়াচ্ছে তার বিরুদ্ধে জনমত প্রবল হয়ে ওঠার কাজটা বাধা পাচ্ছে।
এই স্বৈরাচারী, ফ্যাসিবাদী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কথা ছিল যাদের, সেই কমিউনিস্ট নামধারী বৃহৎ দলগুলিও তাকিয়ে আছে সংসদীয় রাজনীতির চৌহদ্দিতে কিছুটা বাড়তি সুযোগের আশায়। তাদের নেতারা বুঝতেই চাইছেন না, বিজেপির এই তীব্র আক্রমণ থেকে গণতন্ত্রের রেশটুকুকেও রক্ষা করতে গেলে সংসদে এমপি-র হিসাব মোলানোর খাতা থেকে মুখ তুলে আন্দোলনের পথের দিকে তাকাতে হবে। যদিও তাঁদের চোখের সামনে উদাহরণ রেখে গেছে এক বছর ধরে চলা দিল্লির কৃষক আন্দোলন। তাঁরা বোধহয় বুঝতে চেষ্টা করেননি, সেই আন্দোলন জয়ী হতে পেরেছে কোন শক্তির জোরে! সেই আন্দোলন এই চরম স্বৈরাচারী বিজেপি সরকারকে মাথা নত করাতে পেরেছে কোনও ভোট রাজনীতি, কোনও এমপি সংখ্যার জোরে নয়। জয়ী হয়েছে জনগণের দৃঢ় সংঘবদ্ধ প্রতিবাদের শক্তির জোরে। আজ বিজেপির আনা সর্বনাশা জাতীয় শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে দেশজুড়ে প্রতিবাদের কণ্ঠ উঠছে। বহু ক্ষেত্রে তারা এই নীতি চালু করতে গিয়ে বাধা পাচ্ছে সচেতন মানুষের কাছ থেকে।
এই উদাহরণ আগেও দেখা গেছে পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষা আন্দোলনে, বাসভাড়া বৃদ্ধি, বিদ্যুতের দামবৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনে।এমএলএ, এমপির সংখ্যার জোরে এই আন্দোলনগুলো জেতেনি, জিতেছে এসইউসিআই(সি)-র সঠিক রাজনীতি এবং আন্দোলনকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা গণকমিটির মধ্য দিয়েসমাজের নানা স্তরের মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে। আজ বিজেপি অধিকাংশ বিরোধী সাংসদকে সাসপেন্ড করে দিয়ে যে আইনই পাশ করিয়ে নিক না কেন, তা কার্যকর করার পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে মানুষের সচেতন ও সংগঠিত প্রতিবাদী আন্দোলন। তাদের স্বৈরাচারী ফ্যাসিবাদী শাসনের গতিকে রুদ্ধ করতে হলে সমস্ত বামগণতান্ত্রিক শক্তিকে নিয়ে আন্দোলনের শক্তিতেই তা করা সম্ভব। নানা জোটের জোড়াতালি দেওয়া ভোট রাজনীতির কৌশল এই কাজে অক্ষম।
কৌশলের থেকেও বড় শক্তি গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের রুখে দাঁড়ানোর জোর। স্বৈরাচারের চোখে চোখ রেখে মানুষের রুখে দাঁড়ানোর শক্তির সামনে টিকতে পারে এমন স্বৈরাচারী শাসক দুনিয়ায় কোনও দিন জন্মায়নি।