নরেন্দ্রনাথ মিত্র তাঁর ‘এক পো দুধ’ গল্পে চার আনা দামের এক পো দুধকে ঘিরে বিনোদ-লতিকার ছোট্ট নিম্নমধ্যবিত্ত সংসারের জীবন-যন্ত্রণা আর মূল্যবোধের ছবি এঁকেছিলেন সেই ১৯৫২ সালে। স্বাধীন ভারতের বয়স বেড়েছে আরও সত্তর বছর। অথচ ধনধান্যপুষ্পে ভরা এই দেশে বিনোদ-লতিকাদের সংসারের অবস্থা আজ আরও মর্মান্তিক। সেদিনের সত্তর-পঁচাত্তর টাকা মাইনের কেরানি বিনোদ আজ যদি কুড়িয়ে বাড়িয়ে হাজার দশ-পনেরোও হাতে পায়, স্বাস্থ্যসম্মত পুষ্টিকর খাবার তো দুরের কথা, রোজের ওই ভাত-রুটি-ডাল-চচ্চড়িটুকু জোটাতেই নাভিশ্বাস তাদের। চাল ডাল তেল আলু পেঁয়াজ টমেটো লঙ্কা থেকে এমন কোনও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস নেই, গত তিন চার বছরে যার দাম অবিশ্বাস্য হারে বাড়েনি। ভোজ্য তেলের দাম গত সাত-আট মাসে লিটার প্রতি দুশো ছুঁয়েছে। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি যখন ‘গণতন্ত্রের মন্দির’ পার্লামেন্টে মাথা ঠেকিয়ে ক্ষমতার মসনদে বসছেন, তখন থেকে আজ পর্যন্ত ন বছরের মোদি জমানায় রান্নার গ্যাস সিলিন্ডারের মতো একটি অপরিহার্য জিনিসের দাম ৪১০ টাকা থেকে বেড়ে ১০০০ ছাড়িয়েছে। গরিব মানুষ যে গ্যাস ছেড়ে কেরোসিনে ফিরবেন, তার দামও গত দু বছরে প্রতি লিটার প্রায় পাঁচগুণ বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে সাড়ে বিরাশি টাকা।
জীবনধারণের জন্য অত্যাবশ্যকীয় সমস্ত জিনিসের দাম যখন ক্রমাগত এমন ঊর্ধ্বমুখী, তখন আয়ের সূচক হাঁটছে উল্টোপথে। খোদ প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক উপদেষ্টা পরিষদের সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, কাজ আছে এমন মানুষের পনের শতাংশ মাসে পাঁচ হাজার টাকারও কম আয় করেন। ‘ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি রিপোর্ট ২০২২’-এর তথ্য অনুযায়ী, দারিদ্র এবং বৈষম্যের নিরিখে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা দেশগুলোর মধ্যেও ভারতের স্থান প্রথম দিকে, যেখানে ২০২১-এর মোট জাতীয় আয়ের ৫৭ শতাংশ এবং ২২ শতাংশ আছে যথাক্রমে ১ শতাংশ এবং ১০ শতাংশ লোকের হাতে। আর নিচের তলার ৫০ শতাংশ মানুষের কপালে জুটেছে এই আয়ের মাত্র ১৩ শতাংশ। গত দু-বছরের অতিমারির ধাক্কায় অসংখ্য মানুষ কাজ হারিয়েছেন, বহু মানুষের রোজগার কমে গেছে, কত পরিবারের একমাত্র রোজগেরে মানুষটিকে কেড়ে নিয়েছে করোনার থাবা। বিশ্বব্যাঙ্কের হিসেব বলছে, ২০২১-এ বিশ্বে নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন অন্তত আট কোটি মানুষ। বাস্তবে এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি।
অশোধিত তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, জ্বালানি বিদ্যুতের মূল্য বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। তৈলবীজ, খাদ্যপণ্য কোনওটাই বাদ নেই। সরকারি হাসপাতালে অপ্রতুল বেড, অসুস্থ রোগী নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন দিয়ে দাঁড়ানো, বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু, স্বাস্থ্যসাথী কার্ড নিয়ে দুর্নীতি, বেসরকারি