
১৫ মে। রাজ্যের শিক্ষা দপ্তরের সামনে মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে শিক্ষকের। পা ভাঙার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন দিদিমণি। চোখের আঘাতে অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছেন শিক্ষক। পুলিশ লাঠিপেটা করতে করতে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মাটিতে লুটিয়ে দিচ্ছে। এক শিক্ষিকাকে ১০-১২ জন বীরপুঙ্গব পুলিশকর্মী চ্যাংদোলা করে সরিয়ে দিচ্ছে। নিরস্ত্র শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের মেরে লাঠি ভেঙে ফেলছে পুলিশ। সঙ্গে অশ্লীল গালাগাল। অফিসার থেকে কনস্টেবল সকলের চোখেমুখেই যেন এক তীব্র ঘৃণা! তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়ছেন কাদের উপরে? যে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীরা দিনের পর দিন পরিশ্রম করে যোগ্যতা অর্জন করেছেন, চাকরির পরীক্ষা দিয়ে তা পেয়েছেন।
রাজ্যের সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার ভেঙে পড়া পরিকাঠামোর মধ্যেও সাত-আট বছর ধরে স্কুলে যোগ্যতার সাথে পড়িয়েছেন। এর আগে কসবার ডি আই অফিসে পুলিশ লাথি মেরেছিল। শিক্ষকদের এবার জুটল লাঠির বাড়ি।
পুলিশের লাঠিতে ৯ জন শিক্ষকের মাথা ফেটেছে আরও ১০ জনের, আঘাত অত্যন্ত গুরুতর। কয়েকজনের হাত কিংবা পা ভেঙেছে, একজনের চোখ নষ্ট হওয়ার উপক্রম। আহত হয়েছেন শতাধিক। পুরুলিয়ার শিক্ষক সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, দক্ষিণ ২৪ পরগণার রজত হালদার, জয়তী হালদার, শিক্ষক দুলাল মুর্মুর মতো অনেকেই মারাত্মক জখম হয়েছেন। কিন্তু দেখা গেল সরকারের মন্ত্রীরা শিক্ষকদের উদ্দেশেই নানা কটূক্তি ছুঁড়ে দিয়েছেন, রাজ্যের পুলিশ কর্তা বলে দিলেন তাঁরা নাকি ‘ন্যূনতম বলপ্রয়োগ ‘ করেছেন। মানুষ পাল্টা প্রশ্ন করেছে, এই যদি ‘ন্যূনতম’-র নমুনা হয়, লাঠিচার্জ তবে কাকে বলে? পুলিশ কি শিক্ষকদের মৃত্যু চেয়েছিল? দেখা গেছে পুলিশ আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়েছে। অথচ ওইদিন শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের একদল দুষ্কৃতী পুলিশের পাশে থেকেই বারবার শিক্ষকদের আঘাত করেছে। রাতে বাইক বাহিনী নিয়ে এসে হুমকি দিয়েছে, পুলিশ ছিল নিছক দর্শক। সরকার বলেছে, লাঠিচার্জের আগে তাঁরা নাকি সাত ঘণ্টা অপেক্ষা করেছেন! তাঁরা নাকি আটকে থাকা সরকারি কর্মীদের বার করে নিয়ে যেতেই লাঠি চালিয়েছেন। যদিও ওই বিকাশ ভবনে বসেই দিনের পর দিন চুরির ব্যবস্থা করে মন্ত্রী আমলারা বাড়িতে গিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছেন। শিক্ষকরা দীর্ঘ দিন অপেক্ষা করে বসে ছিলেন, রাজ্য সরকার দুর্নীতিগ্রস্তদের তালিকা আদালতে বলে দিয়ে, ওএমআর শিটের সঠিক কপি প্রকাশ করে সমস্যার সমাধান করবে এই আশায়। সরকার তা করেনি কেন? শিক্ষামন্ত্রী এই বিকাশ ভবনে বসেই ওএমআর শিট প্রকাশের জন্য শিক্ষকদের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিলেন কেন? দিনের পর দিন চুরি করতে দিয়েছেন যে কর্তারা, তাঁরা বিকাশ ভবনের ঘেরাটোপে পুলিশি নিরাপত্তায় বসে থাকতে পেরেছেন কী করে?
২০১৬ সালের স্কুল সার্ভিস কমিশনের প্রথম এসএলএসটি-র মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীরা তাদের চাকরি ফেরানোর দাবিতে ৭ মে থেকে বিকাশ ভবনের সামনে লাগাতার অবস্থান চালিয়ে আসছিলেন। কিন্তু রাজ্য সরকারের কোনও প্রতিনিধি তাঁদের সাথে সাক্ষাৎ করার সৌজন্যতাটুকুও দেখাননি। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর নানা রকম কথা সরকার বলেছে, অথচ সমাধানের কোনও রাস্তা তারা দেখায়নি। কারণ তাতে যে অযোগ্যদের কাছ থেকে বিপুল টাকা কামিয়েছেন শাসক দলের স্তরে স্তরে নেতারা, তা ফেরত দেওয়ার চাপ আসবে। এই অযোগ্যদের বাঁচানোটা এখন তৃণমূল নেতৃত্বের পবিত্র ‘সরকারি কর্তব্য’ হয়ে দাঁড়িয়েছে! সেই কারণে মুখ্যমন্ত্রী তড়িঘড়ি নেতাজি ইন্ডোরে সভা ডেকে কিছু ভাসা ভাসা কথা বলে ক্ষতে পুলটিশ লাগানোর চেষ্টা করেছিলেন। ফলে রাস্তায় নামাই এখন চাকরিহারা শিক্ষকদের একমাত্র রাস্তা। তাঁরা বাধ্য হয়েই ১৫ মে বিকাশ ভবন ঘেরাওয়ের ডাক দিয়েছিলেন। ওই দিন সকাল থেকেই বিকাশ ভবনের গেটগুলোতে শান্তিপূর্ণ অবস্থান চালাচ্ছিলেন হাজার হাজার শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী। এই আন্দোলন ভাঙার জন্য প্রথমে শাসক দলের এক নেতা এবং তাঁর গুন্ডাবাহিনী শিক্ষকদের আক্রমণ করে। ঘুষি, লাথি এমনকি হেলমেট দিয়ে মারতে থাকে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের। পুলিশ যথারীতি নীরব থেকে গুণ্ডামিতে সাহায্যই করেছে।
উল্লেখ্য, শুরু থেকেই রাজ্য সরকার ও তার সংস্থা এসএসসি, মধ্যশিক্ষা পর্ষদ দুর্নীতিগ্রস্তদের বাঁচানোর খেলায় নেমেছে। তাই কারা প্রকৃত নিজের যোগ্যতায় চাকরি পেয়েছে, আর কারা দুর্নীতিতে যুক্ত, তার সঠিক তথ্য সরবরাহ করেনি সঠিক সময়ে। সিবিআইও তা বার করার চেষ্টা করেনি। কারণ কেন্দ্রে বিজেপি সরকার তাদের তা করতে দেয়নি, পাছে দেশের অন্যত্র মধ্যপ্রদেশের ‘ব্যাপম’ কিংবা গুজরাট, মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ বা ত্রিপুরার মতো বিজেপি শাসিত রাজ্যের চাকরি দুর্নীতি নিয়ে প্রকৃত তদন্তের দাবি উঠতে থাকে। অন্য দিকে সুপ্রিম কোর্টও সিবিআই এবং রাজ্য সরকারকে বাধ্য করেনি প্রকৃত সত্য সামনে আনতে। চাল থেকে কাঁকর বাছার পরিশ্রম কেউই না করায় সৎ মানুষের চাকরি গেছে, যারা দুর্নীতি করল, টাকা নিয়ে চাকরি বেচল তাদের গায়ে কোনও আঁচড় পড়ল না। অন্য দিকে সিপিএম ও বিজেপির মতো বিরোধী দল আশা করেছে সব টালমাটাল করে দিতে পারলে তাদের ভোট রাজনীতিতে সুবিধা হবে। তাই তারা প্রথম থেকে চেয়েছে যোগ্য-অযোগ্য বাছাই করার দরকার নেই– সবার চাকরি বাতিল হোক। শুধু সিপিএম নেতা বিকাশ ভট্টাচার্যই সব শিক্ষককে ‘ফ্রড’ বলেননি, তাদের দলীয় শিক্ষক সংগঠন, ছাত্র সংগঠন সকলেই প্রথম থেকে এই দাবি করেছে। বিজেপির বর্তমান সাংসদ, একদা বিচারপতিও তাই চেয়েছিলেন। আর সকলের চাকরি বাতিলে বিজেপি নেতাদের উল্লাসে তো এই কথাটা এখন স্পষ্টই। ফলে নিরপরাধ শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীরা নিজেদের যোগ্যতায় ৭-৮ বছর চাকরি করার পর তাদের পথে বসিয়ে দেওয়ার দায়ভার যেমন সবচেয়ে বেশি রাজ্য সরকারকেই নিতে হবে, তেমনই এই সব বিরোধী দলগুলির নেতাদের দায়ও একেবারে কম নয়।
সরকারের চুরির দায়ে গ্রুপ-সি, গ্রুপ-ডি কর্মীদের চাকরিও সম্পূর্ণভাবে চলে গেছে। তার দায়ভার না নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী তাদের মাসিক ২৫ হাজার টাকা বা ২০ হাজার টাকা ভাতাজীবী করতে চেয়েছেন, যা কোনও ভাবেই মানা যায় না। শিক্ষক নিগ্রহের নির্মম ঘটনার পরেই এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) দলের রাজ্য সম্পাদক চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য পুলিশের আচরণের তীব্র ধিক্কার জানান এবং পরের দিন ১৬ মে রাজ্যজুড়ে প্রতিবাদ দিবসের ডাক দেয় দল। কলকাতা সহ রাজ্যের প্রান্তে প্রান্তে দলের পক্ষ থেকে বিক্ষোভ মিছিল সংগঠিত হয়। কলকাতার কলেজ স্ট্রিট থেকে এসপ্ল্যানেডে মিছিলে নেতৃত্ব দেন রাজ্য সম্পাদক ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। ছাত্র-যুবরাও বিক্ষোভে নামে। শিক্ষকদের পক্ষ থেকে করুণাময়ী সহ অন্যত্র বিক্ষোভ মিছিল সংগঠিত হয়। ভুক্তভোগী আন্দোলনকারীরা বিকাশ ভবনের সামনে ১৬ মে ধিক্কার সভার ডাক দেন। এই সভায়় বিশিষ্ট চিকিৎসক বিনায়ক সেন, সাংবাদিক দিলীপ চক্রবর্তী, সমাজকর্মী মীরাতুন নাহার, আরজিকর আন্দোলনের অন্যতম মুখ ডাঃ অনিকেত মাহাতো, অধ্যাপক দেবব্রত বেরা, রাত জাগো আন্দোলনের কর্মী শিক্ষিকা শতাব্দী দাস, বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব প্রদোষ পাল, ডাক্তার দেবাশীষ হালদার, শিক্ষক নেতা বাসুদেব দাস, অধ্যাপক শান্তনু রায় প্রমুখ উপস্থিত হয়ে পুলিশি অত্যাচারের প্রতিবাদ জানান। এই সভায় রাজ্যের বিরোধী দলনেতা এবং সিপিআইএমের এক নেতা সংহতি জানাতে গেলে তাঁদের ও তাঁদের দলের শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের স্বার্থবিরোধী ভূমিকা তুলে ধরে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন আন্দোলনকারীরা। ১৭ মে স্কুল ছাত্র-ছাত্রীরা অবস্থান মঞ্চে উপস্থিত হয়ে তাদের শিক্ষকদের প্রতি এই অপমানজনক আচরণের নিন্দা করে। রাজ্যের সর্বত্র ধিক্কার মিছিল করে এআইডিএসও। ১৯ মে এআইডিএসও-র ডাকে হয় সারা বাংলা ছাত্র ধর্মঘট।
চাকরিহারা শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের আন্দোলন আজ জনসাধারণের আন্দোলন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষ রুখে দাঁড়ানোর পথে এগোচ্ছেন। যতক্ষণ না দাবি আদায় হয় আন্দোলনে অনড় থাকছেন ভুক্তভোগীরা। এই আন্দোলন যাতে ভোট রাজনীতির কারবারিদের দ্বারা বিপথগামী না হয়, এ বিষয়ে সচেতন থেকে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত প্রতিবাদ প্রতিরোধ আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। সাধারণ মানুষকেও আরও বেশি করে এদের পাশে দাঁড়াতে হবে। তা না হলে তাদের ঘরের সন্তানদের লেখাপড়া আরও বিপন্নতায় পড়বে। এ শুধু চাকরিহারা শিক্ষকদের আন্দোলন নয়, এ আন্দোলন শিক্ষা ও শিক্ষক বাঁচানোর আন্দোলন।
এই লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৪১ সংখ্যা ২৩ – ২৯ মে ২০২৫ এ প্রকাশিত