Breaking News

বিশ্বকাপের স্টেডিয়ামে লেগে আছে ভারতীয় শ্রমিকদের রক্তের দাগ

এবার ফুটবল বিশ্বকাপের আসর বসতে চলেছে কাতারে৷ নতুন স্টেডিয়াম বানাতে খরচ হয়েছে ছশো কোটির কিছু বেশি৷ চালকবিহীন অত্যাধুনিক মেট্রো ব্যবস্থার জন্য ছত্রিশশো কোটি৷ এয়ারপোর্ট থেকে দোহা শহর পর্যন্ত হাইওয়ে ঝলমল করছে সদ্য বসানো স্ট্রিট লাইটের আলোয়৷ সব মিলিয়ে ফুটবল বিশ্বকাপ–২০২২ এর বাজেট তিরিশ হাজার কোটি টাকা৷ বিশ্ব ফুটবলের নিয়ামক সংস্থা ফিফার কর্তা এবং কাতারের আয়োজকরা এক সুরে বলছেন, বিশ্বকাপের ইতিহাসে এমন বিরাট কর্মকাণ্ড আগে কখনও হয়নি৷ কাতারে এই ‘অভূতপূর্ব’ বিশ্বকাপ যেদিন শুরু হবে, তার ঠিক এক বছর আগে, গত বছরের নভেম্বরে, দক্ষিণ ভারতের তেলেঙ্গানার গ্রামে বসে লতা বোল্লাপল্লী একটা ফোন পেলেন৷ অত্যন্ত নিরুত্তাপ গলায় তাঁকে জানানো হল, তাঁর স্বামী মধু হার্টফেল করে মারা গেছেন৷ ক’দিন পর মধুর কফিন–বন্দি দেহ এল, সাথে পাওনা মাইনের যৎসামান্য টাকা, যা দিয়ে আজকের দিনে দু’মাসও সংসার চলে না৷ বছর চল্লিশের মধু কাতার গিয়েছিলেন বিশ্বকাপের নির্মাণ শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে, যেমন গিয়েছিলেন অখিলেশ, রমেশ, জগন, পদ্মশেখর, আব্দুল মজিদের মতো অনেকেই৷ কেউ কলমিস্ত্রী, কেউ ডেলিভারি শ্রমিক, কেউ নির্মাণ শ্রমিক হয়ে দিনরাত অমানুষিক পরিশ্রম করছিলেন৷ ওরা ফিরলেন না, কফিনে মোড়া দেহগুলো ফিরল বিহার, পাঞ্জাব, তেলেঙ্গানার গ্রামে৷ অতিমারির কল্যাণে ‘পরিযায়ী শ্রমিক’ শব্দটার সাথে পরিচয় ঘটেছিল অনেকেরই৷ দেশজুড়ে হঠাৎ ঘোষিত লকডাউনের অচলাবস্থার মধ্যে তাঁদের অসহায়তার ছবি ডঠে এসেছিল সংবাদপত্রের শিরোনামে৷ মাইলের পর মাইল হেঁটে বাড়ি ফিরতে গিয়ে পথশ্রমে, অসুস্থতায়, অনাহারে, পথ দুর্ঘটনায় অসংখ্য শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন সেই সময়৷ আরও কতজন কাজ হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন, দেশের বেকারত্ব আর দারিদ্রের ঊর্ধ্বমুখী গ্রাফ দেখলে তার কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যায়৷ কেউ আগেই, কেউ অতিমারির ধাক্কা সামলে উঠতে একটু ভালো রোজগারের আশায় বুক বেঁধে অজানা অচেনা দেশে গিয়েছিলেন৷ ২০১০–এ কাতার বিশ্বকাপের ঘোষণার পর থেকে এই বিপুল কর্মকাণ্ডের জন্য সেখানে শ্রমিকের চাহিদাও বেড়েছে৷ লোকসভার রেকর্ড অনুযায়ী, গত তিন বছরেই ভারত থেকে কাতারে গেছেন এমন শ্রমিকের সংখ্যা ৭২ হাজার ১১৪৷

বাইশ বছরের অখিলেশ কুমার গিয়েছিলেন বিহার থেকে৷ কোনও একটি স্টেডিয়ামের কাছে মাটির তলায় জলের পাইপ ঠিক করার সময় মাটি ধসে মৃত্যু হয়েছে অখিলেশ এবং তাঁর বত্রিশ বছরের সহকর্মী জগনের৷ এই মর্মান্তিক মৃত্যুর থেকেও ভয়ানক মালিকদের ঔদাসীন্য৷ কোনও ক্ষতিপূরণ পাওয়া তো দূরের কথা, মৃত মানুষগুলোর বাড়িতে একটা খবর দেওয়ারও প্রয়োজনও তারা মনে করেননি৷ অখিলেশের স্ত্রী গ্রামে বসে স্বামীর মৃত্যুসংবাদও পেয়েছেন অন্য এক পরিচিত বন্ধুর মারফত৷ গ্রামে একটা বাড়ি করার স্বপ্ন ছিল তেলেঙ্গানার রমেশের৷ অর্ধেক তৈরি হওয়া বাড়িটা পুরো করবেন বলে টাকা ধার করে গিয়েছিলেন কাতারে৷ রাস্তা বানানোর কাজ করছিলেন, বিশ্বকাপ স্টেডিয়ামে যাওয়ার ঝকঝকে রাস্তা৷ শ্রমিকদের ক্যাম্পে একটা দমবন্ধ করা একচিলতে ঘরে পাঁচজন গাদাগাদি করে থাকা, পঞ্চাশ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মারাত্মক দাবদাহে, প্রচণ্ড ধুলোর মধ্যে সারাদিনের অমানুষিক পরিশ্রম৷ রমেশের শরীর এই ধকল নিতে পারেনি, তাঁর মৃত্যুর পর কোম্পানি শুধু সে মাসের মাইনেটা দিয়ে হাত গুটিয়ে নিয়েছে৷ ষাট হাজার আসনের যে চোখধাঁধানো আল–বেইট স্টেডিয়াম কাতার বিশ্বকাপের অন্যতম আকর্ষণ, সেখানে টানেল বানাতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন জলেশ্বর প্রসাদ, দু ঘন্টা পরে মৃত্যু৷ কোনও ময়নাতদন্ত ছাড়াই তাঁর নামে লেখা হয়ে গেছে ২০১৬ থেকেই ‘শ্বাসের সমস্যা এবং হার্ট ফেলিওর’৷ কর্তৃপক্ষের রিপোর্টে একটা সংখ্যা হয়ে থেকে গেছেন জলেশ্বর৷

কী ভাবে কোন অবস্থায় এই শ্রমিকরা মারা যাচ্ছেন, পেটের ভাত জোটাতে কতটা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাঁদের কাজ করতে হচ্ছে, এ সব প্রশ্ন যাতে উঠতেই না পারে তার জন্য কর্তাব্যক্তিরা এই সহজ রাস্তা নিয়েছেন৷ পোস্টমর্টেম, তদন্ত কোনও কিছুর তোয়াক্কা না করে এইসব মৃত্যুর গায়ে ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ বা হার্ট অ্যাটাকের তকমা দিয়ে দেওয়া হচ্ছে৷ হঠাৎ করে এতগুলো মানুষের এমন অস্বাভাবিক ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ ঘটছে কেন, তার কোনও সদুত্তর নেই৷ এমনকী বিশ্বকাপের কাজ করতে গিয়ে চল্লিশ জন পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যুর যে তথ্য আয়োজনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার রিপোর্টেই এসেছে, তাকেও অনায়াসে অস্বীকার করে ফিফার প্রেসিডেন্ট  জানিয়েছেন, কাজ করতে গিয়ে এরকম মৃত্যু ঘটেছে মাত্র তিনজনের৷ বাকি সাঁইত্রিশটা তরতাজা প্রাণ তা হলে শেষ হয়ে গেল কী ভাবে? যারা এইসব শ্রমিকদের নিয়োগ করেছিলেন, যাদের কর্মচারী হয়ে এঁরা উদয়াস্ত খাটছিলেন তাঁদের কি কোনও দায়িত্বই ছিল না এই মানুষগুলোর প্রতি, তাদের পরিবারের প্রতি? এ সব প্রশ্ণের উত্তর দেওয়ার দায় নেই বিশ্বসেরা বিশ্বকাপের ব্যস্ত আয়োজকদের৷