হাসপাতালের বিপুল খরচ তো ছিলই, তার ওপর জ্বলন্ত কড়াই থেকে উনুনে ছুড়ে দেওয়ার মতো করে ৮০০টি অতি প্রয়োজনীয় জীবনদায়ী ওষুধের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে কেন্দে্রর বিজেপি সরকার। সরকারি হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দে্র বিনামূল্যের ওষুধের তালিকা থেকে ২৮৩টি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ওষুধ বাদ দিয়ে দিয়েছে রাজ্যের তৃণমূল সরকার। গত বছরে প্রকাশিত পঞ্চম জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা বলেছিল, অর্ধেকের বেশি মহিলা রক্তাল্পতায় ভুগছেন, তিন জনের মধ্যে একজন শিশু অপুষ্টির শিকার। এ বছরের চিত্র নিশ্চিতভাবেই আরও ভয়াবহ হবে।
অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির আঁচে যখন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোই জেরবার, সেখানে দেশের কোটি কোটি দরিদ্র মানুষ, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক, গরিব চাষি মজুর কী ভাবে বেঁচে আছেন, তা বুঝে নিতে কষ্ট হয় না। পথেঘাটে বাসে ট্রেনে পাড়ার মোড়ে বাজারে চা দোকানে সর্বত্র দেখা যায় অজস্র শীর্ণ বিধ্বস্ত মুখ, দুশ্চিন্তায় ঘুম না আসা কোটরে ঢোকা চোখ, অসময়ের বলিরেখায় কুঁচকে যাওয়া কপাল। কান পাতলে শোনা যায় বুকের গভীর থেকে উঠে আসা যন্ত্রণার দীর্ঘশ্বাস। যে মানুষটা বাড়িটা সার়াবে বলে একটু একটু করে টাকা জমাচ্ছিল, তাঁর সমস্ত সঞ্চয় চলে গেছে স্ত্রীর চিকিৎসায়। উদয়াস্ত পরিশ্রমের উপার্জনে যে গৃহ-পরিচারিকা মহিলা, অসুস্থ স্বামী আর সন্তানের পাতে এক টুকরো মাছ দিতেন, দিনরাত এক করে খেটেও তাঁর ডাল ভাত খেয়ে দিন চালানোর টাকা উঠছে না। মেয়ে মাধ্যমিক পাশ করলে যে বাবা একটা কম্পিউটার কিনে দেবেন কথা দিয়েছিলেন, তাঁর কারখানা বন্ধ আজ তিন মাস। যে লোকটার আগে দু বেলা আমিষ না হলে চলত না, এখন যাতায়াতের অটো ভাড়া বাঁচিয়ে সপ্তাহে তিনদিন ডাল-ভাত-তরকারি খেয়েও ছেলের কোচিং-এর ফি দু’মাস বাকি পড়ে যায় তাঁর।
মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তলানিতে। বিক্রি না হওয়া পণ্য বাজারে পড়ে থাকে, বড় বড় আড়তদারের গুদামে জমে শাকসব্জি খাদ্যশস্য। লোকসান ঠেকাতে বড় বড় কোম্পানিগুলো উৎপাদন কমায়, অনায়াসে ছেঁটে ফেলে বাড়তি হয়ে যাওয়া লোকগুলোকেও। কারখানার গেটে তালা পডে, রাতারাতি অচল হয়ে যাওয়া কর্মক্ষম হাতগুলো রাতে শুতে যায় পেটে খিদে নিয়ে।
অথচ এই রাজ্যে, এই দেশে সরকার বলে একটা জিনিস আছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের ভাষায়– জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকার, জনগণের সরকার। প্রত্যেক ভোটে বড় বড় দলের নেতা-মন্ত্রীরা এই জনগণের কাছে আসেন, কোটি কোটি টাকা খরচ করে রাস্তাঘাট ঢেকে ফেলেন উন্নয়ন আর জনসেবার চকচকে আশ্বাসে, গায়ের জোর টাকার থলি আর বাজারি মিডিয়ার আনুকূল্যে ক্ষমতায় তারা আসেনও। অথচ প্রতি ভোটের পরে নতুন করে দারিদ্রের ফাঁস চেপে বসে সাধারণ মানুষের গলায়। খিদের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে বাবা-মা বেচে দেন সন্তানকে, কেউ সপরিবারে মৃত্যুর পথ বেছে নেন। নারী-পাচার, শিশু-পাচার বাডে, বাড়ে বেকারত্ব, শিশু অপুষ্টি, ক্ষুধা। উন্নয়ন বা আচ্ছে দিন কি তা হলে কারও জীবনে আসে না? নিশ্চয়ই আসে। ক্ষমতায় যেই আসুক, সাধারণ মানুষের জীবনের কোনও সমস্যার সুরাহা হোক বা না হোক, বড় বড় শিল্পমালিক পুঁজিপতি ধনকুবেরদের মুনাফার পাহাড় উঁচু হয়েই চলেছে।
