২০ অক্টোবর আন্দোলনকারী টেট চাকরিপ্রার্থীদের উপর তৃণমূল সরকারের পুলিশের যে অত্যাচার হয়েছে তার প্রতিবাদে সমাজের সর্বস্তরেই নিন্দার ঝড় উঠেছে৷ গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে ধবংস করতে সব সরকারই নানা অজুহাতে পুলিশকে ব্যবহার করে৷ এই ক্ষেত্রেও রাজ্য সরকার ১৪৪ ধারা ও আদালতের কিছু মন্তব্যকে হাতিয়ার করেছে৷
অতীতেও পশ্চিমবঙ্গবাসী এমন ঘটনার সাক্ষী থেকেছে৷ সারা ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে দেখলেও এমন অনেক চিত্র দেখা যাবে যেখানে সরকারগুলি গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে প্রতিহত করতে আন্দোলনকারীদের মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করেছে কিংবা নামিয়ে এনেছে নানা নির্যাতন৷ দিল্লির রাজপথে কৃষি বিল প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলনকারী কৃষকদের উপর পুলিশ ও শাসক দল বিজেপি সমর্থকদের অত্যাচারের ঘটনা সবার জানা৷
১৯৫৯ সালে রাজ্যে খাদ্য সংকট মোকাবিলার দাবিতে কংগ্রেসী সরকারের বিরুদ্ধে বামপন্থী দলগুলোর নেতৃত্বে তৈরি হয় ‘মূল্যবৃদ্ধি ও দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটি’৷ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় শুরু হয় খাদ্যের দাবিতে আন্দোলন৷ এরপর আসে সেই ঐতিহাসিক দিন ৩১ আগস্ট৷ খাদ্যের দাবি ও পুলিশি দমন–পীডনের প্রতিবাদে হাজার হাজার মানুষের শান্তিপূর্ণ মিছিলে সরকারের নির্দেশে নেমে আসে নির্মম পুলিশি অত্যাচার৷ বেপরোয়া লাঠিচার্জ ও টিয়ার গ্যাস চার্জে মৃত্যু হয় ৮০ জনের, আহত শতাধিক৷ পরের দিন ১ সেপ্টেম্বর মৃত্যুর জবাব চাইতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ থেকে হাজার হাজার ছাত্রদের মিছিলে পুলিশের লাঠি ও গুলিতে মারা যায় ৮ জন, আহত ৭৭ জন৷ এইসমস্ত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ৩ সেপ্টেম্বর পালিত হয় সাধারণ ধর্মঘট ও হরতাল৷ ওই দিনও পুলিশ গুলি চালানোয় মারা যায় ১২ জন, আহত হয় ১৭২ জন৷ স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এমন নৃশংস পুলিশি আক্রমণের ঘটনা বিরল৷ সিপিএম সরকারের আমলে নেমে এসেছে আক্রমণ৷ পশ্চিমবঙ্গে ১৯৭৯ সালের ১৫ জুন এসইউসিআই (সি) দলের আইন অমান্যে বর্বর আক্রমণ চালায় পুলিশ৷ ১৯৮৩–তে এস ইউ সি আই (সি)–র ডাকে বাসভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলনে পুলিশ গুলি চালালে কলকাতা ও পুরুলিয়া মিলিয়ে তিনজন শহিদ হন ১৯৯০ সালে এস ইউ সি আই (সি) কর্মী মাধাই হালদার শহিদ হয়েছেন পুলিশের গুলিতে৷ ২০০৭–এ বিদ্যুৎগ্রাহকদের আন্দোলনে পুলিশের গুলি চলেছে৷ ২০০৬–এর ২৫ সেপ্টেম্বর টাটার স্বার্থে জোর করে জমি অধিগ্রহণের প্রতিবাদে সিঙ্গুর বিডিও অফিসের সামনে কয়েক হাজার কৃষকের অবস্থানে পুলিশের অত্যাচারে ২১ বছরের তরতাজা যুবক রাজকুমার ভুল শহিদ হন৷ ২০০৭–এর ১৪ মার্চ নন্দীগ্রামের কৃষকদের উপর পুলিশ গুলি চালায় এবং ১৪ জনের মৃত্যু হয়৷
গণতান্ত্রিক আন্দোলনে পুলিশের ভূমিকা কেমন হবে এ সম্পর্কে কংগ্রেস, সিপিএম, তৃণমূল কংগ্রেস, বিজেপি প্রভৃতি রাজনৈতিক দল যারা সরকারে গেছে তাদের অবস্থান এক৷ ব্যতিক্রম এসইউসিআই(সি)৷ পশ্চিমবঙ্গে প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকারের শ্রমমন্ত্রী এই দলের নেতা সুবোধ ব্যানার্জী, শিবদাস ঘোষের চিন্তার ভিত্তিতে ১৯৬৭ সালের মে দিবসে, শহিদ মিনারের সভায় এক ঐতিহাসিক বক্তব্যে বলেন, ‘পুলিশকে এই মর্মে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, তারা ন্যায়সঙ্গত গণতান্ত্রিক ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে নিয়ম ও শৃঙ্খলা রক্ষার অজুহাতে যেন দমন না করে৷’ তাঁর দলের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বামপন্থীরা সরকারে গেলেও পুলিশ দিয়ে আন্দোলনকে দমন করবে না৷ শুধু তাই নয়, মালিক ও সমাজবিরোধী শক্তির অন্যায় আক্রমণ থেকে এই সব আন্দোলনগুলিকে রক্ষাও তারা করবে৷ এটাই একটা বুর্জোয়া ব্যবস্থার সেবাদাস সরকার এবং যথার্থ বামপন্থী দলের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে পার্থক্য৷
যিশু সামন্ত
খানাকুল, হুগলি