করোনার আক্রমণ থেকে বাঁচাতে সরকারি ঘোষণায় দেশজুড়ে লকডাউন চলছে। দেশের সমস্ত কল-কারখানা, অফিস-আদালত, হাট-বাজার, দোকানপাট, বাস-ট্রেন বন্ধ। অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের সরবরাহটুকুই শুধুমাত্র চালু রয়েছে। রুজি-রোজগার হারিয়ে দেশবাসী গৃহবন্দি। বেশির ভাগ মানুষ নামমাত্র জমানো টাকাটুকু খুইয়ে অনাহারের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে। তবুও মানুষ সমস্ত দুর্ভোগ বিনা প্রতিবাদে সহ্য করে যাচ্ছে নিজের এবং দেশজোড়া মানুষের মঙ্গলের কথা ভেবে।
এই অবস্থায় দেখা গেল হঠাৎ কেন্দ্রীয় সরকার ছাড়পত্র দিয়ে দিল এবং রাজ্য সরকার হইহই করে সব মদের দোকান খুলে দিল। কাতারে কাতারে লোক জমা হতে লাগলো দোকানের সামনে। দেখা গেল, কোথাও দোকানের সামনে লাইন এক কিলোমিটার পর্যন্ত দীর্ঘ হয়েছে, কোথাও লাইনে দাঁড়িয়ে ধস্তাধস্তি, মারামারি করছে মানুষ। লকডাউন, সংক্রমণের ভয়, নিরাপদ শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার নিয়ম সব বানের জলের মতো ভেসে গেল। প্রশাসন নির্বিকার। তা হলে গত দেড় মাস ধরে মাটি মানুষ যে জীবিকা হারিয়ে রোজগারহীন অবস্থায় অনিশ্চিত এক জীবনে নিজেদের সঁপে দিতে বাধ্য হল, তা কিসের জন্য? কীসের জন্য মানুষকে শত শত মাইল হাঁটতে হাঁটতে রাস্তাতেই প্রাণ হারাতে হল?
লকডাউন কার্যকর করতে যে সরকারের মুখ্যমন্ত্রীকেও এমনকি কখনও খড়ি হাতে, কখনও লাঠি হাতে রাস্তায় নামতে দেখা যাচ্ছে, সেই সরকারই মদের দোকান খুলে লকডাউন ভেঙে তছনছ করে দিল কোন বিবেচনায়? অথবা এর মধ্যে আদৌ কোনও বিবেচনা কাজ করেছে কি? করলে তাকে কি আদৌ সুবিবেচনা বলা যায়?
মদ্যপায়ীদের মদ সরবরাহ কিংবা বাড়তি রাজস্ব আদায়, এ-সব কি করোনা সংক্রমণ আটকানোর থেকেও সরকারের কাছে বেশি জরুরি হয়ে পড়ল? সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা কি জানতেন না এর ফলে লকডাউন এর মূল উদ্দেশ্যটাই ব্যর্থ হয়ে যাবে? গত প্রায় দেড় মাস মদ্যপায়ীদের বেশিরভাগই যখন মদ না খাওয়াতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছিল, নিম্নবিত্ত, দরিদ্র পরিবারগুলিতে অশান্তি, গার্হস্থ্য অপরাধ অনেকখানি কমে আসছিল, রোজগারহীন হয়ে পড়া পরিবারগুলিতে সঞ্চিত সামান্য অর্থটুকু যখন মদের পিছনে খরচ না হয়ে খাদ্যের পিছনে, পুষ্টির পিছনে খরচ হচ্ছিল, তখন সরকারের এমন সিদ্ধান্ত এইসব পরিবারের উপর এক অভাবিত আঘাত হিসাবেনেমে এল। মানুষগুলি আবার গিয়ে লাইন দিল মদেরদোকানে। কেউ কেউ যুক্তি করছেন, দোকান বন্ধ থাকলেও চোরাপথে কি মদ পৌঁছাচ্ছিল না মদ্যপায়ীদের কাছে? যদি তা সত্যিও হয়, তবে তা কতটুকু? কিন্তু বাকি মানুষগুলি তো অভ্যস্ত হয়ে পড়ছিল মদ না খাওয়াতে। এমন অবস্থায় সরকার কেন আবার মদের দোকান খুলে দিল? তা ছাড়া চিকিৎসকরা প্রতিদিন বলছেন, করোনা প্রতিরোধ করতে