বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের মহান নেতা ও রুশ বিপ্লবের রূপকার কমরেড লেনিনের মৃত্যুশতবর্ষ উপলক্ষে দলের পক্ষ থেকে বর্ষব্যাপী কর্মসূচির অঙ্গ হিসাবে ভি আই লেনিনের ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লবক্স রচনাটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে। অনুবাদ সংক্রান্ত যে কোনও মতামত সাদরে গৃহীত হবে। এ বার ষোড়শ কিস্তি।
রাষ্ট্র বিলোপের অর্থনৈতিক ভিত্তি
তাঁর ‘‘ক্রিটিক অব দি গোথা প্রোগ্রাম”-এ মার্ক্স এই প্রশ্নের বিস্তৃত ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। (ব্র্যাকের প্রতি চিঠি, ১৮৭৫ সালের ৫ মে। ১৮৯১ সালে নিউ জেইট পত্রিকার নবম সংখ্যায় এই চিঠি প্রকাশিত হয়েছিল। এবং একটা বিশেষ সংস্করণে রাশিয়ায় প্রকাশিত হয়েছিল। তার আগে এই পত্র প্রকাশিত হয়নি।) এই উল্লেখ্যযোগ্য রচনার বিতর্কমূলক অংশে রয়েছে লাসালেবাদের সমালোচনা। বলতে গেলে, এই বিতর্কমূলক অংশ এর ইতিবাচক দিককে ঢেকে দিয়েছে। এই ইতিবাচক অংশে সাম্যবাদের বিকাশের সাথে সাথে রাষ্টে্রর বিলোপের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
মার্ক্স যেভাবে বিষয়টি উত্থাপন করেছিলেন
ব্র্যাককে লেখা মার্ক্সের চিঠি (১৮৭৫ সালের ৫মে) এবং যে চিঠির কথা আমরা আগে আলোচনা করেছি, সেই বেবেলকে লেখা এঙ্গেলসের চিঠি (১৮৭৫ সালের ২৮ মার্চ)– এই দুটির মধ্যে উপর উপর তুলনা করলে মনে হতে পারে, এঙ্গেলসের তুলনায় মার্ক্স অনেক বেশি ‘রাষ্ট্রের পক্ষে’ কথা বলেছেন। এবং রাষ্ট্রের প্রশ্নে এই দুই লেখকের মধ্যে চিন্তার পার্থক্য অনেক।
এঙ্গেলস বেবেলকে বলেছিলেন, রাষ্ট্র সম্পর্কে বকবকানি একেবারেই বন্ধ করা দরকার। তিনি বলেছিলেন, গোথা কর্মসূচি থেকে ‘রাষ্ট্র’ কথাটা বাদ দেওয়া প্রয়োজন এবং এর পরিবর্তে ‘কমিউনিটি’ শব্দটা ব্যবহার করতে হবে। এমনকী এঙ্গেলস এই ঘোষণাও করেছিলেন, যথার্থ অর্থে বলতে গেলে কমিউন আর কোনও রাষ্ট্রই ছিল না। যদিও মার্ক্স এমনকি ‘কমিউনিস্ট সমাজে ভবিষ্যৎরাষ্ট্রের’ কথা বলেছিলেন। অর্থাৎ, যেন, সাম্যবাদেও রাষ্ট্রের প্রয়োজনকে মার্ক্স স্বীকার করেছেন।
কিন্তু এই ধরনের চিন্তা মৌলিক দিক থেকেই ভ্রান্ত। খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলে দেখা যায়, রাষ্ট্র এবং তার বিলোপের প্রসঙ্গে মার্ক্স ও এঙ্গেলসের চিন্তা হুবহু এক। উপরে উদ্ধৃত বক্তব্যে মার্ক্স বিলোপের প্রক্রিয়ায় থাকা রাষ্ট্রের কথা বলেছিলেন।
স্পষ্টতই, রাষ্ট্র ভবিষ্যতের ঠিক কোন মুহূর্তে ‘বিলুপ্ত হয়ে’ যাবে তা বলতে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কেন না, এটা অবশ্যই একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। মার্ক্স ও এঙ্গেলসের মধ্যে আপাত পার্থক্যের কারণ হল, তাঁরা ভিন্ন ভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছিলেন এবং তাঁদের লক্ষ্যও ছিল আলাদা। রাষ্ট্র সম্পর্কে চালু থাকা সংস্কারগুলি কতটা অসার তা এঙ্গেলস খুব জোরের সাথে, স্পষ্ট এবং বিস্তারিতভাবে বেবেলকে দেখানোর জন্য এগিয়ে এসেছিলেন। লাসালের মধ্যেও এই সংস্কারের ভাগ কিছু কম ছিল না। মার্ক্স শুধু প্রসঙ্গক্রমে এই কথার উল্লেখ করেছেন। তাঁর আগ্রহ ছিল অন্য বিষয়ে, তা হল সাম্যবাদী সমাজের বিকাশ হবে কী ভাবে।
মার্ক্সের সমগ্র তত্ত্ব হল, আধুনিক পুঁজিবাদের বিকাশের ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা সুসমঞ্জস, পরিপূর্ণ, অত্যন্ত সুচিন্তিত ও সংহত প্রয়োগের তত্ত্ব। স্বাভাবিকভাবেই, পুঁজিবাদের আসন্ন ধ্বংস ও আগামী সাম্যবাদী সমাজের ভবিষ্যৎবিকাশের ক্ষেত্রে কেমন ভাবে এই তত্তে্বর প্রয়োগ হবে, মার্ক্সের সামনে ছিল সেই প্রশ্নটি।
তা হলে কোন তথ্যের ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ সাম্যবাদের ভবিষ্যৎ বিকাশকে আলোচনা করা যেতে পারে?