কি কেন্দ্র কি রাজ্য কোনও সরকারের নেতা মন্ত্রীরা এই ভয়াবহ মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে একটি শব্দও খরচ করছেন না। অসাধু ব্যবসায়ী মজুতদারদের গ্রেপ্তার করা, আপৎকালীন তৎপরতায় টাস্ক ফোর্স নামিয়ে খোলা বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা, চাষিদের থেকে সরাসরি ন্যায্য দামে জিনিস কিনে তা সুলভে সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করা, অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের মজুতদারি রুখতে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার মতো একটিও পদক্ষেপ নেওয়ার কথা তারা ভাবছেন না। খাদ্য, কৃষিপণ্য এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় শিল্পদ্রব্যের পুর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য ছাড়া যে মূল্যবৃদ্ধি রোখা সম্ভব নয়, এ কথা সরকারি কর্তারা জানেন না তা নয়। কিন্তু তা করতে গেলে কোপ পড়বে একচেটিয়া মালিকদের অতি মুনাফায়। তাদের সেবাদাস কোনও সরকারি দলই এই কাজ করে মালিক শ্রেণির চক্ষুশূল হতে চায় না।
মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে কঠোর সমালোচনার মুখে পড়লেই তারা আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দামের দোহাই দেন এবং কিছু মানুষ এই প্রচারে বিভ্রান্তও হন। তথ্য বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধির কোপ প্রতিবার সাধারণ মানুষের ওপর এসে পড়লেও, বিশ্বের বাজারে তেলের দাম যখন কমে তার কোনও সুবিধাই মানুষের কাছে পৌঁছায় না। তখন সরকার ট্যাক্স আরও বাড়িয়ে দেয়। পরিবহণ খরচ কমিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম কমানোর কথা তাদের মনে থাকে না। কারণ, মুখে যতই জনদরদের ফুলঝুরি ছোটাক, বাস্তবে মানুষের প্রতি এইসব ভোটবাজ দলের বিন্দুমাত্র দায়বদ্ধতা নেই। দেশের মানুষের শ্রম লুটে মুনাফার পাহাড় বানানো অবাধে চালিয়ে যেতে পুঁজিপতিরা এইসব দলের পিছনে লক্ষ কোটি টাকা খরচ করে এদের ক্ষমতায় বসায়। এই দলগুলোও সাধারণ মানুষের সেবার ভেক ধরে বাস্তবে দেশের বুকে পুঁজির শাসনকে সংহত করতেই সাহায্য করে। অন্য দিকে জীবনের মূল সমস্যাগুলো থেকে, রুজিরুটির লড়াই থেকে মানুষের নজর ঘুরিয়ে দিতে ধর্ম-বর্ণ-জাতপাতের বিভেদে উস্কানি দেয়। বিজেপি শাসনের গত ন-বছরে এ জিনিস বারবার ঘটে চলেছে, আজ দেশের মানুষের চূড়ান্ত দুর্দশার সময় জ্ঞানবাপী মসজিদে শিবলিঙ্গের উপস্থিতি নিয়ে বিতর্কও এই বিভেদকামী রাজনীতিরই ছক।
ক্ষমতার রাজনীতির এই স্বরূপকে চিনতে পারা এবং সঠিক নেতৃত্বে গণআন্দোলনের ময়দানে সংগঠিত হয়ে একে প্রতিরোধ করা আজ দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন।