রাষ্ট্র ও বিপ্লব (১৪)—ভি আই লেনিন

 

বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের মহান নেতা ও রুশ বিপ্লবের রূপকার কমরেড লেনিনের মৃত্যুশতবর্ষ উপলক্ষে দলের পক্ষ থেকে বর্ষব্যাপী কর্মসূচির অঙ্গ হিসাবে ভি আই লেনিনের ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ রচনাটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে। অনুবাদ সংক্রান্ত যে কোনও মতামত সাদরে গৃহীত হবে। এ বার চতুর্দশ কিস্তি।

রাজতন্ত্রের মতো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রেও রাষ্ট্র আসলে এক শ্রেণি কর্তৃক অন্য শ্রেণিকে দমনের যন্ত্র ছাড়া কিছু নয়

মার্ক্সের ফ্রান্সের গৃহযুদ্ধ’ বইয়ের ১৮৯১ সালের ভূমিকা

‘ফ্রান্সের গৃহযুদ্ধ’-এর তৃতীয় সংস্করণের ভূমিকায় (১৮৯১-এর ১৮ মার্চ লেখা এই ভূমিকা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল নিউ জেইট পত্রিকায়) এঙ্গেলস রাষ্ট্রের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে, সে সম্পর্কে আলোচনায় বেশ কিছু আকর্ষণীয় মন্তব্য করেছিলেন। এরই সঙ্গে কমিউনের শিক্ষা সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী একটি সংক্ষিপ্তসার তুলে ধরেছিলেন। এই সংক্ষিপ্তসার এঙ্গেলস লিখেছিলেন কমিউনের কুড়ি বছর পরে। এই সংক্ষিপ্তসার যে কতখানি গভীর, কুড়ি বছরের অভিজ্ঞতা তা দেখিয়েছে। জার্মানিতে যে ‘‘রাষ্ট্রের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস’’ ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছিল, এই সংক্ষিপ্তসারে তারই বিরোধিতা করা হয়েছে। সঠিক ভাবেই একে এখানে আলোচিত প্রশ্ন সম্পর্কে মার্ক্সবাদের শেষ কথা বলা যেতে পারে।

এঙ্গেলস দেখেছেন, ফ্রান্সে প্রতিটি বিপ্লবে শ্রমিকরা অস্ত্র ধারণ করেছে, ‘‘… তাই শ্রমিকদের নিরস্ত্র করাই ছিল রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন বুর্জোয়াদের প্রথম কাজ। এইভাবেই, প্রতিটি বিপ্লবে শ্রমিকদের সাহায্যে জয় পাওয়ার পর শুরু হত নতুন সংগ্রাম। আর সেই সংগ্রাম শেষ হত শ্রমিকদের পরাজয়ে।’’

বুর্জোয়া বিপ্লবের অভিজ্ঞতার এই সারসংক্ষেপ যেমন সংক্ষিপ্ত, তেমনই তাৎপর্যপূর্ণ। সমগ্র বিষয়টির সারমর্ম এবং সেই সঙ্গে রাষ্ট্রের প্রশ্নেরও সারমর্ম (নিপীড়িত শ্রেণির হাতে অস্ত্র আছে কি?) এখানে অত্যন্ত সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বুর্জোয়া মতবাদের দ্বারা প্রভাবিত অধ্যাপকেরা ও পেটি বুর্জোয়া গণতন্ত্রীরা ঠিক এই মর্মবস্তুটিকে প্রায়শই উপেক্ষা করেন। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের সময় বুর্জোয়া বিপ্লবের এই গোপন কথা ফাঁস করে দেওয়ার সম্মান (ক্যাভেইনিয়াকী সম্মান) জুটেছিল মেনশেভিক, ‘‘তিনিও মার্ক্সবাদী’’ সেরেতেলির। ৯ জুন তাঁর ‘ঐতিহাসিক’ বত্তৃতায় সেরেতেলি ফাঁস করে দেন যে, বুর্জোয়ারা পেত্রোগ্রাদের শ্রমিকদের নিরস্ত্র করার বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। অবশ্য একে তিনি তাঁর নিজের সিদ্ধান্ত এবং ‘‘রাষ্ট্রে’’র পক্ষে বিশেষ প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত বলে চালিয়েছিলেন!