সংবাদপত্র, মানবাধিকার সংগঠনের বেশিরভাগ চিঠি, মেইল–এর কোনও সন্তোষজনক উত্তর আসেনি৷ দোহার ভারতীয় দূতাবাসও ‘এ সংক্রান্ত তথ্য নেই’ বলে দিয়ে দায় সেরেছে৷ দেশের মাটিতেই যে সরকার পরিযায়ী শ্রমিকদের সাথে অমানবিক আচরণ করেছে, তাদের ন্যূনতম সুরক্ষার দায়িত্ব নেয়নি, সেই ভারত সরকার কাতারের মাটিতে এই ভারতীয় শ্রমিকদের মৃত্যু নিয়ে কিছু করবে, এমন আশা করাই বাহুল্য৷ পুঁজিবাদী অর্থনীতির মুনাফাকেন্দ্রিক চরিত্র বোঝাতে মার্ক্স বলেছিলেন, মালিক শ্রমিককে ততটুকুই মজুরি বা নিরাপত্তা দেয় যতটুকু দিলে সে খেয়ে–পরে বেঁচে থেকে মালিকের মুনাফা ওঠানোর কাজটুকু করতে পারে৷ আজকের মুমূর্ষু সংকটাপন্ন পুঁজিবাদ আরও ভয়ঙ্কর৷ শ্রমিককে বাঁচিয়ে রাখার দায়ও আজ মালিকের নেই, একজন শ্রমিক মারা গেলে হাজার হাজার কর্মহীন শ্রমিক অপেক্ষমান৷ তাই ফুটবল–বিনোদনের প্যাকেজের দাম তিরিশ হাজার কোটি,  শ্রমিকের জীবনের দাম কানাকড়িও নয়৷ কাতার হোক বা ভারতবর্ষ বা আমেরিকা, নিষ্ঠুর শোষণের ছবিটা কমবেশি একইরকম৷ অনেক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত শ্রমিকের অধিকার, শ্রম আইন এসবও আজ কথার কথা, মালিকের স্বার্থে আইনকেও এ সমাজে দিব্যি পাল্টে নেওয়া যায়৷

২০ নভেম্বর বিশ্বকাপ ফুটবল শুরু হবে, দুনিয়া জুড়ে লক্ষ কোটি ফুটবলপ্রেমী টিভির পর্দায়, অনেকে কাতারের নবনির্মিত স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখবেন, দর্শকদের প্রবল উচ্ছ্বাস–উল্লাসে ফেটে পড়বে মাঠ৷ আর তেলেঙ্গানার কোনও অখ্যাত গ্রামে বসে বিড়ি বাঁধতে বাঁধতে লতার চোখ ভিজে উঠবে স্বামীর হাসিমুখ মনে করে৷ আধখানা হওয়া বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে বাবার কথা মনে করে রমেশের ছেলে শ্রবণের বুক ভেঙে উঠে আসবে দীর্ঘশ্বাস, জগনের বাবা কান্না চেপে জোয়ান ছেলের শেষবার দেখা মুখটার কথা জোর করে ভুলে যেতে চাইবেন৷ বিশ্বকাপের জৌলুসে যেন ভুলে না যাই সেই দধিচিদের কথা, যাদের হাড় দিয়ে তৈরি হয় এই তথাকথিত সভ্যতার ইমারত৷ ওদের রক্ত মাখানো আছে শুধু স্টেডিয়ামগুলোতে নয়, গোটা পুঁজিবাদী সমাজটার গায়েই তো এই শ্রমিকের রক্তের দাগ৷ তাই সে সমাজের স্বপ্ন যেন দেখতে পারি– যেখানে মানবসভ্যতার অনন্য সৃষ্টি শিল্প–সুষমামণ্ডিত খেলা ফুটবলে কোনও মানুষের চোখের জল লেগে থাকবে না৷