এই তথ্যের ভিত্তি– সাম্যবাদের উৎস হল পুঁজিবাদ। সাম্যবাদ ঐতিহাসিক ভাবে পুঁজিবাদ থেকে বিকশিত হয়েছে। পুঁজিবাদ জন্ম দিয়েছে এমন একটা সামাজিক শক্তির, যার ক্রিয়ার ফলই হল সাম্যবাদ। মার্ক্স কখনওই কল্পরাজ্য সৃষ্টি করতে চাননি। যা জানা নেই, সে সম্পর্কে অলস অনুমানের কোনও চেষ্টাই তিনি করেননি। একজন প্রকৃতিবিদ জীববিজ্ঞানে একটা নতুন প্রজাতির উদ্ভব, তার উৎস ও পরিবর্তনের গতিধারা সম্পর্কে জানার পর সে বিষয়ে যে ভাবে আলোচনা করেন, মার্ক্সও সাম্যবাদ সম্পর্কে সেই ভাবে আলোচনা করেছেন।
গোথা কর্মসূচির বিভ্রান্তিকে পাশে সরিয়ে রেখে সর্বপ্রথমে মার্ক্স রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যেকার সম্পর্কের প্রশ্নটি সামনে নিয়ে এসেছেন। তিনি লিখেছেনঃ
‘‘বর্তমান সমাজ পুঁজিবাদী সমাজ। সমস্ত সভ্য দেশেই এই পুঁজিবাদী সমাজ আছে। মধ্যযুগীয় রীতিনীতি থেকে কমবেশি মুক্ত, কমবেশি উন্নত এই দেশগুলিরবিশেষ ঐতিহাসিক বিকাশের ফলে পুঁজিবাদ কমবেশি পরিবর্তিত ও কমবেশি বিকশিত। অন্যদিকে, ‘বর্তমান দিনের রাষ্ট্র’ সীমানা পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়। সুইজারল্যান্ডের সাথে প্রুশো-জার্মান সাম্রাজ্যের পার্থক্য আছে, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইংল্যান্ডের পার্থক্য আছে। তাই ‘বর্তমান দিনের রাষ্ট্র’ একটি অলীক বস্তু।
‘‘বিভিন্ন সভ্য দেশের রাষ্ট্রগুলোর নানা ধরন এবং ব্যবস্থার বহু রকমের বৈচিত্র্য সত্ত্বেও এদের মধ্যে একটা মিল আছে। তা হল, এই সব রাষ্ট্রের ভিত্তি হল পুঁজিবাদী সমাজ। একটা একটু বেশি আর একটা একটু কম বিকশিত হলেও তারা পুঁজিবাদী পথেই বিকশিত। তাই, এদের কতকগুলো সাধারণ বৈশিষ্ট্যও আছে। এই অর্থে ‘বর্তমান দিনের রাষ্ট্র’ সম্পর্কে আলোচনা করা সম্ভব। ভবিষ্যতে যখন এর ভিত্তি, পুঁজিবাদী সমাজের আর অস্তিত্ব থাকবে না, বিষয়টি ঠিক এর বিপরীত হবে।
‘‘তা হলে প্রশ্ন ওঠেঃ কমিউনিস্ট সমাজে রাষ্ট্রের কী ধরনের রূপান্তর ঘটবে? অন্য কথায় বলতে গেলে, বর্তমান রাষ্ট্রের কাজের সাথে তুলনীয় কোন সামাজিক কাজগুলি তখনও বজায় থাকবে? একমাত্র বিজ্ঞানসম্মতভাবে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যেতে পারে। রাষ্ট্রের সাথে ‘গণ’ কথাটা জুড়ে দিয়ে হাজার রকমের জোটপাট খাওয়ালেও এই প্রশ্নের সমাধানের কাছাকাছিও পৌঁছাতে পারা যাবে না।
এইভাবে ‘গণ রাষ্ট্র’ সম্পর্কে সব কথার প্রতি বিদ্রুপ করে মার্ক্স প্রশ্নটিকে সূত্রবদ্ধ করেছেন ও আমাদের সতর্ক করে বলেছিলেন, একমাত্র বিজ্ঞানসম্মত তথ্যের ভিত্তিতেই এই প্রশ্নের বিজ্ঞানসম্মত উত্তর দেওয়া যেতে পারে।
বিকাশের সামগ্রিক তত্ত্ব, সামগ্রিকভাবে বিজ্ঞান, এই সত্য প্রতিষ্ঠা করেছে যে, পুঁজিবাদ থেকে সাম্যবাদে উত্তরণের জন্য ঐতিহাসিকভাবে বিশেষ একটা স্তর বা রূপান্তরকালীন একটা পর্যায় থাকতেই হবে। এই তত্ত্ব পুরোপুরি সঠিক। কল্পনাবিলাসীরা এই কথাটা ভুলে গিয়েছিল। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ভয়ে ভীত বর্তমানের সুবিধাবাদীরাও এই কথাটা মনে রাখেনি। (চলবে)