সেরেতেলির নেতৃত্বে সোসালিস্ট রেভোলিউশনারি ও মেনশেভিকরা কীভাবে বিপ্লবী সর্বহারা শ্রেণির বিরুদ্ধে বুর্জোয়া শ্রেণির পক্ষে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, ১৯১৭ সালের বিপ্লবের প্রত্যেক ইতিহাস-লেখকের কাছে সেরেতেলির ৯ জুনের বত্তৃতা তার অন্যতম জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত হিসেবে অবশ্যই পরিগণিত হবে।

রাষ্ট্র-সম্পর্কিত এঙ্গেলসের আরও একটি প্রাসঙ্গিক মন্তব্য ছিল ধর্ম নিয়ে। সবাই জানেন, জার্মান সোসাল ডেমোক্রেসি যত অধঃপতিত হয়ে আরও বেশি করে সুবিধাবাদে নিমজ্জিত হয়েছে, ততই তারা ঘন ঘন ঝুঁকেছে ‘‘ধর্ম একটি ব্যক্তিগত বিষয়’’– এই বিখ্যাত সূত্রটির সঙ্কীর্ণ অপব্যাখ্যায়। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে এই ব্যাখ্যাকে তারা এমন ভাবে হাজির করে, যেন বিপ্লবী সর্বহারা পার্টির কাছেও ধর্ম একটা ব্যক্তিগত বিষয়! সর্বহারা শ্রেণির বিপ্লবী কর্মসূচির প্রতি এই চরম বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধেই এঙ্গেলস তীব্রপ্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। ১৮৯১ সালে নিজের পার্টির মধ্যে এঙ্গেলস সুবিধাবাদের অতি ক্ষীণ সূত্রপাত দেখতে পেয়েছিলেন এবং তাই ওই বিষয়ে তাঁর মতামত অতি সাবধানে প্রকাশ করে বলেছিলেনঃ

‘‘…যেহেতু প্রায় ব্যতিক্রমহীন ভাবে শ্রমিকরা কিংবা শ্রমিকদের স্বীকৃত প্রতিনিধিরাই শুধু কমিউনে আসন গ্রহণ করতেন, তাই কমিউনের সিদ্ধান্তগুলি দৃঢ়ভাবেই হত সর্বহারা চরিত্রের। প্রজাতান্ত্রিক বুর্জোয়া শ্রেণি শুধু মাত্র ভীরুতার কারণে যে সব সংস্কার চালু করতে পারেনি অথচ যে সংস্কারগুলি শ্রমিক শ্রেণির স্বাধীন কার্যকলাপের ভিত্তি– যেমন, রাষ্ট্রের দিক থেকে ধর্ম নিতান্তই একটি ব্যক্তিগত বিষয়– এই নীতি কার্যকর করা, কমিউন সেই সব সংস্কার প্রবর্তনের আদেশ জারি করত। অথবা তারা সরাসরি শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থে আদেশ জারি করত যেগুলি অংশত সমাজের পুরনো ব্যবস্থাকে গভীরে আঘাত করে।’’

‘‘রাষ্ট্র সম্পর্কে’’ এই কথাটায় এঙ্গেলস ইচ্ছা করেই বিশেষ জোর দিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল জার্মান সুবিধাবাদকে সরাসরি আঘাত করা। পার্টির প্রশ্নে ধর্ম ব্যক্তিগত বিষয়, এ কথা ঘোষণা করে জার্মান সুবিধাবাদ বিপ্লবী সর্বহারা শ্রেণির পার্টিকে ‘স্বাধীন চিন্তাবিলাসী’ অত্যন্ত নিম্ন স্তরের কূপমণ্ডুকতার স্তরে নামিয়ে এনেছিল, যা সাম্প্রদায়িকতা মেনে নিতে রাজি, কিন্তু জনগণের বুদ্ধি বিনাশকারী ধর্মের আফিমের বিরুদ্ধে সংগ্রামে করতে রাজি নয়।

যে সব ইতিহাসবিদ ভবিষ্যতে জার্মান সোসাল ডেমোক্রেসির ইতিহাস লিখবেন, ১৯১৪ সালে তার লজ্জাজনক অধঃপতনের মূল কারণ খুঁজতে গিয়ে তাঁরা দেখতে পাবেন, এই বিষয়ে কৌতূহলোদ্দীপক উপাদানের কোনও অভাব নেই। পার্টির তাত্ত্বিক নেতা কাউটস্কির লেখাপত্রের মধ্যেকার নানা চাতুরিপূর্ণ ঘোষণা, যা সুবিধাবাদের দুয়ার হাট করে খুলে দিয়েছিল, সেগুলি থেকে শুরু করে তাঁরা পাবেন ১৯১৩ সালে ‘চার্চ পরিত্যাগ কর’ আন্দোলনেরপ্রতি পার্টির দৃষ্টিভঙ্গি।

কিন্তু আসুন আমরা দেখি, কমিউনের কুড়ি বছর পরে, সংগ্রামী সর্বহারার জন্য এঙ্গেলস তাঁর শিক্ষা কী ভাবে সংক্ষেপে বর্ণনা করেছিলেন।

এই শিক্ষাগুলির প্রতি এঙ্গেলস সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেনঃ ‘‘…১৭৯৮ সালে নেপোলিয়ন যে সেনাবাহিনী, রাজনৈতিক পুলিশ এবং আমলাতন্ত্র সৃষ্টি করেছিলেন, এটা ছিল অবিকল সেই বিগত কেন্দ্রীভূত সরকারের দমনকারী শক্তি। সেই সময় থেকে প্রতিটি নতুন সরকার এই দমনকারী শক্তিকে বাঞ্ছিত যন্ত্র হিসাবে গ্রহণ করেছে এবং বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে। সর্বত্র ঠিক এই শক্তিরই পতন হওয়া উচিত ছিল, ইতিমধ্যেই প্যারিসে যেমন হয়েছিল।’’

‘‘কমিউন প্রথম থেকেই একটা কথা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল যে, একবার ক্ষমতায় আসার পর শ্রমিক শ্রেণি পুরনো রাষ্ট্রযন্ত্র দিয়ে আর কাজ চালাতে পারে না। সদ্য অর্জিত আধিপত্য আবার হারাতে না হলে শ্রমিক শ্রেণির উচিত একদিকে সমস্ত পীড়নের যন্ত্র যা আগে তার নিজের বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হয়েছে, তা দূর করা। এবং অন্যদিকে তাদের নিজস্ব প্রতিনিধি ও কর্মকর্তাদের সবাইকে বিনা ব্যতিক্রমে যে কোনও সময়ে পদ থেকে সরিয়ে আনা যাবে– এ কথা ঘোষণা করে তাদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করা …।’’

এঙ্গেলস বারবার জোর দিয়ে বলেছেন যে, শুধু রাজতন্ত্রের নয়, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রেও রাষ্ট্র রাষ্ট্রই থাকে। অর্থাৎ, রাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের, ‘সমাজের সেবকদের’, রাষ্ট্রের যন্ত্রগুলিকে সমাজের প্রভুতে রূপান্তরিত করার মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলি বজায় থাকে।

‘‘রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের যন্ত্রগুলি সমাজের সেবক থেকে সমাজেরপ্রভুতে পরিণত হয়– পূর্ববর্তী সমস্ত রাষ্ট্রেই এই প্রক্রিয়া অবশ্যম্ভাবী ছিল। এই পরিবর্তন যাতে ঘটতে না পারে সে জন্য কমিউন দুটো নির্ভুল উপায় গ্রহণ করেছিল। প্রথমত, প্রশাসন, বিচারবিভাগ ও শিক্ষা বিভাগ প্রভৃতি সমস্ত পদেই কমিউন সংশ্লিষ্ট সকলের সার্বজনীন ভোটাধিকারের মাধ্যমে নির্বাচিত লোক নিয়োগ করেছিল। চাইলেই যে কোনও সময় প্রতিনিধিদের ফিরিয়ে আনা যাবে, নির্বাচকদের এই অধিকার ছিল। এবং দ্বিতীয়ত, অন্যান্য শ্রমিকরা যে মজুরি পেত, ছোট বড় সমস্ত কর্মকর্তাকে সেই পরিমাণ মজুরিই দেওয়া হত। কমিউনে সর্বোচ্চ মজুরির পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ফ্রাঁ।’’

‘‘এইভাবে উচ্চপদের খোঁজে থাকা ও কেরিয়ারমুখীনতার বিরুদ্ধে কার্যকরী বাধা সৃষ্টি করা হয়েছিল। এ ছাড়া প্রতিনিধিত্বমূলকপ্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের প্রতি প্রচুর পরিমাণে বাধ্যতামূলক বিধিনিষেধ তো ছিলই…।’’ (ফ্রান্সে গৃহযুদ্ধ)

এঙ্গেলস এখানে সেই চিত্তাকর্ষক সীমারেখার কাছাকাছি পৌঁছেছেন যেখানে সুসংহত গণতন্ত্র সমাজতন্তে্র রূপান্তরিত হয়, যেখানে সুসংহত গণতন্ত্র দাবি করে সমাজতন্ত্রের। কারণ, রাষ্ট্রকে অবলুপ্ত করতে হলে, রাষ্ট্রের কাজকর্মগুলিকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করা ও হিসাব রাখার সহজ কাজে পরিণত করতে হবে যাতে জনসাধারণের অধিকাংশ এবং শেষ পর্যন্ত প্রত্যেক ব্যক্তিই সেই কাজ করতে পারে। এবং আখের গোছানোর বিষয়টা সম্পূর্ণ অবলুপ্ত করতে হলে, সমস্ত সবচেয়ে স্বাধীন পুঁজিবাদী দেশগুলোতে প্রতিনিয়ত যেমন ঘটে থাকে তেমন, অলাভজনক কিন্তু ‘সম্মানজনক’ সরকারি পদকে ব্যাংক বা জয়েন্ট-স্টক কোম্পানির মোটা টাকার পদ দখলের সুযোগ হিসাবে যাতে ব্যবহার করা আদৌ সম্ভব না হয়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে।

কোনও কোনও মার্ক্সবাদী, উদাহরণস্বরূপ ‘জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারে’র বিষয়টি আলোচনা করতে গিয়ে যে ভুল করেন, এঙ্গেলস কিন্তু তা করেননি। তাঁরা যুক্তি তোলেন যে, পুঁজিবাদে জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার পাওয়া অসম্ভব এবং সমাজতন্ত্রের তা অপ্রয়োজনীয়। এই ধরনের আপাতদৃষ্টিতে সুচতুর কিন্তু আসলে ভুল উক্তি যে কোনও গণতান্ত্রিক সংস্থা সম্পর্কে, আমলাদের চলনসই বেতন সম্পর্কেও করা যায়। কারণ, পুঁজিবাদে সম্পূর্ণ সুসমঞ্জস গণতন্ত্র অসম্ভব এবং সমাজতন্তে্র সমস্ত গণতন্ত্র ক্ষয় পেতে পেতে বিলীন হয়ে যায়।

এটা একটা কূট তর্ক, সেই পুরনো মজাদার প্রশ্নটার মতো– লোকের আরও একটা চুল উঠে যাওয়া মানেই কি টাক পড়া?

গণতন্ত্রকে যুক্তিসঙ্গত পরিণতিতে বিকশিত করা, এই বিকাশের রূপগুলি খুঁজে পাওয়া, প্রয়োগের মধ্য দিয়ে সেগুলি পরীক্ষা করা ইত্যাদি সবকিছুই হল সমাজবিপ্লবের সংগ্রামের অন্যতম মূল কাজ। আলাদা আলাদা ভাবে দেখলে, কোনও ধরনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই সমাজতন্ত্র নিয়ে আসবে না। কিন্তু বাস্তব জীবনে গণতন্ত্রকে কখনওই ‘আলাদা ভাবে দেখা’ চলবে না, অন্যান্য বিষয়ের সাথে গণতন্ত্রকে একসঙ্গে দেখতে হবে। গণতন্ত্র অর্থনীতির উপর নিজস্ব প্রভাব বিস্তার করবে, তার রূপান্তরে উদ্দীপনা জোগাবে। আবার অর্থনীতির বিকাশের দ্বারা গণতন্ত্র নিজে প্রভাবিত হবে ইত্যাদি। এই হল চলমান ইতিহাসের দ্বান্দ্বিকতা।

এঙ্গেলস আরও বলেছেনঃ ‘‘পুরনো রাষ্ট্রক্ষমতার এই ধ্বংসসাধন এবং তার জায়গায় একটি নতুন ও প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার বিষয়টি ‘গৃহযুদ্ধ’ গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়ে বিস্তৃত ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু এর কিছু কিছু দিক নিয়ে এখানে সংক্ষেপে আরও একবার আলোচনা করা দরকার। কারণ, বিশেষ করে জার্মানিতে রাষ্ট্রের প্রতি অন্ধবিশ্বাস দর্শনের গণ্ডি ছাড়িয়ে বুর্জোয়া শ্রেণির এবং এমনকি বহু শ্রমিকেরও সাধারণ চেতনায় ছড়িয়ে গেছে। দর্শনগত ধারণা অনুযায়ী, রাষ্ট্র হল ‘ভাবের বাস্তব রূপায়ণ’ অথবা পৃথিবীতে ঈশ্বরের রাজত্ব, দার্শনিক পরিভাষায় রাষ্ট্র হল সেই ক্ষেত্র যেখানে শাশ্বত সত্য ও ন্যায় বাস্তবে রূপায়িত হয় বা হওয়া উচিত। এবং এখান থেকেই রাষ্ট্র ও তার সাথে যুক্ত সমস্ত কিছুরপ্রতি এক ধরনের অন্ধ ভক্তি দেখা দেয়। এই চিন্তা আরও সহজে শিকড় গেড়ে বসে, কারণ সাধারণ মানুষ ছোট থেকে ভাবতে অভ্যস্ত যে, অতীতে যেমন হয়েছে তেমন ভাবেই রাষ্ট্র ও তার উঁচু বেতনের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ছাড়া সমাজের সাধারণ কাজকর্ম ও স্বার্থের দেখভাল করা যায় না। জনসাধারণ মনে করে, বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের বিশ্বাসী হওয়া থেকে মুক্ত হয়ে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের প্রতি আনুগত্যের শপথ নিয়ে তারা সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার একটা অসাধারণ সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে। যদিও রাষ্ট্র আসলে এক শ্রেণি কর্তৃক অন্য শ্রেণিকে দমনের যন্ত্র ছাড়া কিছু নয় এবং রাজতন্ত্রের যেমন গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রেও তার থেকে একটুও কম নয়। বড় জোর বলা যায়, শ্রেণি আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জয়লাভ করার পর সর্বহারা শ্রেণি এই অশুভ শক্তিকে উত্তরাধিকার সূত্রে পায়। ঠিক কমিউনের মতোই বিজয়ী সর্বহারা শ্রেণি অবিলম্বে তার নিকৃষ্ট দিকগুলিকে ছেঁটে ফেলতে বাধ্য হবে, যতদিন না নতুন ও মুক্ত সমাজ পরিস্থিতিতে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্ম রাষ্ট্রের গোটা জঞ্জালের বোঝা আঁস্তাকুড়ে ফেলে দিতে সক্ষম হবে।’’

এঙ্গেলস জার্মানবাসীদের সতর্ক করে বলেছেন, রাজতন্ত্রের জায়গায় প্রজাতন্ত্র স্থাপিত হলে তারা যেন সাধারণ ভাবে রাষ্ট্রের প্রশ্নে সমাজতন্ত্রের মূল নীতিগুলি না ভোলে। তাঁর এই সতর্কবার্তা বর্তমানে সর্বশ্রী সেরেতেলি ও চার্নভদের কাছে বত্তৃতার মতো শোনায়, যাঁরা ‘কোয়ালিশন’-কৌশলে রাষ্ট্রের প্রতি তাঁদের বিশ্বাস ও অন্ধ শ্রদ্ধা প্রকট করে তুলেছেন!

আরও দুটি বিষয়ঃ প্রথমত, এঙ্গেলস যে বলেছেন, ‘‘রাষ্ট্র এক শ্রেণির দ্বারা অন্য শ্রেণিকে দমনের যন্ত্র’’ হিসাবেই থাকে এবং তা রাজতন্ত্রের যেমন, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রেও তার চেয়ে একটুও কম নয়, তার অর্থ মোটেই এমন নয় যে, নির্যাতনের রূপ যাই হোক না কেন, তাতে সর্বহারা শ্রেণির কিছু যায় আসে না। কোনও কোনও নৈরাজ্যবাদী অবশ্য এই কথাই শেখান। শ্রেণি সংগ্রাম ও শ্রেণি পীড়নের আরও প্রশস্ত, আরও স্বাধীন ও আরও প্রকাশ্য রূপ থাকলে তার ফলে শ্রেণি বিলোপের সংগ্রামে সর্বহারা শ্রেণির বিপুল সাহায্য হয়।

দ্বিতীয়ত, কেন একমাত্র নতুন প্রজন্মই পারবে রাষ্ট্রের জঞ্জালকে আঁস্তাকুড়ে ছুঁড়ে ফেলতে? এই প্রশ্ন গণতন্ত্রকে অতিক্রম করার প্রশ্নের সাথে জড়িত, যেটি নিয়ে আমরা এখন আলোচনা করব।

ফুট নোট

১ ।ক্যাভেইনিয়াক (১৮০২-১৮৫৭) ছিলেন একজন ফরাসি জেনারেল যিনি ১৮৪৮-এর জুনে প্যারিসের শ্রমিক-অভ্যুত্থান অবিশ্বাস্য হিংস্রতায় দমন করেছিলেন।

২। প্রায় ২৪০০ রুবলের সমান, বর্তমান (১৯১৭-এর আগস্ট) বিনিময় হার অনুযায়ী প্রায় ৬০০০ রুবলের সমান। যে সব বলশেভিক গোটা রাষ্ট্রের জন্য উচ্চতম বেতন ৬০০০ রুবলের– বেশ পর্যাপ্ত পরিমাণই– বদলে আরও বেশি ধার্য করার প্রস্তাব করেন, যেমন মিউনিসিপাল কাউন্সিলের সদস্যদের জন্য ৯০০০ রুবল বেতন ধার্য করার প্রস্তাব করেন, তাঁরা অমার্জনীয় অপরাধ করছেন।

(চলবে)