সাধারণভাবে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো দরকার, যা অপুষ্টি জর্জরিত দরিদ্র মদ্যপায়ীদের ক্ষেত্রে দারুণভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। সরকার কি করে চিকিৎসকদের এই সাবধানবাণী তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিল? এর পিছনের উদ্দেশ্য কি শুধুই রাজস্ব আদায়, নাকি মদ ব্যারনদের লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা লাভ পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা– যার মোটা অংশ নেতা-মন্ত্রীদের পকেটে গিয়ে ঢুকবে? পুঁজিবাদী সরকারগুলি সম্পর্কে চিরকালই যে অভিযোগ ওঠে, কাজ জোগাতে, খাদ্য, চিকিৎসা জোগাতে ব্যর্থ সরকার মানুষকে মদের নেশাতেই ডুবিয়ে রাখতে চায় এবং এইভাবে জনগণের সমস্ত ক্ষোভ-বিক্ষোভকে চাপা দিতে চায়, এ ক্ষেত্রেও সেই উদ্দেশ্যটাই কি স্পষ্ট হয়ে উঠল না?
সরকারের মন্ত্রীরা, পুঁজিবাদী মিডিয়া এর পিছনে যুক্তি হিসাবে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায়ের বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসছে। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক সরকারদেশের মানুষকে মদেরনেশায় ডুবিয়ে দিয়ে, পরিবারগুলিকে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিয়ে এভাবে রাজস্ব তুলতে পারে কি? পারলে তাকে কি গণতান্ত্রিক সরকার বলা যায়? রাজস্ব আদায়ের আরও অসংখ্য উপায় আছে। প্রথমত, সরকারের স্তরে স্তরে যে ব্যাপক চুরি দুর্নীতি ঘটে চলেছে চলেছে চলেছে তা বন্ধ করলেই বিপুল পরিমাণ রাজস্ব বাঁচে। দ্বিতীয়ত ক্লাবের নামে, নানা মেলার নামে যে বিপুল পরিমাণ রাজস্বের অপব্যয় ঘটানো হচ্ছে, তা বন্ধ করলেও অনেকখানি রাজস্ব বাঁচে। তা ছাড়া ধনকুবেরদের কর ছাড় বন্ধ করে অতিরিক্ত কর চাপিয়ে অনায়াসে রাজস্ব বাড়ানো যায় যায়। সরকার সে উদ্যোগ নিচ্ছে না কেন?
মদ বন্ধ করলে যে রাজস্ব আদায় কমে না তার প্রমাণ তো পাশের রাজ্য বিহার, যারা সরকারি ভাবে মদ নিষিদ্ধ করেছে। সেখানকার সরকারি সমীক্ষাতেই দেখা যাচ্ছে, মদ নিষিদ্ধ করলেও রাজস্ব আদায়ে তার কোনও প্রভাব পড়েনি। কী ভাবে? না, দরিদ্র মানুষ যে টাকা আগে মদের পিছনে ব্যয় করত, সেই টাকা তারা এখন খাদ্যের পিছনে, ভোগ্যপণ্যের পিছনে ব্যয় করছে। তাতে রাজস্বের পরিমাণ না কমার পাশাপাশি যেমন পরিবারের মহিলাদের উপর, শিশুদের উপর অত্যাচার অনেকখানি কমেছে, তেমনই গরিব পরিবারগুলিতে মায়েদের এবং শিশুদের পুষ্টির পরিমাণ আগের থেকে বেড়েছে। এই অবস্থায় সরকারেরও জনগণের জন্য চিকিৎসার পেছনে, সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার পিছনে ব্যয় করতে হচ্ছে আগের থেকে অনেক কম। ফলে সরকারের রাজস্বে তেমন ঘাটতি পড়ছে না। সেই রাস্তায় না হেঁটে সরকারের মদেরনদোকান খোলার এই সিদ্ধান্ত তার চরম জনবিরোধী চরিত্রকেই প্রকট করল।