আগামী ৫ আগস্ট শুরু হচ্ছে এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক, এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক কমরেড শিবদাস ঘোষের জন্মশতবর্ষ। সারা দেশ জুড়ে শোষিত নিপীড়িত মুক্তিকামী মানুষ নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তা উদযাপন করবেন। এই উপলক্ষে ‘গণদাবী’র পক্ষ থেকে তাঁর মূল্যবান বিভিন্ন লেখা ও বত্তৃতার নানা অংশ প্রকাশ করা হবে। এই সংখ্যায় ১৯৬৭-র ১৭ সেপ্টেম্বর এআইডিওয়াইও-র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির প্রথম বার্ষিক সম্মেলনের প্রকাশ্য অধিবেশনে ভাষণের অংশবিশেষ প্রকাশ করা হল।
… ভারতবর্ষের একটা নকশা, … অল্প কথায় আপনাদের সামনে রাখতে চাই। স্বাধীনতা লাভের পরেও ভারতবর্ষের জনসাধারণের যে আকাঙক্ষা স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্যে ছিল– অর্থাৎ সর্বপ্রকার শোষণ থেকে মুক্তি, জনগণের কল্যাণের অর্থে সুখী-সমৃদ্ধশালী ভারতবর্ষ– তা আজও গড়ে ওঠেনি। পরন্তু, যা গড়ে উঠেছে তা হচ্ছে ভারতবর্ষের পুঁজিপতিশ্রেণির স্বার্থে একটি মজবুত শোষণমূলক অত্যাচারমূলক ‘সোসাল ইনজাস্টিস’-এর (সামাজিক অবিচারের) উপর ভিত্তি করে এমন একটি সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা– যা জগদ্দল পাথরের মতো আমাদের সমাজের বুকে, জনসাধারণের বুকের ওপর চেপে বসেছে। আর এই ব্যবস্থাটি এবং এই ঘটনাটিই হচ্ছে সমস্ত সামাজিক সমস্যা, যুবসমস্যা, সমাজপ্রগতির সমস্যার সামনে একটি প্রধান ঘটনা ও বাধাস্বরূপ। … আপনাদের সামনে যা কিছু সমস্যা তার মূল কারণই হচ্ছে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা। এ যদি আপনারা মেনে নেন, এবং যুক্তিবাদী হলে এ কথা অস্বীকার করার উপায়ও নেই, তা হলে কোনও প্রগতিশীল যুব আন্দোলনই শোষিত জনসাধারণের মূল রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন আন্দোলন হতে পারে না, ‘অ্যাপলিটিক্যাল মুভমেন্ট’ হতে পারে না। … এই যখন অবস্থা তখন হয় শোষকশ্রেণি, না হয় শোষিতশ্রেণি– এর কোনও একটির রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে নিজেদের যুক্ত হতেই হবে। আপনারা নিশ্চয়ই শোষকশ্রেণির রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ– কোনও ভাবেই নিজেদের যুক্ত করতে চান না। কাজেই আপনাদের যুব আন্দোলন এবং যে সাংস্কৃতিক আন্দোলন আপনারা পরিচালনা করছেন তার সামনে আজ মূল সমস্যা হচ্ছে, কী করে এই আন্দোলনগুলোকে দেশের শোষিতশ্রেণির শোষণমুক্তির বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে সংযুক্ত করা যায়।
একদল লোক যাঁরা বলেন, ছাত্র বা যুবসমাজ রাজনীতি বিমুক্ত হয়ে শুধুমাত্র সমাজকল্যাণের কথা ভাববে– তাঁদের সম্বন্ধে, তাঁদের সততা সম্বন্ধে সন্দেহ করার কারণ আছে। তাঁদের মধ্যে কিছু ‘জেনুইনলি কনফিউজড’ (সত্যিকারের বিভ্রান্ত) লোক থাকতে পারেন– সেটা বড় কথা নয়। কিন্তু তাঁদের এই প্রচারের পেছনে যে শ্রেণিউদ্দেশ্য কাজ করছে তা হচ্ছে, যুবসমাজ ও ছাত্রসমাজকে রাজনীতি বিমুখ করে তোলা। অথচ, গোটা দেশের সমস্যার সমাধানের প্রশ্নটি শোষিত শ্রেণিগুলির মূল রাজনৈতিক প্রশ্নের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমরা চাই বা না চাই, আমাদের ভাল লাগুক বা না লাগুক– কোনও ব্যক্তিবিশেষের রাজনীতি সম্বন্ধে খুব উন্নাসিক একটা বিরূপ মনোভাব থাকুক বা আর যাই হোক– এ বাস্তব ঘটনা। একমাত্র গায়ের জোর ব্যতিরেকে একে অস্বীকার করার উপায় নেই। যেমন, এ সমাজে যে বৈষম্য– এ তো একটা বাস্তব ঘটনা। সমাজ শ্রেণিবিভক্ত– এ একটা বাস্তব ঘটনা। আমরা বলছি বলে সমাজ শ্রেণিবিভক্ত, বা আমাদের মতো কিছু লোক মনে করে বলে ভারতবর্ষের সমাজটা শ্রেণিবিভক্ত– এ নয়। ভারতবর্ষের সমাজ ঐতিহাসিক কারণেই শ্রেণিবিভক্ত। আমরা চাই বা না চাই, আমাদের ভাল লাগুক বা না লাগুক– এ সমাজ শ্রেণিবিভক্ত হয়েছে ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে। এর একদিকে অত্যাচারিত, শোষিত, খেটেখাওয়া মানুষ– শ্রমিক, খেতমজুর, গরিব চাষি, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ (বুদ্ধিজীবী) সম্প্রদায়। অপর দিকে বড় বড় পুঁজিপতি, বড় বড় ব্যবসাদার, ধনী চাষি– এরা এবং এই শোষকশ্রেণির স্বার্থের অনুকূলে শাসনব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থার আমলাতান্ত্রিক শক্তি। এই শ্রেণিবিভাগ আমরা করিনি। এটা না হলে হয়তো ভাল ছিল। মালিক মজুর যদি ইতিহাসে সৃষ্টি না হত, আমরা আপত্তি করতাম না। ধনীচাষি, ভাগচাষি, খেতমজুর যদি সৃষ্টি না হত, আমরা আপত্তি করতাম না। আমরা চেয়েছি বলে এ জিনিস হয়নি। ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে হয়েছে। ফলে, দোষটা এখন আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে লাভ নেই। … এই বাস্তব সত্যকে সাহসের সাথে স্বীকার করতে হবে। এই সত্যকে বুঝে এর চরিত্র নির্ধারণ করতে হবে। এর মানে কী? মানে এই যে, শ্রেণিবিভক্ত সমাজের একদিকে শোষক আর একদিকে শোষিত– এই শোষক-শোষিতের মধ্যে যে নিয়ত সংগ্রাম চলছে, যা আমাদের বানানো কথা নয় এবং যা আমাদের চেতনানিরপেক্ষ ভাবেই প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে তা ইতিহাসের অমোঘ নিয়মেই সৃষ্টি হয়েছে। আর, এই সংঘর্ষে আবর্তিত হয়েই ভারতবর্ষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন প্রবাহিত হচ্ছে। ভারতবর্ষের ‘ইনটেলেকচুয়াল ফ্যাকাল্টি’, চিন্তাভাবনা, সামাজিক মনন– যা কিছু আমাদের মধ্যে আমরা দেখছি– তা এরই ‘সুপারস্ট্রাকচার’ (উপরিকাঠামো)– এই সংঘর্ষের ফলে সৃষ্টি এবং এই সংঘর্ষের দ্বারা আবর্তিত হয়ে চলেছে। সে-ক্ষেত্রে এই সংঘর্ষের সঠিক রূপ নির্ধারণ না করে আমরা এক পা-ও এগোতে পারি না। এগোবার চেষ্টা করলে তা হবে অন্ধের মতো চেষ্টা করা। আর, অন্ধ ভাবে এগোতে গেলে যা হয়, এইরকম ভাবে এগোতে গেলে ঠিক তাই হবে। আমাদের সবাইয়ের ক্ষেত্রে তাই হবে।
তাই, ভারতবর্ষের এই শোষক ও শোষিত দুই ভাগে বিভক্ত সমাজ, বিভক্ত জাতি– এই শ্রেণিবিভক্ত জাতির পটভূমিকায় সমস্ত আন্দোলনগুলোর গতিপ্রকৃতি নির্ণয় করতে হবে। এখানে একটা কথা আমি যুবকদের বলব যে, ‘দেশপ্রেম’, ‘দেশাত্মবোধ’, ‘দেশের ডাক’, ‘দেশের স্বার্থ’, ‘দেশের ঐক্য’– এইসব কথাগুলোর সাহায্যে দেশের প্রতিক্রিয়াশীলশ্রেণি, বুর্জোয়ারা বেশিরভাগ সময়ই যুবকদের দেশপ্রেমের সুযোগ নিয়ে বিপথে পরিচালিত করে থাকে। … দেশকে ভালবাসা একটা মহৎ কাজ সন্দেহ নেই– কিন্তু দেশকে ভালবাসছি বলে মালিকের পদলেহন করা কোনও মহৎ কর্ম নয়। দেশের স্বার্থের নামে মালিকশ্রেণির স্বার্থকে রক্ষা করে চলা, আর নিজে ভাবতে থাকা যে আমরা দেশকে খুব ভালবাসি, আমরা দেশসেবক– এটা কোনও মহৎ কর্ম নয়। এটা দেশের প্রতি চরম শত্রুতা, না জেনে হলেও চরম বিশ্বাসঘাতকতা এবং শেষ পর্যন্ত দেশের চরম অনিষ্টই এর দ্বারা সাধিত হয়। তাই আমি বলছি, ‘আমাদের দেশ’, ‘আমাদের জাতি’– যার সমস্যা নিয়ে আমরা আলোচনা করছি তা একটা অবিভাজ্য জাতি নয়, তা শ্রেণিবিভক্ত জাতি–যার একদিকে মালিকশ্রেণি, অপরদিকে মজুরশ্রেণি। তাই এখানে ‘জাতীয় ঐক্য’, ‘জনগণের ঐক্য’, ‘যুবকদের ঐক্য’–এই কথাগুলির দু’টি মাত্র সংজ্ঞা হতে পারে, দু’টি অর্থে এই কথাটা বাস্তবিকভাবে ব্যবহার করা চলে, তা হ’ল– হয় মালিকশ্রেণির স্বার্থে যুবকদের, জনগণের, দেশের মানুষের ঐক্য– আর না হয় মজুরশ্রেণির, শোষিতশ্রেণির স্বার্থে দেশের যুবকদের, দেশের জনসাধারণের, শোষিত মানুষের ঐক্য। ‘দেশের ঐক্য’–এই কথাটার শ্রেণিবিভক্ত সমাজে মাত্র এই দু’টি সংজ্ঞা হতে পারে বিজ্ঞানসম্মতভাবে। আর বাকি সব ব্যাখ্যা দেশের নামে লোককে ধাপ্পা দেওয়ার বুর্জোয়া চালাকি মাত্র। তাই শ্রেণিচরিত্রের এবং শ্রেণিস্বার্থের উল্লেখ না করে শুধু ‘দেশের সংহতি’ ও ‘দেশের স্বার্থ’ কথাগুলো বললে চলবে না, ‘দেশের জন্য লড়ছি’– এরকমভাবে বুঝলেও চলবে না, চলতে পারে না। ‘প্রিসাইজলি’ (যথার্থভাবে) আপনাদের বুঝতে হবে যে, ‘দেশের স্বার্থ’ বেশিরভাগ মানুষের স্বার্থের অর্থে কোন শ্রেণির স্বার্থের সাথে ঐতিহাসিকভাবে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যদি শোষিতশ্রেণির স্বার্থের সাথে, শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থের সাথে, কৃষক-খেতমজুরদের স্বার্থের সাথে, নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বার্থের সাথে দেশের স্বার্থের প্রশ্নটি মিলিত হয়ে গিয়ে থাকে, তবে এদেরই স্বার্থে দেশের আন্দোলন, যুবশক্তিকে পরিচালিত করা, যুবসমাজকে সুসংগঠিত করাই হবে দেশের কাজ করা। তাই ‘দেশের স্বার্থ’ কথাটার সাথে যুবকদের এই সুস্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার, এই বিচার থাকা দরকার যে, তাঁরা ভারতবর্ষের এই শ্রেণিবিভক্ত সমাজে দেশের স্বার্থ বলতে যে স্বার্থের ঝান্ডা নিয়ে চলতে চাইছেন সেটা শোষকশ্রেণির স্বার্থ, না শোষিতশ্রেণির স্বার্থ। এই বিচারটি সমাধা না করে ভাসাভাসাভাবে ‘দেশ’ ‘দেশ’ করলে আমরা বার বার মালিকশ্রেণির চক্রান্তে পা দেব, তাদের হাতে শিকার হব, ইচ্ছা না থাকলেও হয়তো তাদেরই স্বার্থ সংরক্ষণ করে বসে থাকব। এমন ঘটনা আগেও বহুবার ঘটেছে এবং ভবিষ্যতে আরও ঘটবে।
… আমি এই দৃষ্টিভঙ্গিতে সমস্ত জিনিসটা যুবসম্প্রদায়ের কাছে রাখতে চাইছি এইজন্য যে, শুধু পশ্চিমবাংলা বলে নয়, ভারতবর্ষ বলে নয়, গোটা পৃথিবীর সমস্ত আন্দোলনেই যুবসমাজ – শুধু মধ্যবিত্ত বা শিক্ষিত সম্প্রদায়ের যুবকদের কথা নয়– শ্রমিক-চাষি যুবক, ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে সকল যুবক-যুবতীদের সম্মিলিত শক্তিই এই আন্দোলনের আসল প্রাণশক্তি। বুড়োরা, হিসেবিরা, সনাতনপন্থীরা কোনও দিন সমাজে তুফান তুলতে পারেনি, সমাজের পরিবর্তন আনতে পারেনি, সামাজিক সমস্যা শেষপর্যন্ত সমাধান করার জন্য আন্দোলনে এগিয়ে আসেনি, বা আন্দোলন পরিচালনা করেনি। যারা সমাজকে পাল্টেছে, যারা সভ্যতাকে গড়ার জন্য বিপুল আন্দোলনের সৃষ্টি করেছে, তারা সব দেশেই যুবসম্প্রদায়। আর, এই যুবসম্প্রদায় শুধু মধ্যবিত্ত শিক্ষিত যুবসম্প্রদায় নয়, শোষিতশ্রেণির যুবসমাজ।
মনে রাখতে হবে, দেশের জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশ এই চাষী-মজুর যুবকেরা– তাদের বাদ দিয়ে শুধু শিক্ষিত যুবকেরা একটা চিন্তা, একটা ভাবনা, একটা আলোড়ন, একটা আদর্শবাদ শুধুমাত্র এনে দিতে পারেন– কিন্তু আন্দোলনের প্রচণ্ড তুফান এবং জোয়ার এদের বাদ দিয়ে আপনারা সৃষ্টি করতে পারেন না। দেশব্যাপী বিরাট যুব আন্দোলন আপনারা সৃষ্টি করতে পারেন না চাষী-মজুর যুবক-যুবতীদের বাদ দিয়ে। তাই চাষি-মজুর ঘরের যুবকদেরও ব্যাপকভাবে যুব আন্দোলনের মধ্যে টেনে আনবার কথা আপনাদের অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে ভাবতে হবে।